বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিল্লীকা লাড্ডু

আবু সাঈদ রতন

প্রবাদ আছে, দিল্লীর লাড্ডু যে খায় সে প্রস্তায়, আর যে না খায় সেও প্রস্তায়। কথাটি এখন অনেকটা বিএনপির রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সরকারের অলআউট অ্যাকশনে দিশেহারা বিএনপি এখন পথহারা। বলা যায় প্রচন্ড ঝড়ে বিধ্বস্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় একটি দলে পরিণত হয়েছে। দলটি এখন কোন পথে হাঁটবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না। দলীয় চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘিত হচ্ছে বার বার। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা হতাশ। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া একটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দী আছেন প্রায় চার মাস হলো। জামিনে মুক্তি পেলেও অদ্যাবধি কারামুক্তি ঘটেনি । এনিয়েই দলে ভিন্ন মত আছে। কেউ বলছেন আইনি লড়াইয়ে চেয়ারপার্সনকে মুক্ত করা হবে। আবার কেউ বলছেন তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করা হবে মুক্তি দিতে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কোন ফর্মূলায় কাজ হচ্ছে না। অনেকগুলো টাটকা ইস্যু সামনে থাকলেও তা মাঠে কাজে লাগাতে পারে নি দলটি।
সরকারতো চাইবে তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। সে হিসেবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে সাহস পায়নি। দলীয় চেয়ারম্যানকে সাজা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিলেও রাজপথ গরম করতে সাহস পায়নি দলটি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া লন্ডনে বসে দিক-নির্দেশনা দিলেও তা সিনিয়র নেতারা ফলো করছেন না বলে মনে হচ্ছে। বরং উল্টো সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে গোপনে আপোষ রক্ষার কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
এই অবস্থায় সর্বদিক দিয়ে যখন রাজপথ কাঁপাতে ব্যর্থ দলটি তখন আগামী সংসদ নির্বাচন দোড়গোড়ায়। অর্থাৎ ছয় মাসের মধ্যে আগামি সংসদ নির্বাচন হবে। আওয়ামিলীগসহ মহাজোটভুক্ত দলগুলো তাদের দল গুছিয়ে আনলেও পিছিয়ে পড়ছে বিএনপি। তারা কি এখন নির্বাচনে যাবে; নাকি যাবে না। এ নিয়ে এখনও দোদুল্যমান। কি পর্যায়ে নির্বাচনকালীন সরকার হবে তার দাবি আদায়ে রাজপথে কি ভূমিকা থাকবে তাও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।
অপর দিকে দলীয় চেয়ারপার্সনের মুক্তি আন্দোলন নিয়ে কিভাবে রাজপথে নামবে তাও পরিষ্কার নয়। বিএনপির ভেতর দুটি ধারা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠছে। এক দল বলছে দলীয় চেয়ারপার্সনকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। অপরপক্ষ বলছে নির্বাচনে এবার বিএনপি না গেলে চরম মূল্য দিতে হবে দলটিকে। গত নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় দলের যে ক্ষতি হয়েছিল তা এবার কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যাবে। সরকারও চাচ্ছে দুর্বল বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য। পরিপূর্ণ শক্তিশালী বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এবং বিএনপির পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হলে তা সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাই কোনভাবেই বিএনপিকে ছাড় দিতে নারাজ সরকার।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতা কিছুটা হলেও কমে যাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণœ হবে। বিএনপি তাদের উভয় সঙ্কট থেকে প্ররিত্রাণ পেতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে আন্তর্জাতিক চাপ আশা করে। কারণ আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া শুধু রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে বিএনপি সংকটে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করতে যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক লবিং রয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া. ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য সেগুলোর অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্য খানিকটা ভূমিকা রাখতে পারে। এবার দেখা যাক এখানে কার প্রভাব কতটুকু।
সরকারের গত দশ বছরের উন্নয়নের সাক্ষ্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কারিশমার কারণে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতি শুধু আই ওয়াশে পরিণত হয়েছে। রাশিয়া, ভারত আওয়ামী লীগের সাথে বন্ধুত্ব ও নিবিড় সম্পর্ক যা পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। ১৯৭১ সাল থেকে তারা বাংলাদেশের পাশে রয়েছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনকে বাংলাদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সুযোগ দিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার চীনের আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্বক্ষম হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো এখন বিএনপির হাতছাড়া হয়ে গছে। হোসেন মোহাম্মদ এরশাদের কারণেই মধ্যপ্রাচ্য কিছুটা সরকারের পথেই রয়েছে। আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানের প্রভাব তেমন আছর করবে না। মূল ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের বিপক্ষে বেশ কিছু সময় অবস্থান নিলেও ভারত এবং রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। জাতিসংঘের ভেটো প্রদানের অন্যতম একটি দেশ রাশিয়া। তাই স্থায়ী কমিটির কোন মিটিংয়ে রাশিয়ার বিরোধিতার জন্য কাজ করতে পারবে না কোনদিন, এই বিশ্বাস সকলের। তবে যুক্তরাজ্যকে বশে আনতে মূল কাজটি করছে ভারত। ভারত যুক্তরাজ্যকে বুঝাতে স্বক্ষম হয়েছে যে বাংলাদেশ তাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র। ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য কোন দলটি ভারতের জন্য নিরাপদ ভারতই ভালো বুঝে।
সুতরাং ভারতের সিদ্ধান্তই এই অঞ্চলের শান্তি জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি এটি বুঝতে পেরেছে যে ভারত বিরোধী অবস্থান নিয়ে তারা যে ভাবে রাজনীতি করেছে তা আর সম্ভব নয়। শুধু জনগণের সমর্থন নয়- পার্র্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর নেক নজর না থাকলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। তাই তো বিএনপি লন্ডনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত থেকেই বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভারত সফর করেছেন।
জানা যায় এর মধ্যে হুমায়ুন কবির লন্ডন ভিত্তিক নেতা এবং তিনি তারেক রহমানের উপদেষ্টা হিসেবেও পরিচিত। এ নিয়েও চলছে রাজনীতি বিশ্লেষণ। আওয়ামীলীগ এ বিষয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে এই আন্দাজ করা যায়। তবে একটি প্রশ্ন জনমনে আসছে-যে দলটি ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক নেতাদের সমাবেশ ঘটিয়ে ছিল এবং বিগত সময়ে ক্ষমতায়ও এসেছিল বেশ দাপটের সাথে। তাই হঠাৎ করে তাদের কেবলা পরিবর্তন কি ভারত সহজে বিশ্বাস করবে?
দশ ট্রাক অস্ত্র, বিচ্ছিন্নবাদীদের আশ্রয় দেয়া, অস্ত্র পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ইতো পূর্বে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ের কথা ভারত কি ভুলে যাবে? নতুন করে বিএনপিকে পরীক্ষা করার মতো ঝুঁকি ভারত নেবে, না-কি পুরনো পরীক্ষিত মিত্র আওয়ামীলীগকেই নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাবে তা কেবল সময়ই বলে দিবে।
অপর দিকে বিএনপির লাখো সমর্থক যারা দিন রাত ভারতের বিরুদ্ধে রাজপথে স্লোগান দিয়েছে, সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে তারা রাতারাতি কি করে ভারতের পক্ষে কথা বলবেন? তাদের পুঁজিই ভারত বিরোধিতা। নেতারা ক্ষমতার রাজনীতির কারণে কৌশল বদলালেও মনে-প্রাণে কতটা বদলাবে তা নিয়ে ভারত যেমন সন্দিহান, তেমনি বিএনপির নেতা কর্মীরাও দ্বিধান্বিত। এক্ষেত্রে বিএনপির জন্য “দিল্লীকা লাড্ডু” যে শুধু লাড্ডু হয়েই থাকবে তা সময়ই বলে দিবে।
সম্পাদক, ইউএস বাংলা নিউজ, নিউইর্য়ক।