প্রশ্ন মিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ আসলে কার হাতে? এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে অনেক কথার পর। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয় ৫ বছর অন্তর অন্তর; কিন্তু নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলে কথা, বাহাস-বিতর্ক চলে সারা বছর সব সময়। ৩৬৫ দিন, ১২ মাস, ৬ ঋতুর বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠ গরম থাকে মূলত নির্বাচনকে ঘিরেই। ভেতরে ভেতরে, রাজনীতিবিদদের কথায় কথায় চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বয়ান থাকলেও পাবলিকের সামনে নির্বাচনী কথাবার্তাই গুরুত্ব পায়। আর নির্বাচন যত এগিয়ে যেতে থাকে, মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উত্তাপও তত বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে এখন সেই তাপ বাড়তে শুরু করেছে নির্বাচন সামনে বলে। হিসাব মতে, সবকিছু ঠিকঠাক চললে ২০১৮ সালের একেবারে শেষ প্রান্তে অথবা ২০১৯-এর শুরুতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। সে হিসাবে কোনো দলের হাতেই তেমন একটা সময় নেই। তাই তাদের কথাবার্তায় নির্বাচনের উত্তাপ। এ ছাড়া বিভিন্ন পরিমাপযন্ত্রেও নির্বাচনের আগমনী বার্তা। বিভিন্ন দলের মধ্যে নির্বাচনী তোড়জোড় এবং প্রস্তুতিও লক্ষ করা যাবে একটু মনোযোগ দিলেই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপও শুরু হয়েছে। আর কোনো দলের নেতা-নেত্রী তেমন সরাসরি কোথাও দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু না করলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দলের পক্ষে ভোট চাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র এবং তার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও আওয়ামী লীগকে আরও ১৫-২০ বছর ক্ষমতায় রাখতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব যে নির্বাচন কমিশনের, নতুন করে সেই কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছেন সাবেক সচিব কে এম নুরুল হুদা। তাকে নিয়ে শুরুতে আওয়ামী ঘরানার লোক হিসেবে যে অভিযোগ উঠেছিল, এখন সে অভিযোগ আর শোনা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ নিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা শেষ করেছেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে ইলেকশন কমিশনের। এসব আলোচনা থেকে বাংলাদেশের মানুষ কোনো তাপের আঁচ পায়নি। মানুষ ধরেই নিয়েছে, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদের মতো এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে উত্তাপ ছড়াবে না। জ্বালাও-পোড়াও হবে না। আগুনে বোমায় মানুষ মরবে না। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কেউ যন্ত্রণায় ছটফট করবে না। স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীরা দুর্ভোগে, দুর্বিপাকে পড়বে না পরীক্ষা-পড়াশোনা নিয়ে। কিন্তু কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন হওয়ার পর সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে জাতিকে যতটা আশাবাদী হতে দেখা গিয়েছিল, সময় যত গড়াচ্ছে, দেশের নাগরিক সমাজকে তত হতাশায় আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনী আকাশের সূর্য গাঢ় কালো মেঘে ঢাকা পড়তে শুরু করেছে। নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে শঙ্কা বাড়ছে। এই শঙ্কা নানাবিধ কারণে প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। যার ফলস্বরূপ জনগণ দেখেছে জ্বালাও-পোড়াও, আগুনে বোমায় মানুষের মৃত্যু। অন্যদিকে ওই নির্বাচনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাসে গণতন্ত্রের জন্য বাকশালের পর আরেকটি কালো দিবসের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতেও দেখেছে। ওই নির্বাচনে গণতন্ত্রের মুখে কালি ঢেলে দিয়ে ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটেই সাংসদদের নির্বাচিত হতে দেখা যায়। মনে হচ্ছিল এবার ওই ইস্যুটা অত জোরদারভাবে দেখা যাবে না। সহায়ক সরকার অথবা নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে বিরোধী দল, বিশেষ করে রাজপথের বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। কিন্তু না, দিন যত যাচ্ছে জনগণের সেই আশাবাদ ফিকে হতে দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আরও কিছু নতুন জটিলতাও দেখা দিচ্ছে সামনে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট গ্রহণ এবং নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সবার মধ্যেই প্রবল। সম্প্রতি শেষোক্ত দুটি বিষয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনেই বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বিতর্ক এবং বিরোধ কী রূপ নেয় এবং কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা নিয়ে শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের দিক থেকে উত্তাপের আঁচ ততটা না পাওয়া গেলেও জনগণ অন্য দিক থেকে যে ঝড়ের আভাস পাচ্ছে, তাতে কেবল জনগণের উৎকণ্ঠাই বাড়ছে না, ক্ষমতাসীনদের কপালে দুশ্চিন্তার কুঞ্চনও লক্ষ করা যাচ্ছে। অবশ্য বিরোধী দল বিশেষ করে প্রধান স্টেক হোল্ডার বিএনপি দ্বিধান্বিত ওই সব আভাস-ইঙ্গিতে আদৌ আস্থা রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। এর বাইরে আরও আছে বাইরের শক্তির খেলা। সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্নটি খুবই গম্ভীর যে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ আসলে কার হাতে? সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। খোদ নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই মতানৈক্য ও মতবিরোধ ইভিএম ব্যবহার ও সেনা মোতায়েন নিয়ে। রাজনৈতিক দলের বাইরে যে ঝড়ের আভাস, দেশের মানুষ তার প্রথম সংকেত অনুভব করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে কেন্দ্র করে। এস কে সিনহাকে অনেক আশা-ভরসা নিয়ে অনেক হিসাব কষেই প্রধান বিচারপতির আসনে বসিয়েছিলেন শাসক গোষ্ঠী। চলছিলও তাদের হিসাবমতোই। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন ঝড় উঠল সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে। আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দেন উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ পার্লামেন্টের হাতে নয়, থাকবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। আওয়ামী লীগের সাজানো বাগানে প্রথম ঝড়ের ঝাপটা। তবে তার চেয়েও বড় কালবোশেখি ঝড়ের জন্ম দিয়ে আওয়ামী লীগ ঘরের শত্রু বিভীষণ প্রধান বিচারপতিকে দেশছাড়া করে। ‘সিনহা-ঝড়’ থামতে না থামতেই নতুন করে আগুনে ঘি ঢেলে দেন সিইসি নুরুল হুদা এবং আইজিপি শহীদুল হক। শহীদুল হক যাকে বলে আগ বাড়িয়ে কথা বলা-তেমনিভাবে খালেদা জিয়ার প্রশংসা করে আওয়ামী লীগের অনেকের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেন। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাও যেভাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন, তাতে আওয়ামী লীগের কাঁপন দিয়ে জ্বর আসার অবস্থা। গত ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। সেখানে সিইসি হুদা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রশংসার ঝাঁপি খুলে বসেন। তিনি বলে বসেন, জিয়ার হাত দিয়েই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিএনপি সরকার দেশে বহুবিদ উন্নয়নও করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে বিএনপি সরকার প্রকৃত নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে। সরকারি ধামাধরা হিসেবে পরিচিত সিইসির এহেন প্রশংসা আওয়ামী লীগকে ভাবিয়ে তোলে। সিইসির জিয়া সম্পর্কে এহেন বক্তব্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিমূলেই আঘাত হানে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি জিয়াকে গণতন্ত্র হত্যাকারী এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বলে প্রতিপন্ন করে। তবে সিইসির এহেন মন্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়, যা কেবল আওয়ামী লীগকেই ভীত করে তোলে না, বিএনপিকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, সিইসি সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ব্ল্যাকমেইল করছে। কেউ আবার মনে করেন, তিনি বিদেশি শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। আওয়ামী লীগের আরেক দল মনে করছে, সিইসির কথায় তার কূটনৈতিক চাপের আভাস মেলে। তিনি নিশ্চয় আওয়ামী লীগের প্রতি এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না ১৫ আগস্টের মতো। সিইসি হুদা হয়তো বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য তাদের গুড হিউমারে রাখছেন। আর এই বিষয়টিই বিএনপিকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে তারা সিইসি হুদাকে বিশ্বাস করবে কি করবে না। এসব পরিস্থিতি সামনে রেখে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে বাংলাদেশে নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কার হাতে? সিইসির হাতে, সরকারের হাতে, না বিদেশি শক্তির হাতে? নাকি প্রজাতন্ত্রের মালিক যারা সেই জনগণের হাতে? রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি/মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী। আসলেই কে যে হাসছে, তা আওয়ামী লীগই বলতে পারবে। জনতার শক্তিতে যারা বিশ্বাস রাখে তারা নিশ্চিত, শেষ বিচারে মানুষেরই বিজয় হবে। আজ কৌশল জিতছে, কাল কারচুপি জিতবে। তৃতীয় দিন হয়তো পেশিশক্তি, মাস্তানি এবং সন্ত্রাসী শক্তির জয় হবে। কিন্তু দেরিতে হলেও গৃহস্থের একদিন তো আসতেই হবে। আজ যতই ভোটের অধিকার থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা হোক, ভোটের আসল মালিক তো জনতা। মালিক তো একদিন তার অধিকার ফিরে পাবেই। সেদিন সবারই সব জারিজুরি শেষ হয়ে যাবে। সেদিন যখন মানুষ তার অধিকার বঞ্চনার জবাব চাইবে, তখন কী উত্তর হবে আপনাদের! উত্তর দেওয়ার জন্য সেদিন তৈরি থাকতে হবে সবাইকে।
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্তাঙ্গন
- বিজ্ঞাপন -