বাংলাদেশের রাজনৈতিক রক্তচোষা

এম নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের শহর কিংবা গ্রাম, সবখানেই বনে-বাদাড়ে এই প্রাণীটিকে দেখা যায়। গড় ৪৪ সেন্টিমিটার এই প্রাণীটির লেজটিই ৩২ সেন্টিমিটার, দেহ মাত্র ১২ সেন্টিমিটার। দেহের ওপরের অংশ বাদামি থেকে ধূসর। প্রাণীটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। আর তা হচ্ছে, প্রয়োজনের সময় প্রাণীটি এই রঙ পরিবর্তন করতে পারে। এই রঙ বদলই প্রাণিটিকে বিশিষ্ট করে রেখেছে। নিরীহ এই প্রাণীটিকে গ্রামে-গঞ্জে সবাই রক্তচোষা নামে চেনে। আদতে কি রক্তচোষা নামে কোনো প্রাণী আছে? আছে। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলে আছে এক ধরনের বাদুড়, যাদের বলা হয় ভ্যাম্পায়ার ব্যাট।
এই বাদুড়গুলো রক্তপান করেই বেঁচে থাকে। এরা মানুষের রক্ত পান করলেও, মানুষই এদের প্রধান শিকার নয়। এদের প্রধান শিকার গরু, ঘোড়া এবং অন্যান্য গবাদি পশু। এদের ওপরের চোয়ালের সামনের সারিতে যে দুটি-দুটি দাঁত অর্থাৎ ছেদক দাঁত রয়েছে তা অনেকগুণ বেশি তীক্ষ্ম। বাদুড়গুলো এ দাঁতের সাহায্যে শিকারের শরীরে ক্ষত তৈরি করে। আর এ ক্ষত থেকে বের হওয়া রক্ত পান করে বেঁচে থাকে। তবে শিকারের শরীর থেকে বের হওয়া এ রক্ত যাতে কোনো ব্যাঘাত ছাড়া পান করতে পারে সেকারণে বাদুড়টি তার মুখ থেকে বিশেষ এক ধরনের লালা নিঃসরণ করে। এ লালা রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয় না। ফলে বাদুড়টি খুব দ্রুত ও নিজের সুবিধামতো রক্ত পান করতে পারে। এই বাদুড় যখন কোনো প্রাণীর শরীরে দাঁত বসায়, সে তখন কিছুই টের পায় না। কোনো ধরনের ব্যথাও অনুভব করে না। কারণ এদের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা সেই স্থানটি অবশ করে ফেলে। এরা মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর শরীর থেকে যে রক্ত পান করে, তার পরিমাণও খুবই সামান্য। এর ফলে মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে স্থানে বাদুড়ের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা থাকে সেই স্থানে রক্ত জমাট বাঁধতেই পারে না। রক্তপাত ঘটতেই থাকে। ছোটোখাটো কোনো প্রাণীর দেহে এমন ক্ষতের সৃষ্টি হলে শুধু অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণেই প্রাণীটির মৃত্যু হয়। এমনকি সঠিক চিকিৎসায় রক্তপাত বন্ধ না করা গেলে মানুষও মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি ড. কামাল হোসেন যেন বাংলাদেশের রাজনীতির সেই রক্তচোষা বাদুড়। একটু পেছনে তাকিয়ে দেখুন। ড. কামাল হোসেন ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। তাকে তো একসময় দলটির সবচেয়ে মূল্যবান অ্যাসেট হিসেবে গণ্য করা হতো। মনে করা হতো একজন ড. কামাল হোসেন যে দলে আছেন, সে দলটি ভবিষ্যতে কখনো কক্ষচ্যুত হবে না। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল? ড. কামাল হোসেনই বারবার আওয়ামী লীগকে তার প্রগতিশীল রাজনীতি থেকে বিচ্যুত করর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ নয়, দলের খেয়ে নিজের আখের গোছানোর কাজে তিনি বিশেষ পারঙ্গম। অল্পবয়সে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুনজরে পড়েছিলেন। ওইটুকু পুঁজি সম্বল করে বাংলাদেশের ছোট রাজনৈতিক পরিসরে বড় জায়গা করে নিতে তার খুব একটা সমস্যা হয়নি। ‘নিজের বেলা ষোলআনা’ আদায় করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’। বিনিময়ে কণামাত্র বিসর্জন দিতে নারাজ। বঙ্গবন্ধু যাকে নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে এনছিলেন, মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য করেছিলেন, সেই ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কী করে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, কোথায় ছিলেন, সে সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আসলে কি তিনি আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ? তা-ই যদি হবে, তাহলে তিনি রাজাকারদের সঙ্গে কী করে আপোস করেন? মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার কাজটি বরাবরই নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে করে এসেছেন ড. কামাল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার গুণটিও তার অসামান্য। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী কামাল দুই যুগ আগে আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর এবার তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আবার নির্বাচনে ভরাডুবির পর কারচুপির অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচনের দাবিও জানান তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এবার তাদের প্রতীক ধানের শীষ ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের ২২ জন সদস্যকে মনোনয়ন দেয়। অথচ বিএনপি সঙ্গে করা ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন। ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরাও নির্বাচন করেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। যিন নিজেকে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সৈনিক হিসেবে দাবি করেন, তিনি কী করে জামায়াতের সঙ্গে প্রতীক ভাগভাগি করেন? অর্থাৎ তার আদর্শ বঙ্গবন্ধু নন, অন্য কেউ! আবার ভোটের প্রায় দুই সপ্তাহ পর, গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের প্রার্থী করা ‘ভুল’ ছিল বলে স্বীকার করে জোটের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপিকে চাপ দেবেন বলেও জানান। এখন পর্যন্ত সেই ‘চাপ’টি দিতে পেরেছেন বলে জানা যায়নি।
আসলে ড. কামাল হোসেনের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা চরিত্রটি প্রকাশ্যে চলে এসেছে এবার। কী করে এলো, সে গল্পে যাওয়ার আগে একটি ছবির গল্প বলি। এ ছবিটি ১৯৯০ সালের। তখন এরাশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে শ্রীলংকান অ্যাম্বেসির এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ঘাতক অবসরপ্রাপ্ত মেজর বজলুল হুদার সঙ্গে ড. কামাল হোসেন। এই হচ্ছে ড. কামালের চরিত্র, যেটা এত দিনে প্রকাশে চলে এসেছে। সেই শিয়ালের গল্পটা বলি, বিষয়টি সবার কাছে খোলসা হয়ে যাবে।
এক দিন একটা শিয়াল বন ছেড়ে গ্রামে এসে ঢুকে পড়ল। গ্রামের কুকুর শিয়ালটাকে তাড়া করল। তাড়া খেয়ে শিয়াল ভয়ে দৌড়ে এক তাঁতীর বাড়িতে ঢুকল। এদিক-ওদিকে লুকাতে গিয়ে পড়ল কাপড় রঙ করার জন্য রাখা রঙের বিশাল এক গামলায় আর সে রঙের গামলাটা ছিল বেশ বড় এবং উঁচু। অনেক চেষ্টার পরও শিয়ালটা কিছুতেই গামলাটির ভেতর থেকে বাইরে আসতে পারল না। শিয়ালটা সেই গামলার ভেতর মরার মতো পড়ে রইল। পরদিন তাঁতীরা এসে শিয়ালের এ দশা দেখে মনে করল, বোধহয় শিয়ালটা মরে গেছে। তাই তাঁতী বেচারা গামলাটা কাত করতেই শিয়ালটা ছুটে পালিয়ে বনের ভেতর চলে গেল।
এ দিকে সবুজ রঙের ভেতর পড়ে শিয়ালের গায়ের রঙ বদলে একেবারে সবুজ হয়ে গেল। বনের পশুরা মনে করল এ আবার কেমন জীব। দেখতে শিয়ালের মতো; অথচ গায়ের রঙ সবুজ। এমন পশু তো আমরা কখনো দেখিনি। এই নতুন পশুকে দেখে বনের বাঘ, ভাল্লুক; এমনকি সিংহও ভয় পেয়ে দূরে পালিয়ে গেল। শিয়াল ভাবলো, বেশ এত ভারী মজা। এ সুযোগে আমি বনের রাজা হয়ে যাই না কেন? আমায় দেখে বনের সব বড় বড় পশুগুলো ভয়ে পালিয়ে গেছে। তাই শিয়াল বনের আর যত শিয়াল ছিল তাদের ডেকে বলল, দেখ, আমায় আমাদের সৃষ্টি কর্তা তোমাদের রাজা করে পাঠিয়েছেন। আজ থেকে আমি তোমাদের রাজা, আমার কথামতো তোমরা সবাই কাজ করবে। শিয়ালগুলো এককথায় নতুন রাজার ঘোষণা মেনে নিলো, তারা নতশিরে বলল, মহারাজ যা আদেশ করবেন, আমরা তাই করব। আমরা সবাই আপনার অনুচর হয়েই থাকব। কিছুদিন যেতে না যেতেই বনের বড় বড় পশু এসে সবুজ শিয়াল রাজার অনুগত হয়ে শিয়ালের সেবা করতে লাগল। তখন শিয়াল মনে মনে খুব গর্ব করতে লাগল। সে ভাবল, বনের সিংহও যখন তার সেবা করছে, তখন আমি আর আমার নিজ জাতি এই শিয়ালগুলোকে কাছে থাকতে দেই কেন? এরা ছোট জাত। এরা জঙ্গি। এদের এ বন থেকে তাড়িয়ে দেয়াই উত্তম হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নিজ জাতিগুলো তাড়িয়ে দিলো। শিয়ালের দলে ছিল একটা বুড়ো শিয়াল, সে নবরাজার ব্যবহারে খুব অপমান বোধ করল। সে দলের সব শিয়ালকে ডেকে বলল- দেখ, আমাদের রাজা আমাদের জাত-ভাই হবে। বোধহয় কোনো কারণে এর গায়ের রঙ সবুজ হয়ে গেছে। এ যে আমাদের অপমান করে তাড়িয়ে দিলো, এর একটা বিহিত করতে হবে। শিয়াল দলের সবাই বলল, কিই-বা আমরা করতে পারি। একে তো রাজা, তার ওপর বনের বড় বড় পশুরাও এর সেবা করছে। আমরা কি করে এর বিহিত করব?
বুড়ো শিয়াল বলল, মূল কথা হলো এই রাজা শিয়াল কি না- আমরা তাই পরখ করে দেখব। এসো আমরা সবাই একসাথে ডেকে উঠি। তখন সব শিয়াল একসঙ্গে হুয়াক্কা হুহুয়া হুয়া করে ডেকে উঠল। কথায় বলে ‘সব শিয়ালের এক রা! আর যায় কোথায়। জাত ভাইদের ডাক শুনে নতুন রাজা আর ঠিক থাকতে পারল না, সেও মনের ভুলে ডেকে উঠল হুয়াক্কা হু হুয়া হু হু।
তার পরিচয় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ড. কামাল হোসেনের ক্ষেত্রে এই গল্পটা কেমন খেটে যায় দেখুন। বঙ্গবন্দুর সংস্পর্শে এসে তার মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ার পরও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নেওয়ার কম চেষ্টা করেননি ড. কামাল। বিএনপি-জামায়াত ডাক দিতেই দৌড়ে গিয়ে সেখানে বসেছেন। তবে তিনি যে আসলে বঙ্গবন্ধুর লোক নন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের লোক ১৯৯০ সালের ওই ছবিটি তার প্রমাণ। আর, জামায়তের সঙ্গে তার হৃদ্যতা প্রমাণ করে দিয়েছে এবারের নির্বাচন। রক্তচোষার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশের রাজনীতির রক্ত পান করেন তিনি।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক রক্তচোষা ‘ড. কামাল হোসেন হইতে সাবধান’!
লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক