বাংলাদেশে চার সপ্তাহ

আব্দুর রহমান চৌধুরী

২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে পৌঁছলাম ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরে। ইমিগ্রেশন-কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সারতে অল্প সময়ই লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুটকেসগুলো এসে পড়লো। সকাল ৭টার মধ্যেই মালামাল নিয়ে বাসায় পৌঁছলাম। ভোর বেলা, তাই রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কম, সেজন্য হয়তো যানজট চোখে পড়েনি।
অপরাহ্নে উত্তরায় এক আত্মীয়ের বাসায় গেলাম। বারিধারা থেকে উত্তরায় যেতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগলো। পরের দিন বারিধারা থেকে মিরপুর গেলাম, সময় লাগলো মাত্র ত্রিশ মিনিট। অনেকের মতে, সকাল এগারোটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত রাস্তায় তেমন একটা যানজট হয় না। আবার রাত আটটার পরে যানজটের তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে। যে কয়দিন ঢাকায় ছিলাম, যানজটের এই প্যাটার্নটিকে স্মরণ রেখেই ঘোরাফেরার চেষ্টা করেছি।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে দুদক বনাম খালেদা জিয়ার মামলা চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে। মামলার রায় বেগম জিয়ার বিপক্ষে যাবে, এমন ধারণা থেকেই হয়তো নিজে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। দলীয় নেতা ও কর্মীদেরকে সহিংসতা বর্জন করে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও প্রতিবাদ জানাতে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারাগারে বেগম জিয়াকে ডিভিশন দিতে বিলম্ব করা ও তার জামিন উচ্চ আদালতে শুনানীতে সরকারের কোন ভূমিকা আছে কিনা- সে নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। হাইকোর্ট অবশেষে তার জামিন মঞ্জুর করলেও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট জামিনাদেশ স্থগিত করে দেয়। বেগম জিয়ার আশু কারামুক্তি এখন সুদূর পরাহত। তার বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলা সরকার সক্রিয় করেছে। কোন রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া আপাতত তার কারামুক্তির কোন সম্ভাবনা নেই।
বেগম জিয়ার অনুপস্থিতে দলের নেতৃত্ব কে বা কারা দিচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এক নেতা জানালেন- তারা স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন এবং ঘোষণা দেবার আগে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সম্মতি নিয়ে থাকেন। মোটকথা, দল এখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারেক রহমানের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল।
তারেক রহমান দলের তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের কাছে কতটুকু জনপ্রিয়- সে প্রশ্ন মূলতবি রেখেই বলা যায়, এ অবস্থা দলের কার্যক্রম ও পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল নয়। দলের শীর্ষ নেতাদের উচিত তাদের মধ্য থেকেই কাউকে অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে দলের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা করার এখন সুযোগ এসেছে। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দলকে পুনর্গঠন করা উচিত।
ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে দলকে যেমন পুর্নগঠিত করা যায় না, তেমনই কর্মীদের মধ্যেও কোন উৎসাহ জন্মায় না। এ পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন কেমন হবে- সে প্রশ্নে বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে কোন পরিষ্কার জবাব আসেনি। কেউ বলছেন- তাদের নেত্রীকে কারাগারে রেখে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না। আবার কেউ কেউ বলছেন- বেগম জিয়ার আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। নেতৃবৃন্দের অস্পষ্ট বক্তব্যে কর্মীমহলে বিভ্রান্তি ছড়াবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই একাধিক কারণে শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্য থেকে কাউকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।
বিএনপির এই দুর্যোগকালে সরকার যেমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তাদেরকে রাজধানীসহ কোথাও জনসভা করার অনুমতি দিচ্ছে না। এমনকি শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনেও পুলিশ বাধা দিচ্ছে। তাই বিএনপি কোন রাজনৈতিক কর্মকা-ই চালাতে পারছে না। সরকারের এহেন আচরণ কেবল অগতান্ত্রিক নয়, এতে জনসাধারণের সমর্থন ক্ষমতাসীন দল হারাতে যাচ্ছে।
বিএনপির অনেক নেতাকর্মী বেগম জিয়ার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করা মারাত্মক ভুল হয়েছিলো। তাদের মতে- সাধারণ নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে, বিশেষ করে গাজীপুর, সিলেট ও খুলনায় দলের প্রার্থী মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিএনপি অংশ নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ নিলে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হতে পারতো। বেগম জিয়া তার ছেলের পরামর্শে নির্বাচন থেকে বিরত থাকেন এবং দলের জন্য এক মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছেন। ২০১৫ সালের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনে অসংখ্য প্রাণহানী দলের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণœ করেছে। তাদের বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে অনেকেই মনে করেন ‘নির্বাচন বর্জন’ রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে না। পাকিস্তানি শাসনামলে ১৯৬২ সালে দলবিহীন নির্বাচনে বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তানে সাফল্যের পরিচয় দেয়। ১৯৬৫ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও বিরোধীদলগুলো অংশ নিয়েছিলো এবং পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে ৫০ জনের বেশি সদস্য বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আপোষহীন নেত্রীর পরিচিতি নিয়ে বেগম জিয়া অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, রাজনীতিতে আপোষ করাটাই স্বাভাবিক। দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনীতিবিদদের আপোষ করতে হয়। অপোষহীন রাজনীতি একগুঁয়েমির রাজনীতি, যা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস: বর্তমান দলীয় নেতৃত্বে আগামী নির্বাচন বিএনপি বয়কট করলে দলে ভাঙন দেখা দিতে পারে। সরকারের মদদে দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেবে। তাতে সরকার উপকৃত হবে। দলের যে অংশ নির্বাচন থেকে বিরত থাকবে, তা কালক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। গণতান্ত্রিক বিরোধী জোট আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। সরকার আরো স্বেচ্ছাচার হয়ে উঠবে ও সুশাসনের অবনতি হবে। দুর্নীতির প্রসার ঘটবে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পুরোদমে নির্বাচন প্রচারে নেমেছেন। বিরাট বিরাট জনসভায় প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণকে আবারও নৌকা প্রতীকে ভোট দেবার আহ্বান জানাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ জনসাধারণের কাছে ভোট চাইতেই পারেন। তবে বিরোধীদলকে কোন সুযোগ ও পরিসর না দিয়ে একতরফা প্রচারণা কতোটুকু গণতান্ত্রিক আচরণ তা একটু ভেবে দেখা দরকার। ক্ষমতাসীন দল গায়ের জোরে আবারো একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পুনর্নির্বাচিত হতে পারবেন। কিন্তু এর পরিণতিতে দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে, তা তাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ও তার দল অতীতে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাদের হাতেই আবার গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হোক, নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না। অতীতের ভুলভ্রান্তি ও দুঃশাসনের জন্য বিরোধী দল গত দশ বছর যাবত মাশুল দিয়ে যাচ্ছে। যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা তো অনাগতকাল ক্ষমতায় থাকবে না। তাই ক্ষমতাসীনদের আচরণ সংযত ও গণতান্ত্রিক হওয়া একান্তই কাম্য।
অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন, বস্ত্রশিল্পের প্রসার, রফতানি আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, জনসংখ্যা হ্রাস, জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সরকার অবশ্যই কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। তবে উন্নয়নের এই পর্যায় এক ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই পরিণতি। উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতির যে প্রশার ঘটেছে, তাতে মনে হচ্ছে দুর্নীতিদমন কমিশন সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কেবল ব্যাংক খাতেই এক লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এবং এর মধ্যে ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে তারল্য সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সুদের হার বৃদ্ধি করেছে এবং তা ১০% অতিক্রম করেছে। অবশ্য বিগত কয়েক বছর সরকার কিছুটা চাপ সৃষ্টি করে সুদের হার ৫% থেকে ৬% অস্বাভাবিক হারে রেখেছিলো। তা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। কোন কোন বেসরকারি ব্যাংক ১৫% থেকে ২০% ঋণের সুদ নিচ্ছে। সুদের হার বৃদ্ধি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে ও বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।
অনেকের মতে, ব্যাংকিং সেক্টরের অপব্যহার মোকাবেলায় অর্থ মন্ত্রণালয় যথোপযুক্ত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ঢাকা শহরে চাঁদাবাজির কথা এখন আর কোন আলোচনার বিষয় নয়। গত কয়েক বছর এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে কিন্তু কোন প্রতিকার হয়নি। এটি অনেকের মতে একরকম বৈধতা পেয়ে গেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখলাম, ঢাকা শহরে প্রতিদিন চাঁদাবাজির মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা আদায় হয়। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১,৮২৫ কোটি টাকা। এ টাকা যারা আদায় করে, তারাই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায় নাÑ প্রশাসনের অন্যান্য বাহিনী বা প্রভাবশালীদেরকেও নাকি দিতে হয়। তবে চাঁদাবাজি এখন আর শহরের মধ্যে সীমিত নেই। মহাসড়কে প্রকাশ্য দিবালোকে পণ্যবাহী ট্রাক চালকদের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। প্রশ্ন উঠেছেÑ একটি নির্বাচিত সরকার কেনো এসব অপরাধ দমন করতে ব্যর্থ হচ্ছে? অনেকের মতে, সরকার গত নির্বাচনের পর থেকে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এর পরিণতিতেই সমাজে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছেÑ রাজনৈতিক শক্তির অবর্তমানে।
লেখক : জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা।