বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে মমতার কাঁটা

মোস্তফা কামাল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘দিদি’ বলে ডাকেন। শেখ হাসিনাকে নিয়ে তিনি একাধিক কবিতাও লিখেছেন। একবার বাংলাদেশ বইমেলা উদ্বোধন করতে শেখ হাসিনা কলকাতা সফরে গিয়েছিলেন। সে সময় আমিও তার সফর কাভার করতে সেখানে গিয়েছিলাম। তখন দেখেছি, শেখ হাসিনাকে নিয়ে মমতার লেখা একটি কবিতা ফ্রেমে বাঁধাই করে তিনি নিজেই নিয়ে এসেছেন। আমরা কয়েকজন উৎসাহী সাংবাদিক তার সেই কবিতা শুনতে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পড়ে শোনালেন। খুব মমতা দিয়েই তিনি সেই কবিতা লিখেছেন বলে মনে হলো।
আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবেই বাংলাদেশের পাশে রয়েছেন। এক সময় মমতাকেও বাংলাদেশের বন্ধু ভাবা হতো। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সময় মমতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ। কিন্তু খুব অল্পসময়ের ব্যবধানেই বাঙালিদের সেই ভুল ভাঙল। স্বরূপে আবির্ভূত হলেন মমতা। বোঝালেন, নিজের স্বার্থের বাইরে তিনি কিছুই করেন না।
জ্যোতি বসুর জন্ম বাংলাদেশে হলেও তিনি পুরোপুরি ভারতীয়ই ছিলেন। তিনি নিজেও ভারতের স্বার্থের বাইরে কিছুই করেননি। কিন্তু আমাদের মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের পাশে সব সময়ই তিনি মমতার হাত বাড়িয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তিনি সহযোগিতা না করলে ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিই সম্ভব হতো না। তিনি তখন একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেন। শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যেÑ আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আমি আপনার জন্য কিছু করব। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। তিনি কি ভারতের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সেই চুক্তি করিয়েছিলেন? বরং গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক ব্যাপকভাবে গতি পেয়েছিল।
একসময় ভারতে আশ্রয় নেয়া চাকমা শরণার্থীরা বাংলাদেশের অশান্তির কারণ ছিল। ভারতের সহায়তায় শান্তিচুক্তি করে শরণার্থীদের ফিরিয়ে এনেছিল শেখ হাসিনা সরকার। একইভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী-সন্ত্রাসীদের দমন করতে শেখ হাসিনা ভারতকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার দায়িত্বশীল সহযোগিতাকে ভারতীয় জনগণ কৃতজ্ঞার সঙ্গে স্মরণ করে। আমরা যেমন একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে সহযোগিতার জন্য ভারতের জনগণ এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞ; এখনো আমরা শ্রদ্ধাভরে সেই ভূমিকার কথা স্মরণ করি। তখন ভারত সহযোগিতা না করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়তো আরো দীর্ঘতর হতো।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ নিকট ও বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক সময় সম্পর্ক শীতল হয়েছে। কখনো কখনো সম্পর্ক তলানিতেও ঠেকেছে। বিশেষ করে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী-সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে কিংবা বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের ভারতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়াকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্কে অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। কখনো কখনো সেই সম্পর্কে ফাটলও ধরেছে। আবার উভয় দেশের সরকারই সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছে। কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক পর্যায়ে সফর-বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত। স্বাধীনতার পর সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সমস্যাটি ঝুলে ছিল দীর্ঘদিন। সঙ্গত কারণেই ছিটমহল বিনিময়ও হচ্ছিল না। দুই দেশের সমুদ্রসীমাও ছিল অমীমাংসিত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। এর পর থেকেই মূলত ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন মাত্রা পায়। শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু, বিশেষ করে সীমানা চিহ্নিতকরণ ও ছিটমহল বিনিময় সমস্যার সমাধান হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সাত হাজার একরের বেশি জমি লাভ করে। এতে বাংলাদেশের আয়তনও বেড়ে যায়। শেখ হাসিনার উদ্যোগেই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ইস্যুটির শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়। এ জন্য ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ।
তবে দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নেপথ্যে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকাস্থ ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। তিনি তখন ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিএসএম (বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-মিয়ানমার) ডেস্কের প্রধান। প্রতিবেশী দুই দেশের সমস্যা সমাধানে তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেন। এখনো দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে একান্ত বৈঠককালে তিনি উল্লেখ করেন, দুই দেশের সম্পর্ক স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত। তিনি আরো বলেন, দুই দেশের মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা নেই। এখন দুই দেশ পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করছে। দুই দেশের মানুষের জীবন-মানোন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে পরস্পরকে সহযোগিতা করছে। মানুষের যোগাযোগ বাড়াতে উভয় দেশ কাজ করে যাচ্ছে।
আমিও মনে করি, দুই দেশের সম্পর্কে বড় কোনো সমস্যা নেই। হাইকমিশনারের বক্তব্যের সঙ্গে আরো কিছু বিষয় বলতে চাই। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। তা না হলে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি থেকেই যাবে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ অনেক বেড়েছে। আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে। সে ক্ষেত্রে ভিসাব্যবস্থা আরো শিথিল এবং সড়ক যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
আমার ধারণা, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ইস্যুটি এখন গলার কাঁটা। আর এটি জিইয়ে রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি সহযোগিতার হাত বাড়ালে কংগ্রেসের আমলেই চুক্তিটি হয়ে যেত। সব কিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও শেষ মুহূর্তে মমতা বেঁকে বসায় চুক্তিটি সই করা যায়নি।
আমার মনে আছে, ২০১১ সালে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। ওই সময় তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছিল। চুক্তির খসড়াও দুই পক্ষ থেকে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ভারতের দিক থেকে বলা হয়েছিল, চুক্তিতে মমতার সায় আছে এবং তিনিও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন। মনমোহন সিং যথাসময়ে ঢাকায় এসেছেন। মমতা ব্যানার্জির জন্য অপেক্ষা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মমতা ঢাকা সফর বাতিল করলেন। এতে শুধু মনমোহন সিংই বিব্রত হননি, ভারত সরকারও বিব্রত হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই মমতার সমালোচনা করা হয়।
পরবর্তীকালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে পরিবর্তন আসে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি। তিনিও বাংলাদেশের ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক। তিনি ইতিবাচক না হলে আজও দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যার কোনো কিনারা হতো না। তিস্তার ব্যাপারেও তিনি বরাবরই ইতিবাচক ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে চুক্তি সই করবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়েই তিনি এই চুক্তি সই করবেন।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এলেন। কথা ছিল এই সফরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হবে। মমতাও ঢাকায় এলেন। ঢাকার মাটিতে পা রেখে মোদি তিস্তার ব্যাপারে আবারও আশ্বাস দিলেন। ঢাকায় মমতাকেও বেশ সমাদর করা হলো। শেখ হাসিনা পরম মমতায় মমতাকে বুকে টেনে নিলেন। কিন্তু মমতার হৃদয় গলল না। এবারও তিনি শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলেন। এতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভীষণভাবে বিব্রত হন। কিন্তু এতেও মমতার যেন কিছু আসে যায় না।
তার পরও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার থেমে যায়নি। মমতাকে রাজি করাতে মোদি একাধিকবার তার কাছে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন। নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মমতার মন গলেনি। তিনি তার অবস্থানেই অনড় আছেন। এখন তিনি বলছেন, ভোটের বছরে নরেন্দ্র মোদিকে ক্রেডিট নিতে দেবেন না তিনি।
নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন, তখন তো মমতার বেশ দহরম-মহরম ছিল তার সঙ্গে। তখনো তো তিস্তার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারতেন। তখন কেন আপত্তি করেছিলেন? দুই দেশের সম্পর্ক ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাকÑ এটা কি তিনি চান না?
ব্যাপারটা সবার কাছেই পরিষ্কার যে তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন। মমতাকে রাজি করাতে কেন্দ্রীয় সরকার অনেক চেষ্টা-তদবির করে আসছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতায় ঘাটতি আছে। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। মমতাই নানা ছুতায় তিস্তার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
এ বছর উভয় দেশের সরকারেরই ভোটের বছর। এ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি সই হলে উভয় সরকারই এর রাজনৈতিক সুবিধা পাবে। এই সুবিধা দিতে কিছুতেই রাজি নন মমতা। উল্টো তিনি বিজেপি হটাতে জোট বাঁধতে যাচ্ছেন সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়!

বিগত ৯ বছরে আমরা যা দেখলাম, তাতে স্পষ্টভাবে বলা যায়, মমতার বাধার কারণেই তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ঝুলে আছে। বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সীমান্তে ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে যেমন অস্বস্তিতে ফেলেছে, মমতাও তাই। তিনিই এখন দুই দেশের সম্পর্কে ‘কাঁটা’ হয়ে আছেন। উভয় দেশের সরকারকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।