বাংলাদেশ করোনার নতুন ঝুঁকিতে

নূরুল ইসলাম : গত ছয় মাস দেশে করোনা পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু বছর শেষে সেই স্বস্তির জায়গায় দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। করোনার অতিসংক্রমণশীল নতুন ধরন ওমিক্রনের একটি উপধরন বিএফ.৭ ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় দেশের নীতিনির্ধারকেরা চরম উদ্বিগ্ন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের সব প্রবেশপথে সতর্কতা জারি করেছে।
চীনে করোনার সংক্রমণ আবারও বেড়েছে। দেশটিতে করোনা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জোরদার করা হয়েছে। ধাক্কা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সে দেশের সরকারকে। রোগীর চাপে বেহাল হাসপাতালগুলো। মরদেহ সৎকারে বেগ পেতে হচ্ছে সৎকারকর্মীদের। এ অবস্থায় সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা দাবি করেছে, শুধু ঝেনজিয়াং প্রদেশেই দৈনিক ১০ লক্ষাধিক করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন (এনএইচসি) দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রকাশ করা বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, দেশটিতে প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে কয়েক লাখ মানুষ।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে পাশের দেশ ভারতেও এই উপধরনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, ব্রাজিল, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বিএফ.৭ নামের নতুন এই ধরন এ-যাবৎকালের সবচেয়ে অতিসংক্রমণশীল। ওমিক্রনের চেয়েও চারগুণ বেশি সংক্রামক। একজন রোগী একই সময় ১৮ জনকে সংক্রমিত করতে পারে, যা ওমিক্রনের আগের ধরনটি করতে পারত চারজনকে।
২৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চার চীনা নাগরিকের নমুনায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের নমুনায় ওমিক্রন বিএফ.৭ উপধরন রয়েছে কি না তা নিশ্চিত হতে আইইডিসিআরে নমুনা পাঠানো হয়েছে। এ যেন স্বস্তির পরিবেশে ফের আশঙ্কা।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশও নতুন উপধরনের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় সীমান্ত বন্ধ করাও সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে ২৫টি স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিয়মিত বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। চীনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। এসব পথেই যেকোনো সময় সংক্রমণটি দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা এবং সাবধানতা অবলম্বন করা না গেলে আবারও ডেল্টা ও ওমিক্রনের মতো অবস্থা হতে সময় নেবে না।
নতুন উপধরন বিএফ.৭-এর সংক্রমণ প্রতিরোধে কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পরামর্শ দিয়ে বলেছে, ফ্রন্ট লাইনার, ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব কোমরবিড রোগে (একাধিক রোগে আক্রান্ত) আক্রান্ত এবং ৬০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী সবাইকে দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ/চতুর্থ ডোজের টিকার চলমান ক্যাম্পেইনের আওতায় আনার ব্যাপারে সব ধরনের জনসংযোগ, প্রচার-প্রচারণা জোরদার করার ব্যবস্থা করতে হবে। আশঙ্কাজনক ব্যক্তি এবং কোমরবিড রোগে আক্রান্ত সবাইকে কোভিড ১৯-এর সব স্বাস্থ্যবিধি, যেমন মাস্ক পরা, হ্যান্ডস্যানিটাইজ করা ইত্যাদি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। পোর্ট অব এন্ট্রিগুলোতে, বিশেষ করে চীন, জাপান, কোরিয়া, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত যাত্রীদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ থাকলে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। দেশের সব কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালকে কোভিডের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত রাখতে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে সারা দেশের সব সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, নৌ, স্থল ও বিমানবন্দর বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের স্ক্রিনিং করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হচ্ছে। আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, চীনে বিএফ.৫-এর নতুন ধরন বিএফ.৭ শনাক্ত হয়েছে। ধরনটি ওমিক্রনের চেয়ে শক্তিশালী। কম সময়ে বেশি মানুষকে এই ধরন আক্রান্ত করতে পারে। যারা টিকা নেননি, তাদের জন্য এটা বেশি ভয়ংকর। তাই সবাইকে দ্রুত টিকা নিতে হবে। তিনি বলেন, এটা দেশে ঢুকে পড়লে জিরো থেকে হিরো হয়ে যেতে পারে এবং তাতে খুব বেশি সময় নেবে না। এর সবচেয়ে বড় ভয়ংকর দিক হচ্ছে, লক্ষণ উপসর্গহীন থাকে। যার কারণে শনাক্ত হওয়ার আগেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করলেই যে একে আটকে রাখা যাবে, তাও নয়। মানুষ যাতে বেশি অসুস্থ না হয়, আর মৃত্যু যেন না হয়, তাই মাস্ক পরা, টিকা নেওয়া, হাত ধোয়ার মতো ব্যক্তিগত সাবধানতা বেশি জরুরি।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জনস্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, আমরা এবার আর আগের মতো পরিস্থিতি দেখতে চাই না। আগের করোনার প্রতিটি ধরনের সময় সরকার আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে, সাবধানতা অবলম্বন করলে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া কিছুটা ‘ডিলে’ করা যেত। তাই সরকারকে এবার ‘প্রোঅ্যাকটিভ’ না হয়ে ‘রিঅ্যাকটিভ’ আচরণ করতে হবে। জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার আগেই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে।