‘আজীবন ক্ষমতা’র চিন্তা-ভাবনা 

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ভোটচিন্তা নিয়ে গবেষণা : পছন্দের শীর্ষে চীনা পদ্ধতি

বিশেষ প্রতিনিধি : নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আপডেট ভাবনা চলছে সরকারের দেশি-বিদেশি থিঙ্কট্যাঙ্ক পর্যায়ে। এর ছাপ পড়েছে ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এরপর ঢাকা উত্তরের মেয়র, প্রথম পর্বের উপজেলা, সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে। তাদের বিশেষ ভাবনায় গুরুত্ব পাচ্ছে উত্তর কোরিয়া ও চীন মডেল। উন্নয়নের জন্য শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দুটি দেশকেই তারা মডেল হিসেবে দেখছে। কিছুদিন আগেও চীন মডেলের পক্ষে ছিলেন অনেকে। প্রস্তাব হিসেবে গত সংসদে তা প্রকাশও পেয়েছে দুয়েকজন সদস্যের মুখ দিয়ে। সরকারের শীর্ষমহলের ধমকে তা বেশি দূর এগোয়নি। সম্প্রতি ভেতরে ভেতরে জোরালো হয়ে উঠেছে উত্তর কোরিয়া মডেল।

থিঙ্কট্যাঙ্কদের মধ্যে আরো বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ধরন নিয়েও গবেষণা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোর নির্বাচন, ভোটপদ্ধতি, গণনা, ঘোষণার তথ্য নিচ্ছেন তারা। বাদ পড়ছে না ভোটের দিনক্ষণ-বিষয়ক গবেষণাও। ক্ষমতার নিশ্চয়তা প্রশ্নে চীনের পদ্ধতি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে বেশি পছন্দ। কিন্তু একটি অংশের কাছে এটি দৃষ্টিকটু এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সংসদের মাধ্যমে আজীবনের ক্ষমতার ম্যান্ডেট বুমেরাং হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তাদের। এ ক্ষেত্রে পঁচাত্তরে বাকশাল গঠন ও ট্র্যাজেডির অভিজ্ঞতা দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে আছে।

চীনের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সি চিন পিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদ আজীবন করার ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত কোনো বিপর্যয় ডেকে আনবে কি না, বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে আলোচনা চলছে। চীনারা রাজনীতিতে অনাগ্রহী ও নির্মোহ স্বভাবের হলেও দেশটিতে ভেতরে ভেতরে সম্প্রতি ভিন্ন পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। এর আগে দেশটির শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত ছিল প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট দুই দফার বেশি ক্ষমতায় না থাকার বিধান। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি শাসনতন্ত্র থেকে এই ধারা বাদ দিয়ে তা পার্লামেন্টে পাস হয়েছে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ক্ষমতাকাল আমৃত্যু সম্প্রসারিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, মাও সে তুংয়ের পর কমিউনিস্ট চীনে সির মতো ক্ষমতাশালী নেতার আবির্ভাব ঘটেনি।

সেই অনুকরণে আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্করা মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনাই বাংলাদেশে পরাক্রমশালী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি বঙ্গবন্ধুকেও ছাড়িয়ে গেছেন। বিশ্বে নামে গণতান্ত্রিক অনেক দেশেই এক ব্যক্তি ও এক দলের কর্তৃত্ব চলছে অনেকটা নির্বিঘ্নেই। রাশিয়ার পুতিন, তুরস্কের এরদোয়ান, সিরিয়ার বাশার ও মিসরের সিসিকে এর উদাহরণ ধরা হয়। ফিলিপাইনের দুতার্তে, মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানও এখন এই পথে এগোচ্ছেন। ভারতের মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প ও হাঙ্গেরির আরবানের মধ্যেও এর নমুনা বিদ্যমান। এই ধারা বাংলাদেশে বাস্তব করা সম্ভব বলে অনেকের মূল্যায়ন। এর পরও ঝুঁকির প্রশ্নে বিকল্প হিসেবে উত্তর কোরিয়ার পদ্ধতিকে আপডেট ভাবা হচ্ছে কয়েকটি মহল থেকে।
উত্তর কোরিয়ার সংসদ সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেমব্লি-এসপিএতে ভোটদান বাধ্যতামূলক। সরকারি তালিকার বাইরে এতে অন্য কোনো প্রার্থী থাকার সুযোগ নেই। সরকার যে জোট তৈরি করবে, সেই জোটকেই সর্বসম্মতভাবে ভোট দিতে হবে। এ ধরনের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ১০০। শাসক পরিবার এবং ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখানো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। প্রেসিডেন্ট কিম জং-আন ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্প্রতি দেশটিতে দ্বিতীয়বার এই নির্বাচন হলো। উত্তর কোরিয়ায় ১৭ বছর বয়সের ওপর সব নাগরিকের ভোট দেওয়া ও ভোরে নির্বাচন কেন্দ্রে লম্বা লাইনে হাজির হওয়া বাধ্যতামূলক। ভোটার কেন্দ্রে ঢোকার পর তার হাতে একটি ব্যালট পেপার দেওয়া হবে। ভোটার শুধু ব্যালট পেপারটি নিয়ে একটি বাক্সে পুরবে। আর ভোটের পর সরকারের সমর্থনে উল্লাস করবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের। সেই চেষ্টাও তারা করে না।

২০১১ সাল থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়ার শাসনদণ্ড হাতে থাকার পরও কিম চীনের মতো আজীবনের ক্ষমতাপদ্ধতিতে যাননি। পাঁচ বছর অন্তর পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছে এটিও একধরনের গণতন্ত্র। আবার উত্তর কোরিয়া একদলীয় দেশও নয়। কোরিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি ও কনডোইস্ট চংডু পার্টি নামে ছোট ছোট আরও দুটি দল রয়েছে। নির্বাচনের পর কিছু আসন তাদেরও দেওয়া হয়।

গোপনে ভোট দেওয়ার সুযোগও বাদ দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেটা করতে গেলে পোলিং এজেন্টের সন্দেহের তালিকায় পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। টেবিলের ওপর একটি পেনসিল রাখা হয়। ভোটার চাইলে একমাত্র প্রার্থীর ওপর ক্রস চিহ্ন দিয়ে দিতে পারেন। সেটি করলে নিশ্চিতভাবেই ওই ভোটারের পিছু নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। অথবা তাকে পাগল সাব্যস্ত করে। বিধিনিষেধের মাধ্যমে প্রায় শতভাগ ভোট কাস্টিংয়ের রেকর্ড চালু রয়েছে ভিয়েতনামেও।
নানা দেশের নির্বাচন ও ভোটপদ্ধতির তথ্য নিয়ে কাজে সম্পৃক্ত সূত্রে জানা গেছে, এ-সংক্রান্ত কিছু আজব কিন্তু জনপ্রিয় পদ্ধতিও তারা জেনেছেন। রোববার বা বন্ধের দিন ছাড়া ভোট হয় না- এমন কিছু দেশের তথ্য জোগাড় করেছেন তারা। এতে দেখা যায়, ভোটের দিন হিসেবে অধিকাংশ দেশের জনগণ সাপ্তাহিক বার হিসেবে পছন্দ করে ‘রোববার’কে। কারণ নির্বাচনের জন্য তারা ব্যক্তিগত কাজে প্রভাব ফেলতে রাজি নন। সেই ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারকে ভোটের জন্য উপযুক্ত মনে করে সেসব দেশের মানুষ। তবে মার্কিনরা এই থিওরির বাইরে। বিশেষ করে যাদের প্রাথমিক ভাষা ইংরেজি তারা রোববারকে এড়িয়ে যেতে চান। আবার কানাডার নাগরিকরা সোমবার বেছে নেয়। আমেরিকায় মঙ্গলবার ভোট হওয়ার নিয়মটি আইন দ্বারা প্রসিদ্ধ ছিল না কখনো। উনিশ শতক থেকে তারা মঙ্গলবারই ভোট দিয়ে আসছে। ১৮৪৫ থেকে শীতের আগে এবং ফসল কাটা শেষ হওয়ার পরে যেন নির্বাচনের কথা ভেবে বছরের একাদশ মাসকে বেছে নেওয়া হয়। তখন দূরদূরান্তের শস্য খামার থেকে নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় আসত ভোটাররা। সোমবার যাত্রা শুরু করে মঙ্গলবার ভোট দিত। তারপর আবার হাটের বার বুধবারের আগেই ভোট দেওয়া শেষ হতো তাদের। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এই নিয়ম আর বদলায়নি। ব্রিটেন বৃহস্পতিবার এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড শনিবারকে বেছে নেয়।

অস্ট্রেলিয়ার আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের প্রত্যেক নাগরিককে ভোটের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। তা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। সেখানকার ভোটারদের ফেডারেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটাও বাধ্যতামূলক। কোনো কারণে ভোট দিতে না পারলে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের জরিমানা। ভোট না দিলে জরিমানার বিধান রয়েছে ব্রাজিলেও। ভোট কাস্টিং বাড়াতে নানা গবেষণার অংশ হিসেবে শিশু-কিশোরদের ভোটার করার চিন্তাভাবনাও রয়েছে ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিকারাগুয়া ও আর্জেন্টিনার মতো দেশে। এসব দেশে ১৬ ও ১৭ বছরের ছেলেমেয়েরা ভোটার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ও সুদানে ১৭ বছরের নাগরিকরা ভোট দিতে পারে। জার্মানির কিছু স্টেটে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দেয় ১৬ বছরের ভোটাররা। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো স্কটিশ টিনএজ ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী নাগরিকরা ভোট দিতে সক্ষম হয়। সমীক্ষা করে তারা জেনেছে, যে দেশে বেশি টিনএজ ভোটার, সে দেশে জনগণও ভোটে শরিক হন। আবার শিশুরা যাকে পছন্দ করে, অভিভাবকদেরও তাকে ভোট না দিয়ে উপায় থাকে না।