বাংলাদেশের রাজনীতি : ২+২=৫

রাহাত খান : ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে। সদ্য বিদায় নেওয়া বছরটি ছিল নানা শুভ-অশুভ ঘটনায় পূর্ণ। নতুন বছরটি মাত্র নানা আশা-প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। কেমন যাবে, তা বলা সাধ্যাতীত। তবে আশা করতে তো ক্ষতি নেই। ২০১৮ সাল সবার জন্য শুভ হবে না, মঙ্গলজনক হবে না। তবু অর্ধসত্যের বিপক্ষে গিয়ে হৃদয়মথিত এই প্রার্থনা জানাই, ২০১৮ সাল যেন সবার জন্য সহনীয় হয়। শুভ ও মঙ্গলময় হয়।
যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি, তা ব্যাপক ও জটিল। এই বিষয়ে পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলেন না, তা ঠিক নয়। এও বলা যায়, হীনমন্যতা ও অন্যান্য কারণে রাজনীতির মৌল এ বিষয়টি অর্ধস্ফুট করে রাখতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা দিন দিন। রাজনীতিকরা শব্দ ও বাক্যের অন্তরালে সত্য কথন থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন। অবশ্য সবাই না, অনেকে।
রাজনীতি নিয়ে যারা নিয়মিত লেখালেখি করেন, তাদের মধ্যে একশ্রেণির জনপ্রিয় লেখক বা কলামিস্ট আছেনÑ যারা জানেন, লেখার উদ্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে সুকৌশলে কতভাগ সত্যের মিসেল দিলে একটা বড় মিথ্যা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলেও হতে পারে।
আমিও তাদের ঠিক অনুসরণ করতে চাই না। আবার বাড়াবাড়ি রকম কিছু বলার ইচ্ছাও নেই। রাজনীতি যারা করেন, নির্বাচন জিতে দেশের শাসনক্ষমতায় যান কিংবা নির্বাচনে ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করেন, পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে সক্রিয়, রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিষয়ে পূর্ণ সত্য উন্মোচনের দায়দায়িত্ব বহুলাংশে তাদের। জনগণের সব শ্রেণিরও এ ক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব কম নয় কিছুমাত্র। তবে কিনা সাংগঠনিক ঢাল বা শক্তি যাদের নেই, তাদের পূর্ণ সত্য কথনে ঝুঁকির মাত্রা এতটাই যে, মহাপুরুষ ও উন্মাদ ছাড়া সে পথ মাড়ানোর সাহস কারো হবে না। বলে রাখা ভালো, আমি মহাপুরুষ বা উন্মাদÑ কোনোটাই নই। ভেবে-চিন্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার পত্তন সম্পর্কে বক্ষমান নিবন্ধে কিছু বলতে চাইছি।
একটা বিষয় লক্ষ্য করা যেতে পারে প্রসঙ্গক্রমে। উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সময়ের বিবর্তনে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কমবেশি স্থিতি পেয়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু তা নয়। পরিবার-পরিজনের অনেক সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক নৃশংস হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে শাহাদতপ্রাপ্তির পর বাংলাদেশের নতুন শাসনকর্তা জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে নতুন একটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংক্ষেপে বিএনপি আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার শুরু বলতে গেলে তখন থেকেই।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়াও ন্যাপ, জাসদ, ন্যাপ-ভাসানী ইত্যাকার রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল। তবে ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট, একই সঙ্গে প্রধান সামরিক প্রশাসক, একই সঙ্গে প্রধান সেনাপতি লে. জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাতে। কোন রাজনৈতিক দল কয়টা পার্লামেন্টে আসন পাবে, তা কার্যত প্রেসিডেন্টই গোপনে নির্ধারণ করেন। সেভাবেই অনেকটা কর্তৃত্ব কিছুটা বাস্তবতা মেনে বাংলাদেশে ‘তৈরি’ হয়ে গেল দুই দলীয় রাজনীতির ধারা। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিপালিত হলো ক্ষমতাসীনদের চিন্তা।
পরে অবশ্য নব্বইয়ের দশকের কিছু আগে ও পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হলো পরিপূর্ণভাবে। এক ব্যক্তি-এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দুইবার ক্ষমতায় যায় বেগম খালেদা নেতৃত্বাধীন বিএনপি। সে সময় সংসদীয় বিরোধী দলে থাকে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ বর্তমান দফা নিয়ে তিনবার ক্ষমতাসীন হয়েছে নির্বাচন জিতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি নির্বাচনে না এলেও নির্বাচনে যোগ দেয় বাংলাদেশ রাজনীতির তৃতীয় শক্তি জাতীয় পার্টি, ন্যাপ, জাসদ, বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টিসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল জয় পেয়েছিলÑ যেহেতু বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। যাহোক, নির্বাচনী রাজনীতির ধারায় বিএনপি এ পর্যন্ত পাঁচটি নির্বাচনে দুইবার বিরোধী দলে, দুইবার ক্ষমতাসীন দলে থাকার স্ট্যাটাস অর্জন করেছে। একই ধারায় নির্বাচন জিতে ও হেরে দুইবার সংসদে বিরোধী দলে এবং তিনবার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান বা স্ট্যাটাস অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ উন্নয়নশীল এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত পশ্চাৎপর দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই দলীয় ব্যবস্থা স্থিত হয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ ছাড়া রাজনীতিতে এমন দুই দলীয় ব্যবস্থা বিশ্বে বিরল বললেও কম হয়।
বাংলাদেশ তাহলে কোন জাদুমন্ত্রবলে সময়ের ধারানুক্রম ছাড়াই পশ্চাৎপর দেশ হিসেবে রাজনীতিতে দুই দলীয় ব্যবস্থায় স্থিত হতে পারল? এক হিসেবে এটা তো রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিশাল অর্জন। কিন্তু না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই ব্যবস্থা প্রবর্তনের মূলে রয়েছে বহু জবরদস্তি, বহু দুর্বলতা। সে কথায় পরে আসছি। আগে সত্যিকারের রাজনৈতিক দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কীভাবে রূপায়িত ও কার্যকর হয়েছে, তার খানিকটা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে তুলে ধরছি।
গণতন্ত্র ও দ্বিদলীয় রাজনীতির আদর্শ দেশ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে একদা যা ছিল গ্রেট ব্রিটেন, তার নাম। সময়ের ধারায় গ্রেট ব্রিটেন অবয়বে ও প্রভাবব্যাপ্তিতে ছোট হতে হতে এখন শুধুই ব্রিটেন। গ্রেট শব্দটি অধুনা আছে শুধু ব্রিটেনবাসীর ইতিহাস, স্মৃতি ও দীর্ঘশ্বাসে।
তা হোক। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যে ব্রিটেন এখনো আলোকিত এক দেশ। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত দেশটিতে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অধিষ্ঠান ছিল। রাজা বা রানির কর্তৃত্ব ছিল বেশিÑ যদিও তা পার্লামেন্টের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে ঘোষিত ও কার্যকর হয়। অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই সেখানে ঘটে গণতন্ত্রের নীরব বিপ্লব। রাজতন্ত্র বহাল রাখা হয় কৃষ্টি-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। আর রাজতন্ত্র সর্বাংশে পরিণত হয় আলঙ্কারিক শোভা হিসেবে। পার্লামেন্ট হয়ে ওঠে রাষ্ট্র ও রাজনীতি প্রকৃত নিয়ামক।
ব্রিটেনে লিখিত সংবিধান নেই। তবে যথাযথ অধিকার ও দায়িত্ব দিয়ে প্রশাসন, নির্বাচনী সংস্থা ও বিচার বিভাগে এমন রূপান্তর আনা হয়েছে, যা হয়ে উঠেছে প্রাতিষ্ঠানিক। একই সঙ্গে জবাবদিহিমূলক। রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভে, আরও বলা যায়, স্বাধীন মিডিয়ার চতুর্থ স্তম্ভ নিয়ে যে প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের ভিত্তি রচনা করা হয়েছে, সেটিই কার্যকর গণতন্ত্রের শক্তি ও সৌন্দর্য।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই দলীয় ব্যবস্থা আছে। তবে রাষ্ট্র শাসনের মূল স্তম্ভগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তেমন নেই বললে হয়। ফলে গণতন্ত্র নামে আছে, বাস্তবে নেই। তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয়, উন্নয়নের অভূতপূর্ব কর্মধারায় দরিদ্রদশা থেকে গত ৯ বছরে দেশটা যেমন নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হয়েছে, তেমনি নানা ফাঁকফোকর থাকা সত্ত্বেও জঙ্গি-সন্ত্রাসী দমন ও দলমত নির্বিশেষে অভিযুক্ত অপরাধীদের বিপক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ায় দেশ অবশ্যই আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। এই প্রাপ্তি বিরোধী রাজনীতিকদের কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে। তবে দেশের সাধারণ মানুষ তাতে উপকৃত হচ্ছে।
এটা ঠিক, ‘বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটর’-এর দ্বারাও দারিদ্র্যদশা দূর হতে পারে, প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটের কাছাকাছি যেতে পারে, জঙ্গি-সন্ত্রাসী দমন হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে যে কোনো ধরনের উদার বা কঠোর স্বৈরশাসক তার দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন করতে পারেন না। সে জন্য বর্তমান ৯ বছর ক্ষমতায় থাকা সরকারকে স্বৈরশাসকের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
তবে আমরা চাই, গণতন্ত্রের ধারায় দেশ পরিচালিত হোক। শুধু নির্বাচন গণতন্ত্রের পতাকা বহন করে না। প্রশাসন, নির্বাচনী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও মিডিয়াÑ রাষ্ট্রের এই চার স্তম্ভকে প্রাতিষ্ঠানিক করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন কোন রাজনৈতিক দল ঈপ্সিত ভূমিকা নিতে পারে, এটা আমরা যে জানি নাÑ তা নয়। গণতন্ত্রের স্বপ্ন ও বাস্তবতা সামনে রেখে যারা দীর্ঘ কয়েক যুগ সংগ্রাম করেছেন, তাদের ওপরই সচেতন নাগরিকদের বেশি আস্থা ও ভরসা। দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই। জোরজবর করে নয়, উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে নয়Ñ চাপাবাজির জোরে তো নয়ই।
রাহাত খান : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক