বাংলাদেশ নিয়ে দুই পরাশক্তির রশি টানাটানি

ছোটকালে শোনা প্রবাদ। প্রায় সবারই জানা। তবু নানা প্রাসঙ্গিকতায় প্রবাদটির কথা এসে যায়। যেমন বাংলাদেশ নিয়ে এখন যে রশি টানাটানি শুরু হয়েছে বৃহৎ শক্তিগুলোর, তাতে বাংলাদেশের যে অবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবাদই মনে আসে প্রথম। প্রবাদটি হচ্ছে : ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়/ উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।’ লক্ষ করা যাচ্ছে, বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে ধরে রাখতে গিয়ে রীতিমতো রশি টানাটানি শুরু করে দিয়েছে আমেরিকা, ইউরোপ, চীন-ভারত, অন্যদিকে সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি মুসলিম দেশ।

পত্রপত্রিকায় এবং অন্যান্য নিউজ মিডিয়ায় এ রকম অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। চীন ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পাশে আছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারত এবং দূরবর্তী দেশ আমেরিকাও বসে নেই। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের কূটনীতির দৌড়ঝাঁপও বেড়ে গেছে। আর এই দৌড়ঝাঁপের বেশি অংশই খরচ হচ্ছে বাংলাদেশকে নিয়ে।

এদিকে বাইডেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছেন ওয়াশিংটনে। ১৪ হাজার মাইল দূরে এসেও তারা আলোচনা করছেন বাংলাদেশকে নিয়ে। যারা একসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নীরব বা নিরপেক্ষ থাকা দূরে থাক, বরং সরব সমর্থন দিয়ে শত্রুপক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারাও এখন বাংলাদেশকে নিয়ে টানাটানি করছে। আবার মুক্তিযুদ্ধে যারা নিঃস্বার্থ এবং নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিল, তাদের অনেককে এখন বাংলাদেশের বিপক্ষে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশকে নিয়ে বৃহৎ শক্তিসমূহের এই টানাহেঁচড়ার কারণ বাংলাদেশের সম্পদের কোনো আকর্ষণ বা বাংলাদেশের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা নয়; এর কারণ মূলতঃ ভূ-রাজনীতি। সব শক্তির কাছে বাংলাদেশের অবস্থানটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বের কারণে এই রশি টানাটানি।
এই টানাটানি আরও বৃদ্ধি এবং জোরদার হয়েছে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে। যদিও এ কথা কেউই স্বীকার করতে চায় না, তারা কেউ স্বার্থ নিয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন জানাতে চায়। কিন্তু স্বার্থ ছাড়া বৃহৎ কোনো শক্তি যে এক পাও নড়ে না, এ সত্য সবাই জানে। ভূ-রাজনীতিতে সবার কাছে বাংলাদেশের কদর বাড়ছে যে তার অবস্থানগত কারণে, তাও শতভাগ সত্য নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ, রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা অর্জন এবং ভৌগোলিক দিক থেকেও গুরুত্ব বাড়ছে বিশ্ব পরিসরে।

উপরে যতটুকু বলা হয়েছে, তার সমর্থন মিলবে ঠিকানার গত ২১ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত লিড নিউজে। নিউজটির শিরোনাম : ‘বাংলাদেশ নিয়ে মোদির বিশেষ ফয়সালা’। সংবাদটি এ রকম : ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে। একই সময়ে চীন সফরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফরে অনেক বার্তা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের মাঝেও চলমান ও আগামী দিনের আঞ্চলিক রাজনীতির অনেক রসদ। বিশ্ব রাজনীতির এই সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চায় চীন ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলাতে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ভারসাম্যের রাজনীতি কতটা সফল হবে এবং কত দিন পর্যন্ত তিনি তা সফলভাবে চালিয়ে যেতে পারবেনÑসেটাই প্রশ্ন। মনে হয়, এখানে রাজনীতি করে খুব লাভ হবে না। তার চেয়ে বরং যদি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এই নীতি মেনে চলা যায়, সেখানেই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।