বাংলাদেশ যখন জিতে, তখন সবকিছু জিতে

একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে প্রবাস-স্বদেশ সবখানে। একেক পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে একেক রকম। ঠিকানার শিরোনাম : ‘জিতেছে রাজনীতি, হেরেছে বাংলাদেশ!’ ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়েছে ‘ওয়াশিংটনে আ.লীগ-বিএনপির শোডাউন, সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ৩’।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সয়লাব নিউজটিতে। দুই পক্ষের খেলা হলে তো এক পক্ষকে হারতেই হবে। কিন্তু ওয়াশিংটনে যে খেলা হয়েছে, সেখানে হেরেছে বাংলাদেশ। খেলায় বিজয়ী পক্ষের আনন্দ আছে। এখানে খেলা হয়েছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে। তাই তো আনন্দ নেই। কেবলই বিষাদ।

বাংলাদেশে যখন নির্বাচন, তখন বিএনপি হারলে আওয়ামী লীগ আনন্দ করে, উল্লাস করে। বিএনপি জিতলেও তারা আনন্দ-উল্লাস করে। সঙ্গে দলের বাইরেও লক্ষ-কোটি মানুষ, যারা যে দলের সমর্থক, এমনকি নির্দলীয় অনেকেই আনন্দ পায়। অনেকের ভালো লাগে। কারও মন খারাপ হয়।
দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দেশের মান-মর্যাদা নিয়ে খেলা হওয়ায় কেউ হারেনি। হেরে গেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৭১-এ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জিতেছিল। ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে সমর্থন করে হেরেছিল। তাই ওয়াশিংটনে এসে বাংলাদেশিদের হাতেই বাংলাদেশের পরাজয় বড়ই বেদনাদায়ক। লজ্জা দিতে এসে লজ্জা পেয়ে যাওয়া।

প্রথম পাতায় দুটি ছবি, বামে আহত যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে কেউ একজন টেনে তুলছেন। আর ডানে ঐতিহাসিক পদ্মা সেতুর ছবি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের হাতে। যিনি সসম্মানে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

যিনি পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু না হতেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থের জোগান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সে সময় শেখ হাসিনা কোনো দ্বিধা না করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে কারণেই সবাই শেখ হাসিনার এই সফরকে হাই প্রোফাইল এবং মর্যাদার সফর বলে গণ্য করেছেন। অথচ সেই সফরটাই হয়ে থাকল কালিমালিপ্ত। সংঘর্ষে মহিলাসহ উভয় দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন।

পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতারও করে। পরে অবশ্য দলীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

গত ১ মে এ ঘটনা ঘটে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সামনে। কর্মসূচি দুই দল আগেই ঘোষণা করে রেখেছিল। আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা সমাবেশ’। বিএনপির ‘প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সমাবেশ’। এ রকম বিক্ষোভ সমাবেশ আওয়ামী লীগের এবং বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। সবকিছুর মধ্যে দেশের রাজনীতি খুঁজে পাওয়া যাবে।

নিউইয়র্কের মানুষ এ রকম হই-হট্টগোল আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে মাঝেমধ্যেই দেখে থাকেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তির দিকে লক্ষ থাকে না। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে আসেন, তখন কোনো বিরোধী দলই তাকে বাংলাদেশের একজন সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী বলে গণ্য করেন না। মনে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন না, তিনি জাতিসংঘের সম্মানিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশ দলের নেতা হিসেবে যোগ দিয়েছেন অধিবেশনে।

সেসব দেখে কে? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান দেখিয়ে লাভ নেই। বরং অসম্মান দেখাতে পারলে লাভের সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিরোধীরাও দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখেন না। দেখেন প্রতিপক্ষ দলের নেতা বা নেত্রী হিসেবে। যেকোনো মন্তব্য করতেও কারও কিছু বাধে না। যে যত বেশি খিস্তিখেউড় করতে পারবে, দলীয়ভাবে তার মর্যাদা তত বেশি বৃদ্ধি পাবে। ৫১ বছর কেটে গেল স্বাধীনতা অর্জনের পর।
জানি না আর কত দিন লাগবে এই রুচির পরিবর্তন হতে। যারা রুচিমান, যারা বিবেকবান দেশপ্রেমিক মানুষ, তারা দেশের হোক, প্রবাসের হোক, দলের হোক না হোক-কেউই রাজনীতির নামে এ ধরনের নোংরামি সমর্থন করবেন না। রাজনীতি করার অধিকার সবার থাকলেও রাজনীতির নামে দেশের অমর্যাদা করার অধিকার কারও নেই। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ যখন হারে, তখন সবকিছুই হারে। বাংলাদেশের মানুষকে যেন আর কখনো এ রকম হার দেখতে না হয়।