বাংলাদেশের রাজনীতি দিনবদলের প্রশ্ন

আবুল কাসেম ফজলুল হক

দিনবদল বলতে বোঝায় মৌলিক পরিবর্তন, গুণগত পরিবর্তন, বড় রকমের পরিবর্তন। এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিনবদল কি ঘটেছে? বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেউ কেউ দিনবদল কথাটা খুব জোর দিয়ে উচ্চারণ করে থাকেন।
ব্রিটিশশাসিত ভারতে আধুনিক রাজনীতির সূচনা ১৮৮৫ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সময়ে। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিপ্লববাদী গুপ্ত সমিতি অনুশীলন। অনুশীলন ভেঙে ১৯০৬ সালে গঠিত হয় যুগান্তর। তারপর গুপ্ত সমিতির ভাঙনের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯২১ সালে গঠিত হয় বিপ্লববাদী কমিউনিস্ট পার্টি- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৩৯ সালে সুভাষ বসু গঠন করেন ফরওয়ার্ড ব্লক, বিপ্লববাদী ধারায় তিনি গঠন করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। এসবের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশশাসিত ভারতে বিকশিত হয় আধুনিক রাজনীতি।
এই রাজনীতিতে দিনবদল দেখা যায় বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১১) মধ্য দিয়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে রাজনীতি হলের ভেতর থেকে মাঠে ও রাস্তায় নেমে আসে। রাজনীতির ভাষা ছিল ইংরেজি, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে বাংলা ও বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষা হয়ে ওঠে রাজনীতির অবলম্বন। অনুশীলন, যুগান্তর প্রভৃতি বিপ্লববাদী গুপ্ত সংগঠন শুরু থেকেই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরেই কংগ্রেসের ভেতরকার চরমপন্থিরা ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার দাবি তোলেন। ব্রিটিশ সরকারের উরারফব ধহফ জঁষব চড়ষরপু ছিল। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ রাজনৈতিক রূপ লাভ করে। এর মধ্যে ১৯০৬ সালে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। পাশাপাশি আত্মপ্রকাশ করে হিন্দু মহাসভা। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় থেকে রাজনীতি ছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করে উচ্চশ্রেণির ভারতবাসীর জন্য সুবিধা আদায় করা। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন স্বদেশী আন্দোলন রূপে গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেখা দেয় গণজাগরণ। রামমোহনের কর্মকাল (১৮১৫-৩৩) থেকে চলে আসছিল বৌদ্ধিক জাগরণ (জবহধরংংধহপব), এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো গণজাগরণ। গণজাগরণকে বৌদ্ধিক জাগরণের সম্প্রসারণ বলাই সমীচীন। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতে রাজনীতির দিনবদল ঘটে যায়।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রাম, গুপ্ত সমিতিগুলোর কর্মকা-, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকা-, সুভাষ বসুর বিপ্লবী প্রচেষ্টা চলতে থাকে। জাতীয়তাবাদী ধারা ও বিপ্লববাদী ধারার মধ্যে কোনো ঐক্য সাধিত হয়নি। জাতীয়তাবাদীরা শ্রমিক-কৃষককে গুরুত্ব না দিয়ে উচ্চশ্রেণির ও শিক্ষিত সমাজের স্বার্থ নিয়ে চলে। আর বিপ্লববাদীরা বিশেষ করে কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদকে ধনিক-বণিকদের ব্যাপার বলে কেবল ছাত্রদের ও শ্রমিক-কৃষকদের নিয়ে চলে। বিপ্লববাদীদের ও কমিউনিস্টদের থেকে সুযোগ্য নেতৃত্ব দেখা দেয়নি। ব্রিটিশ সরকারের উরারফব ধহফ জঁষব চড়ষরপু এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দলীয় স্বার্থান্ধতার কারণে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত পাকিস্তান ও ভারত। পূর্ববাংলার মুসলিম জনগণ সাধারণভাবে জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করে এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। তাতে পাকিস্তানে এবং ভারতেও রাজনীতির গুণগত বা মৌলিক চরিত্র বদলায়নি। তবে ইংরেজ শাসনের অবসানের ফলে পাকিস্তানের ও ভারতের রাজনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। এটাও অবশ্যই দিনবদল।
তারপর পাকিস্তানকালের রাজনীতি। পাকিস্তানকালের রাজনীতিতে মৌলিক বা গুণগত পরিবর্তন না ঘটলেও বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আইয়ুব সরকার ছয় দফা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে এবং কঠোরতম দমননীতি চালাতে থাকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে জড়ানো হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শেখ মুজিবকে এবং আওয়ামী লীগকে অভূতপূর্ব সমর্থন দেয় এবং আন্দোলন ক্রমে স্বায়ত্তশাসনের দাবি অতিক্রম করে স্বাধীনতার দাবিতে উত্তীর্ণ হতে থাকে। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছাড়া অন্য সব দল ও সাধারণ মানুষ ক্রমে স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীত্বে গঠিত হয় প্রথম বাংলাদেশ সরকার। এই সরকার প্রায় ৯ মাস ধরে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা নিয়ে পরিচালনা করে স্বাধীনতা যুদ্ধ। পরিণতিতে যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ও আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ যুগান্তকারী পরিবর্তন। বড় বড় সব ঘটনা এবং প্রায় ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরাট সব পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু রাজনীতির প্রকৃতি বিচার করতে গেলে বলতে হবেÑ কুশীলব কাহিনী বদল হলেও রাজনীতির মর্মগত পরিবর্তন ঘটেনি। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ চলছে ব্রিটিশ আমলের ও পাকিস্তান আমলের আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও প্রথা-পদ্ধতি নিয়েই- কোনো মৌলিক পরিবর্তন নেই। বহু বড় বড় ঘটনা, কুশীলব ও কাহিনী বদলকে দিন বদল বলে স্বীকার করতে হবে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সংবিধান ও ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে রয়েছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। কিন্তু রাজনীতির দিক দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তনগুলো টেকেনি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু, সপরিবারে ফজলুল হক মণি, সপরিবারে আবদুর রব সেরনিয়াবাত প্রাণ হারান। ঘটে যায় মর্মান্তিক সব ঘটনা। সামরিক শাসন, জরুরি অবস্থা, বড় বড় আন্দোলন ঘটে যায়। রাজনীতির মর্মপরিচয় সন্ধান করতে গেলে এগুলো দ্বারা বড় বড় পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এসব পরিবর্তনকে কি দিনবদল বলা যায়? বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসানের পর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং ১৯৯৬ সালে আবার ক্ষমতায় এসেছে। আওয়ামী লীগ বিরাট বিপুল শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে এবং তখন থেকে ক্ষমতায় আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি দিন বদল হয়েছে?
আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বাংলাদেশে রাজনীতির দিন বদল ১৯৮০-র দশকে ঘটেছে এবং ২০০৯ সাল থেকে ঘটে চলছে। এই দিন বদলের ঘটনাগুলো সম্পর্কে দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকা দরকার। সেই পরিচ্ছন্ন ধারণা আমরা অর্জন করতে পারি অনুসন্ধানের ও আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে। ভবিষ্যতের উন্নত রাজনীতির প্রয়োজনে ইতিহাস-বিকৃতির হাত থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে এবং ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমরা মিথ্যার মধ্যে পড়ে থেকে ভালো অবস্থা আশা করছি। তা হবে না, তা হতে পারে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিন বদল ঘটে গেছে ১৯৮০-র দশকে। সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী এনজিও সুশীল সমাজ (ঈরারষ ঝড়পরবঃু ঙৎমধহরুধঃরড়হং) প্রতিষ্ঠা, জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের কর্মনীতি ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। নাগরিক কমিটির পর নাগরিক কমিটির কার্যক্রম, সিপিডি, সুজন, ট্রান্সপারেন্সি, ডেমোক্র্যাসি ওয়াচ, ইলেকশন ওয়াচ, পরিবেশবাদী সংগঠন, নারীবাদী সংগঠন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার, জরুরি অবস্থা, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দূতাবাসমুখিতা ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক অভিমুখিতা ইত্যাদি দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির যথার্থ দিনবদল। এই দিন বদলের শুরু ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই। পরবর্তীকালে এই প্রক্রিয়া গভীরতর ও বিস্তৃততর হয়ে চলছে। এর মধ্যে চলছে বিশ্বায়নের কর্মধারা। বিশ্বায়ন প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদেরই উচ্চতর স্তর।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আর একটি বড় পরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলেছে। সেটা বোঝা দরকার। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকেও, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও প্রায় সব সময় বিরোধী দলগুলো সরকার ও সরকারি দলকে আক্রমণ করে প্রচার চালাত। বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গির কর্তৃত্ব ছিল। ২০০৯ সাল থেকে এটা একেবারে উল্টে গেছে। এখন সরকারি দল ও সরকারি লোকেরা প্রবলভাবে বিরোধী দলগুলোকে আক্রমণ করে চলছে এবং বিরোধী দলগুলো আত্মপক্ষ সমর্থনের যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলছে। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঘটনাবলির বিপুল প্রচার দিচ্ছে। এভাবে প্রচার করার মতো বিষয় সবসময়ই কিছু না কিছু ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকে আর কোনো সরকারই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই প্রচারকার্য চালায়নি। হয়ত কোনো নেতৃত্ব এভাবে চিন্তাও করেনি।
এসব দেখে বলা যায়, ১৯৮০-র দশক থেকে এনজিও ও সিএসওগুলোর মাধ্যমে এবং ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দিন বদল ঘটেছে। কিন্তু এসবের দ্বারা কোনো সুস্থ স্বাভাবিক রাজনীতি বাংলাদেশে দেখা দেয়নি। গণতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে ভোটাভুটিতে। সমাজতন্ত্র আবেদনহীন। নির্বাচনতন্ত্রও আবেদনহীন। উৎপাদন ও সম্পদ বাড়ছে। অন্যায়-অবিচার জুলুম-জবরদস্তি ও অসাম্য বাড়ছে। কোনো স্স্থু-স্বাভাবিক জীবন ধারার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে না। রাজধানী ঢাকায় জীবনযাত্রা অচল হয়ে আসছে। তবু বাংলাদেশের উচ্চশ্রেণির লোকেরা খুব আশাবাদী। তারা সোনার বাংলা উপভোগ করছেন। সুশীলসমাজীরা সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী-কর্মতৎপর। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা সুস্থ স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় উত্তীর্ণ হবো?
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।