সাঈদ- উর রব: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এই নামটি উচ্চারণই যথেষ্ট বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল সুনীলকে জানার জন্য। যারা বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে সামান্যতম খোঁজ- খবর রাখেন তাদের আর খুব বেশি তথ্য দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। পঞ্চাশের দশক থেকে কলম ধরেছেন। এখনো বিরামহীন কী উপন্যাসে, কী কবিতায় কিংবা গল্পে। সব শাখাতেই স্বচ্ছন্দ। আজকের বাংলা সাহিত্য যে উচ্চতায় আসীন, সেখানে নিতে সুনীলের আবদান অগ্রজের। বাংলা সাহিত্যের সেই অতি আবশ্যক এবং নান্দনিক নাম সুনীল এখন আমেরিকার বস্টনে নিজ সন্তানের কাছে অবকাশ কাটাচ্ছেন। সেখানেই তার সঙ্গে বসে এই কথামালার আসর। মন খুলে কথা বললেন। তাঁর সাহিত্যের রসভান্ডার উজাড় করে দেন তাঁর অসংখ্য ভক্ত পাঠকের তৃষিত হৃদয়ে ভাসিয়ে দিতে। সেই অমৃতসম কথা মালায় উঠে আসে নিজের কবিতা, উপন্যাস, ব্যক্তিগত ভাল লাগা- না লাগা, দুই বাংলার গদ্য- পদ্য, বিশ্ব সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের অতীত- বর্তমান এবং আরো কত শত জানা- অজানা তথ্য নিয়ে এক বিস্ময় সুনীল। পাঠকদের সামনে সেই বিস্ময়ের দ্বার উন্মোচন করে দেয়া হলো এই সাক্ষাতকারের মধ্য দিয়ে।
ঠিকানা: কেমন আছেন এই প্রবাস ভূমে?
সুনীল: আমার তো প্রতি বছরই আসা হয় কোন না কোন কারণে। ভালই লাগছে। এবার একটু শীতকালে এসে পড়েছি। সামারে আমার কাছে ভাল লাগে। আমি গতবারও ছিলাম সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। শীত ছাড়া আর সবই ভাল।
ঠিকানা: আমরা জানি, কবি- সাহিত্যিকরা স্বদেশে কিংবা প্রবাসে যেখানেই থাকুন সেখানেই তারা নতুন নতুন সৃষ্টি নিয়ে মেতে থাকেন। তা এখন আপনি কী নিয়ে কাজ করছেন- কবিতা, গল্প না উপন্যাস?
সুনীল: আমি আসলে প্রত্যেক বারই যখন আসি আমার এখানে কিছু লেখার চাপ থাকে। সোজা কথা লিখতে হয়। পাঠাতে হয় দেশে। এবার আমি দেশে অনেকগুলো লেখা শেষ করে তারপরে এসেছি। বলতে গেলে আমি এবার ছুটি কাটাতে এসেছি। আপনারা জানেন বাংলাদেশে কালি ও কলম নামে একটা কাগজ আছে। সেখানে আমি একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি ’মানুষ মানুষ’ নামে। সেই লেখাটাই লিখছি ঢাকা পাঠাবার জন্য। এর পাশাপাশি কিছু কবিতা লিখছি। বড় কিছু লিখছি না।
ঠিকানা: এক সময় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামেই আপনার অধিক পরিচিতি ছিলো। এখন তা অনেকটাই ঔপন্যাসিকের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে- এমনটা কেন হলো?
সুনীল: এর একটা কারণ আছে। এক সময় খুব কবিতা লিখতাম। এখন কবিতা খুব একটা লিখি না। গদ্য লিখি। গদ্য অনেক বড় হয়। আর এই গদ্যের আড়ালেই কবিতা চাপা পড়ে যায়। গদ্য লিখা শুরুর পিছনে আমেরিকার একটা ব্যাপার আছে। আর ব্যাপারটি হচ্ছে আমি খুব অল্প বয়সে আমেরিকায় এসেছিলাম ১৯৬৩ সালে। আপনাদের জানবার কথা না। তখন আমার বয়স অল্প, বিয়ে করিনি। থেকে যাওয়া খুব সহজ ছিলো। কোন সমস্যা ছিলো না। আমি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে এসেছিলাম ইন্টারন্যশনাল রাইটিং প্রোগামে। তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। তখন আমার উপার্জন ভাল ছিলো। আমার একজন ফরাসী বান্ধবী ছিলো। তবুও আমি চলে গেলাম কেন?
ঠিকানা: চলে গেলেন কেন?
সুনীল: আমার মাথার মধ্যে একটা পোকা ঢুকেছিলো। আর সেটি হলো বাংলা ভাষায় লিখতে হবে। বাংলা ভাষায় লিখতে ভাল লাগে। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে আনন্দ পাই। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে যদি বাংলা ভাষায় লিখতে হয় তাহলে যেখানকার মানুষ বাংলায় কথা বলে আমাকে সেখানে যেতে হবে। এই দেশে বসে আমি বাংলায় লিখতে পারবো না। অনেকে জোর করে আমাকে এখানে রাখতে চেয়েছিলো, আমি কারো কথা শুনিনি, দেশে ফিরে যাই। ফিরে যাবার পর তো আমি বেকার। চাকরি- বাকরি যা ছিলো তা ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। আমি যখন বেকার তখন খাওয়াবে কে? আর যা এখানে উপার্জন করেছিলাম তা যাওয়ার সময় সব টাকা খরচ করে ফেলেছিলাম। আমি তখনই ভেবেছিলাম আমার মনে হয় আর আসা হবে না। তাই ভ্রমণে বের হলাম। আমি ভ্রমণ করতে ভালবাসি। আমি প্যারিসে গেলাম, ইংল্যান্ডে নিমন্ত্রণ ছিলো, সুইজারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে গেলাম। এই দেশগুলো আমি ছোট বেলা থেকেই কল্পনায় দেখতাম। এই সব দেশগুলো ঘুরতে ঘুরতে আমি যখন ইজিপ্ট-এ গেলাম এবং হোটেলে বসে দেখলাম আমার পকেটে আর মাত্র ১০ ডলার আছে। ভাগ্য ভাল টিকেটটা ছিলো রাউন্ড ট্রিপ- যে কোন জায়গায় নামা যেত। এভাবে চলতে চলতে যখন দেখলাম আর পয়সা নেই তখন চলে গেলাম কলকাতায়। কলকাতায় ফিরে গিয়ে খবরের কাগজে গদ্য লিখতে শুরু করলাম। কারণ কবিতা লিখলে টাকা দেয় না। খবরের কাগজে নানা ছদ্মনামে ফিচার লিখতাম। তারপরে উপন্যাস এবং গল্প লিখতে শুরু করলাম। তাও ২/১ খানা লিখার পর আর নাও লিখতে পারতাম। কিন্তু একটা উপন্যাস সত্যজিৎ রায়ের পছন্দ হলো, তিনি সিনেমা করবেন বললেন। তখন সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বজোড়া নাম। তার আগে তিনি বড় বড় লেখকদের ক্লাসিক্যাল কাহিনী নিয়ে ছবি করেছেন। হঠাৎ আমার একটা গল্প নিয়ে তিনি ছবি বানাবেন তখন সকলের কৌতূহল হলো- আমার ব্যাপারে, ছেলেটা কেরে বাবা? কবি হিসাবে আমাকে কম লোকেই জানতো। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের কারণে অনেক লোকেই জেনে গেল আমাকে, আর তিনি যে ছবিটা করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেই ছবিটার নাম ছিলো- ’অরণ্যের দিন রাত্রি’। তারপরে আমি আরেকটা ছোট উপন্যাস লিখলাম ’প্রতিদ্বন্দ্বী’। সেটাও সত্যজিৎ রায় সিনেমা করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের মত মানুষ আমার উপন্যাস নিয়ে পর পর দুটো সিনেমা করার পর কাগজের সম্পাদকরা বললেন, শুধু কবিতা লিখলে চলবে না। আপনাকে গল্প দিতে হবে, উপন্যাস দিতে হবে। যে কারণে আমি উপন্যাসের জগতে চলে গেলাম। প্রথম প্রথম আমি যে উপন্যাসগুলো লিখতাম সেগুলো আমি আমার জীবন নিয়ে লিখতাম। নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা। জ্যাকপেলওয়ার্ড নামের একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিকের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো এবং বন্ধুত্ব হয়েছিলো। আমেরিকায় আমি যখন ছিলাম তখন অনেক আধুনিক লেখকের সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিলো। এর মধ্যে এলেনগিনসবার্গ হচ্ছেন বিশ্ববিখ্যাত কবি। তার সাথে আমি তার নিউইয়র্কের বাড়িতেও ছিলাম। আরেক জন বিখ্যাত লেখক ছিলেন জ্যাকটেইলর। তার উপন্যাস ’অন দা রোড’ খুব নাম করেছিলো। জ্যাকটেইলর একদিন আমাকে কথায় কথায় বলেছিলো জানতো উপন্যাস লেখা খুব সোজা। আমি বললাম তাই নাকি। আমিতো জানিই না। সে তখন আমাকে বললো তুমি তোমার জীবনের যে কোন একটা দিন ঠিক কর। যেমন তুমি দুই মার্চ কী করেছো চিন্তা করো। ধর তুমি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছ। ওখান থেকেই শুরু কর উপন্যাস। তুমি বাসে উঠলে, বাস কোথায় গেল এবং কী ভাবে গেল- এইগুলো লিখতে লিখতে দেখবে গল্প লেখা হয়ে গেল। নিজের জীবনের খন্ড একটা অংশ লিখলে উপন্যাস হয়। আমাকে যখন খবরের কাগজে লিখতে হলো তখন ঐ উপদেশটা আমার মনে পড়ে গেল। তখন থেকেই আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখতাম। তারপর একটা সময় মনে হলো এর তো একটা সীমা আছে, যখন আমাকে খুব বেশি লিখতে হলো। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা আর কত লিখবো। লোকজনতো বিরক্ত হয়ে যাবে। সব তো একই রকম হয়ে যাবে। এরপর আমি পড়াশুনা করে ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লেখা শুরু করলাম। তার প্রথমটাই হচ্ছে ’সেই সময়’। পূর্ব পশ্চিম এবং প্রথম আলোও ইতিহাস নির্ভর কাহিনী। এখন আমি দ’ুরকমই লিখি।
ঠিকানা: ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি এবং আপনার ব্যক্তিজীবনকে নিয়ে লেখা বড় আকারের এবং একাধিক খন্ডে রচিত উপন্যাস সেই সময়, পূর্ব- পশ্চিম, প্রথম আলো এবং অর্ধেক জীবনের মত আর কোন গল্প নিয়ে কাজ করছেন কি?
সুনীল: আমার একটা ইচ্ছে আছে। আমি বইপত্র জোগাড় করছি। বাংলাদেশে ইসলামের আগমন এবং সুফিধর্মের প্রভাব, হিন্দুদের মধ্যে কুসংস্কার এবং হিন্দুদের মধ্যে একশ্রেণীর লোকের আরেক শ্রেণীর লোকের উপর অত্যাচার যে সময়টায় ছিলো সেই সময়টা নিয়ে লেখার একটা ইচ্ছা আছে।
ঠিকানা: আপনি সাংবাদিক হিসাবেও খ্যাত- বর্তমানে আপনি লেখালেখির কোন শাখাতে বেশি আনন্দের সন্ধান পান বা আনন্দ ভোগ করেন?
সুনীল: আমি সত্যিকারভাবে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলাম না। তবে সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ছিলাম। আমি হয়ত পুস্তক পরিচিতি বিভাগের সম্পাদক ছিলাম, কবিতা বিভাগের সম্পাদক ছিলাম- যাকে বলে বিভাগীয় সম্পাদক।
ঠিকানা: বাংলা সাহিত্য পশ্চিম বাংলায় হিন্দির দাপটকে কতটা ঠেকাতে পারছে?
সুনীল: পশ্চিম বাংলাতে হিন্দির যে খুব একটা প্রভাব আছে তা নয়। তবে শহরের ছেলেমেয়েরা একটু -আধটু হিন্দি ভাষা ব্যবহার করছে। আজকাল তো ঢাকাতেও ছেলেমেয়েরা টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। তবে হিন্দি ভাষার কোন সামগ্রিক প্রভাব এখনো পড়েনি। আমাদের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে ইংরেজির সঙ্গে। এটা ঢাকাতেও আছে। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এখন ইংরেজী শিখতে বাধ্য। ইংরেজি শিখতে গিয়ে তারা আর বাংলাটা শিখছে না। এই সমস্যাটা হয়েছে। তবুও বাংলাদেশে বাংলাটা বাধ্যতামূলক- পড়তে তো হবেই। ঢাকাতে একটা কথা চালু আছে- ফেব্রুয়ারি মাসে সবাই বাঙালি, অন্য সময় ইংরেজদের অনুকরণ করে। ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠান হয় তখন সবাই বাংলা ভাষাপ্রেমী হয়। বড়রা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়লেও ছেলেমেয়েরা পায়জামা পঞ্জাবী পড়ে না। তারা প্যান্ট শার্ট পরে। পশ্চিম বাংলায় তো ছেলেমেয়েরা বাংলা কম শিখে। তবে গ্রামে এখনো বাংলা শেখে।
ঠিকানা: দুই বাংলার সাহিত্যের তুলনামূলক বিচারে অনেকেই এখন বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গের উপরে রাখতে চান- আপনার মতটা কী?
সুনীল: অনেকে উপরে রাখতে চাইলে রাখবে- আমার কোন আপত্তি নেই। তবে সাহিত্যতো ওরকম কোন বিষয় নয়। বাংলাদেশে এখন লেখক- কবির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পশ্চিম বাংলায় তো আগে থেকেই ছিলো। এখন যদি দুই ধারায় চলে তাহলে মন্দ কী? তবে একটা ধারা মুছে যাবে, আরেকটা ধারা থাকবে এটার কোন মানে হয় না, আবার কেউ কারো উপরে যাবে এটারও কোন মানে হয় না। আমার মতে বাংলাদেশে যেমন ভাল লেখা হচ্ছে, পশ্চিম বঙ্গেও ভাল লেখা হচ্ছে। তবে প্রকাশনার গুরুত্বটা মনে হয় বাংলাদেশে বেড়ে যাবে।
ঠিকানা: লেখার গুণগত মান সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
সুনীল: আমি যদি মনে করি আমি দুই বাংলারই লেখক তাহলে আমি মনে করি আমি বাংলাদেশেরও লেখক পশ্চিম বাংলারও লেখক। বাংলাদেশের অনেক কাগজে আমার লেখা বের হয়। এরকম অনেকেই আছেন যারা দুই বাংলাতে লিখেন। কাজেই ওরকমভাবে ডিভিশন না রাখাই ভাল।
ঠিকানা: অনেকেই মনে করে আপনি, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু, সমরেশ বসু, জয় গোস্বামী- সার্থকভাবেই আপনাদের পূর্বসুরীদের শূন্যতা পূরণ করতে পেরেছেন, আপনাদের উত্তসুরীদের মধ্যে কি তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছেন যাদের মধ্যে আপনাদের শূন্যতা পূরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
সুনীল: হ্যাঁ। আমি তো বিশ্বাস করি সাহিত্য থেমে থাকে না। সাহিত্যতো নদীর মত সব সময় স্রোত বইতে থাকে। আমাদের চেয়ে ভাল ভাল লেখক আসবে বলে আমি আশাবাদী। তবে আমি নাম বলি না। আমি সবাইকে চিনি। পাঁচ জনের নাম বলবো পাঁচ জনের নাম বলবো না- তাতে অনেকে দু:খ পান। আমি সাধারণভাবে বলতে পারি আমি আশাবাদী দুই বাংলাতেই আরো প্রতিভাবান লেখকের অবির্ভাব ঘটছে।
ঠিকানা: বাংলা সাহিত্য চর্চা আগের মত গুণে-মানে মৌলিকত্বে এবং ব্যাপকতাতেও হচ্ছে কি? না হলে কারণটা কী?
সুনীল: আমাদের কতগুলো প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সেটা হচ্ছে যদি পাঠক না থাকে তাহলে লেখা হবে না। এক সময় ধারণা ছিলো পাঠকদের টিভিতে টেনে নিচ্ছে। টিভির জন্য লোকজন বই পড়বে না, তারা টিভি দেখবে। এখন টিভির চেয়েও বড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে কম্পিউটারের সঙ্গে, ইন্টারনেটের সঙ্গে। এই আমেরিকায় বিখ্যাত লেখকদের বই আর বের হয় না, চলে যায় ইন্টারনেটে। আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা ইন্টারনেটে এখনো সাহিত্য পড়ে না কিন্তু তারা বসে থাকে কম্পিউটার নিয়ে। তারা যদি বই না পড়ে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে এবং কম্পিউটারে বসে সব জানতে চায় তাহলে লেখা কমে যাবে বাংলা সাহিত্যের। আর যদি এমন হয় কম্পিউটারও যদি টিভির মত সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে লোকজন আবার বই এর দিকে ফিরে আসবে তাহলে আরো অনেক কিছু লেখা হবে। পাঠক না থাকলে প্রকাশকও বই ছাপবেনা আবার লেখকও উৎসাহিত হবে না। নির্ভর করছে সাধারণ লোকের পাঠের অভ্যাসের উপর। তারা কোন দিকে যায়।
ঠিকানা: দেখা যায় আমাদের মানুষদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস কম? আপনার মতামত কী?
সুনীল: অভ্যাস কম মানে কী। দেখা যায় ৬০ পার্সেন্ট লোক কোন কিছুই পড়ে না। সবাইতো আর বই পড়বে না। শতকরা যদি ২৫ ভাগ লোক বই পড়তো তাহলেও অনেক হয়ে যেত আমাদের জনসংখ্যার দিক থেকে। তার থেকেও যদি কমে যায় তাহলে ভয়ের কথা।
ঠিকানা: বাংলাদেশের সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে কি কোন খোঁজ খবর রাখেন? কাদের সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন- ভিন্ন ভিন্ন শাখায় যেমন কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে বা প্রবন্ধে। সঙ্গীত, নৃত্যকলা এমন কি রঙ তুলি নিয়েও বলতে পারেন। দুই একজনের নাম বলতে বলা হলে কাদের নাম উচ্চারণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন?
সুনীল: বাংলাদেশে যে সব শিল্পী- লেখক রয়েছেন তাদের আমি চিনি। যেমন শাহাবুদ্দিন নামে একজন শিল্পী রয়েছেন যিনি প্যারিসে রয়েছেন তিনি একজন ভাল শিল্পী। আমি বলবো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখনো দুর্বল। দুই একটা ভাল ছবি হয় বটে কিন্তু অনেক ছবিই দুর্বল। তবে বাংলাদেশে পশ্চিম বাংলা থেকেও যে কাজটি ভাল হয় সেটি হচ্ছে গবেষণামূলক লেখা, রিচার্স মেটেরিয়াল, প্রবন্ধের কাজ খুব ভাল হয়, কবিতাও অনেক ভাল হয়। গল্প, উপন্যাসে দু’একজন ছাড়া তেমন কেউ আসেননি। তবে আসবে আশা করছি। গল্প -উপন্যাসে পশ্চিম বাংলা এখনো অনেক এগিয়ে আছে।
ঠিকানা: সেই ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পেলেন। তারপর অর্থনীতিতে অমর্ত্য সেন এবং শান্তিতে ড: ইউনূস বাঙ্গলীদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সাহিত্যে আর কোন সম্ভাবনা আছে কী না?
সুনীল: রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর যখন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন সেই তখন থেকে তো পরিবেশ অনেক পাল্টে গেছে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা বলা শক্ত। তবে অদূর ভবিষ্যতে আছে বলে মনে হয় না। কারণ অনুবাদের মাঝ পথে আমাদের লিখাগুলো পড়তে হয়। আগে যেমন ভারতীয় সাহিত্য কী কোন উদাহরণ পাওয়া যেত না। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের বই ছাড়া। রবীন্দ্র নাথ নিজেই তার গীতাঞ্জলী অনুবাদ করেছিলেন নিজেই ইংরেজিতে লিখেছিলেন। এখন আমাদের দেশে যারা নৈপলের মত লেখক যিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি ভারতীয় কি ভারতীয় নয় এই একটা বির্তকমূলক ব্যাপার। তেমনি এখন যারা ইংরেজিতে লিখছে, যেমন বিক্রম শেঠ, অমিতাভ ঘোষসহ অনেকে আছেন। বাংলাদেশের একটা মেয়ে মনিকা আলি ব্রিকলিন নামে একটা উপন্যাস লিখেছেন, যদিও সে লন্ডনে রয়েছেন। এমন কি সালমান রুশদিও পেয়ে যেতে পারেন। যারা ইংরেজিতে লিখছেন তাদের পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া আমাদের লেখাগুলোর তো ভাল অনুবাদের ব্যবস্থা নেই।
ঠিকানা: আপনারা কি অনুবাদ করতে পারেন না?
সুনীল: যে লিখবে সে অনুবাদ করবে কেন? এটাতো অন্যদের কাজ।
ঠিকানা: ড: ইউনূসকে নিয়ে পশ্চিম বাংলায় খুব একটা উৎসব দেখা যায় না। আগে যেমন অমর্ত্য সেনের সময় উৎসাহ- উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিলো- এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
সুনীল: এটা এক দম ঠিক নয়। পশ্চিম বাংলায় জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখে তাকে বিরাট নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হবে। এর আগেও ড: ইউনূস সাহেবেকে নিয়ে আমাদের দেশের বহু পত্রিকা কাভার স্টোরী করা হয়েছে। বরং পশ্চিম বাংলায় ড: ইউনূসের একটা বিশেষ অবদান রয়েছে এবং আমাদের যারা অর্থনীতিবিদ তারা সবাই ড: ইউনূসের বন্ধু। এমন কি আমাদের অর্থমন্ত্রী অসিম দাস গুপ্ত তার সাথে তো ড: ইউনূসের প্রায়ই কথা হয়। অমর্ত্য সেনের সাথে তো আছেই। সুতরাং কথাটি মোটেও ঠিক নয়।
ঠিকানা: আপনি আপনার তৃতীয় নয়ন দিয়ে যখন বাংলা শিল্প সাহিত্যের ভবিষ্যত দেখেন তখন তাকে কোন অবস্থানে দেখতে পান?
সুনীল: আমি দেখতে পাই বাংলা শিল্প সাহিত্য ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে এবং আরো উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে যদি একটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে তাহলে আরো বেশি উন্নতি হবে।
ঠিকানা: আপনি বাংলাদেশের সন্তান, অর্জন যা কিছু তা পশ্চিম বঙ্গে- সেই বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গ নিয়ে আপনি কী স্বপ্ন দেখেন?
সুনীল: আমি স্বপ্ন দেখি। আমি যখন ৫৫ বছর পরে বাংলাদেশে গেলাম এবং সেই বিষয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখাটার নাম হচ্ছে মাটি নয় মানুষের টানে। ঐ যে মাটি টা আমি ছেড়ে এসেছি সেই মাটির জন্য আমার টান নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের ব্যবহার দেখে এখনো অভিভূত হতে হয়। সাধারণ মানুষ এখনো ভালবাসে। সুন্দর ব্যবহার করে- এটাই ভাল লাগে। কাজেই আমাদের মধ্যে যদি ভালবাসার একটা সম্পর্ক থাকে এটাই যথেষ্ট। সুনীল নিজের জন্মভূমি নিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সীমান্তবর্তী বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়িয়েছি, মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ খবর নিয়েছি। তাছাড়া বাংলাদেশের অনেক অনেক গল্প আমি আমার মাসী, পিসীদের মুখে শুনেছিলাম। শুনেছিলাম জমির কথা, মাটির কথা, জাম গাছের কথা এবং পুকুর ভর্তি মাছের কথা। আমি পরিবর্তীতে দৃশ্যগুলো দেখতে চাই না- সেইগুলো কল্পনায় রাখতে চাই।
ঠিকানা: প্রবাসের সাহিত্য চর্চা এবং তার সম্ভাবনা নিয়ে বিশেষভাবে কিছু বলবেন?
সুনীল: ১৯৬৩ সালে এখানে এসেছিলাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম বাংলা ভাষায় লিখতে হলে এখানে বসে থাকলে চলবে না। যে জন্য আমার চলে যাওয়া। এখন অনেকেই বলে যে সত্যি কী তাই? আমি বলবো না। এখন অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন বাঙালী কোথায়? বলতে গলে বাঙালী তো ছিলোই না। বাঙালীরা তো আসতে শুরু করে ১৯৬৫ সালের পর থেকে। বাঙালী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর ছিলো। আমি যে শহরে সেখানে আর দুটো মাত্র বাঙালী ছিলো। এখন সেই শহরে ৯ শর মত বাঙালী। আগে আমি রান্না করে খেতাম। হলুদ কোথায় পাওয়া যায় তা খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যেতাম। এখন তো সব কিছু পাওয়া যায় এবং পথেঘাটে বাঙালীর দেখা মেলে। এখন ইচ্ছা করলে এখানে বসেই লেখা যায়। নিউইয়র্ক শহর থেকে ১১টা এবং টরেন্টো শহর থেকে ৬টা পত্রিকা বের হয়। এইগুলো কিন্তু আমার সময়ে ছিলো না। এখন সব কিছু পাল্টে গেছে। এখন বলতে গেলে বাঙালীরা কলোনী করে ফেলেছে।
ঠিকানা: বিশ্ব সাহিত্যের আসরে বাংলা সাহিত্যের আসন কোন খানে?
সুনীল: আমার মনে হয় যে, কোয়ালিটির দিক থেকে বাংলা সাহিত্যে খুবই উচ্চাঙ্গের রচনা আছে। যা নোবেল পুরস্কারও পেতে পারে। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যে বাংলা সাহিত্য পৌঁছায়নি। অনেকে বাংলা সাহিত্যের নামও জানে না। আমি যখন সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে দেখি- অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ভুলে গেছে। নতুন প্রজন্ম তার নাম জানে না। তার কারণ হচ্ছে- আমরা গরীব, অশিক্ষিত প্রচুর। আমরা বলি পৃথিবীতে বাংলা পঞ্চম প্রধান ভাষা কিন্তু পঞ্চম প্রধান ভাষা হলে হবে কি- এই যে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে এদের মধ্যে লেখাপড়া জানে কত পার্সেন্ট? সর্বসাকুল্যে ৫০ পার্সেন্ট। অতএব সেখানে কমে গেল অর্ধেক। দাঁড়ালো সাড়ে ১২ কোটি। এই সাড়ে ১২ কোটির মধ্যে সাহিত্য তো দূরে থাক একটা বই কেনার ক্ষমতা কয় জনের আছে? যাদের ক্ষমতা আছে তারাও কেনে না। কারণ তাদের অভ্যাস নেই। কাজেই বাংলা ভাষাভাষি লোক অনেক হলেও যেহেতু বাংলা ভাষাভাষি জাতি হিসাবে এখনো উন্নত বা শক্তিশালী হতে পারেনি সেজন্য এখনো বাংলা সাহিত্যের কদরটা কম। লোকেরা খোঁজ করে না, একজন বিদেশী পাঠক জানতে চায় না বাংলায় কী লেখা হচ্ছে। জানতে চায় চীনা ভাষায় কি লেখা হচ্ছে। কারণ চীনের একটাই ভাষা। চীন এত বড় একটা দেশ তাদের ৯৫ ভাগ মানুষ একটা ভাষায় কথা বলে।
ঠিকানা: বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রসঙ্গিক?
সুনীল: রবীন্দ্রনাথ প্রচুর লিখেছেন। নানা রকম লেখা লিখেছেন। কিছু কিছু লেখা পুরানো হয়ে গেলেও অনেক লেখা আছে এখনো টাটকা। তার অনেক গদ্য এবং কবিতা খুবই আধুনিক মনে হয় এবং তার যে চিন্তাধারা তা এখনো নতুন করে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। যেমন ধরুন পরিবেশ নিয়ে আজকাল অনেক লোক চিন্তা করেন। রবীন্দ্রনাথ বহু দিন আগেই বলেছিলেন কলকারখানা করে পরিবেশ নষ্ট করে কোন মানুষ বাঁচতে পারবেনা, মানুষ জাতিই ধ্বংস হয়ে যাবে। তার একটা নাটক আছে মুক্তধারা নামে। এই নাটকে তিনি উল্লেখ করেছিলেন নদীগুলোকে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। তিনি এই গুলো কতকাল আগে লিখেছিলেন- এখন নতুন তত্ব বের হয়েছে নদীতে বাঁধ দেয়া ঠিক না। নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে। নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরী করা হচ্ছে বটে কিন্তু নদীগুলো মরে যাচ্ছে।
ঠিকানা: সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতা এবং মানবিকবোধের আবেগ কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
সুনীল: সাহিত্যে আমি বাংলা ভাষাতো বটেই, অন্য ভাষাতেও দেখেছি এমনকি পাকিস্তানের সাহিত্যেও- সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা থাকে না। সাহিত্যিকরা সাধারণত সাম্প্রদায়িক হয় না। দু’ এক পার্সেন্ট হতে পারে বা সরকারি তাবেদার দু এক জন লেখক থাকে সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার নেবার লোভে লিখে থাকেন। সাহিত্যিকরা, শিল্পীরা যারা গান গায় তারা সাম্প্রদায়িক হয় না। পশ্চিমবঙ্গে আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে বলে গান করে হিন্দুরা, আবার মুসলমান গায়ক- গায়িকারা কৃষ্ণকে নিয়ে গান করে। এটা খুব ভাল লক্ষণ। রাষ্ট্রের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবার চেষ্টা থাকে। তার কারণ হচ্ছে- রাজনৈতিক লোকেরা ক্ষমতা দখল করার হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করে, এটা ঠিক নয়।
ঠিকানা: কখন আপনি লেখা শুরু করেছিলেন- এটা কি মনে আছে?
সুনীল: মনে থাকবে না কেন। লেখা শুরু করেছিলাম তখন আমার বয়স পনের টনের হবে। আমার বাবা আমাকে ছুটির সময় দুপুর বেলায় বাড়িতে আটকিয়ে রাখার জন্যে টেনিসনের কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন অনুবাদ করতে হবে। সেটা আমি অনুবাদ করতে করতে কবিতা লেখা শুরু করি। তার পরে একটা লেখা পাঠিয়ে দিই তখনকার দিনের দেশ পত্রিকাতে। সেই লেখাটা ছাপা হয়েছিলো। তবে কবে ছাপা হয়েছিলো তা আমার মনে নেই। পরবর্তী কালে খুঁজে খুঁজে বের করে জানা গেল ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। তারপরেতো আমি একটা পত্রিকা সম্পাদনা করি কৃর্তিবাস নামে, তা এখনো চলে।
ঠিকানা: রাজনীতির ব্যাপারে উৎসাহবোধ করেন কেমন? ভারত বাংলাদেশ পকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলুন?
সুনীল: ছাত্র বয়সে সবার রাজনীতির দিকে একটু ঝোঁক থাকে। আমার বামপন্থী রাজনীতির দিকে ঝোঁক ছিলো। বামপন্থী ছাত্রদলের সাথে যুক্ত ছিলাম। রাস্তায় মিছিল- মিটিংও করেছি। পরবর্তীকালে আমি রাজনীতি থেকে সরে এসেছি। কারণ এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন বামপন্থী- দক্ষিণপন্থী কোন রাজনীতির মধ্যে আমি মাথা গলাই না। কিন্তু বহু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। বেগম জিয়ার সঙ্গেও আমার অল্প একটু পরিচয় আছে।
ঠিকানা: লেখালেখি ছাড়া জীবনের অন্য আর কোন ক্ষেত্রে আপনার পরিচিতি আছে বলে মনে করেন?
সুনীল: আমি এখনো বাংলা ভাষার চর্চা যেন কমে না যায় বা সরকার যাতে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে এর জন্য পশ্চিম বঙ্গে যে কিছু কিছু সামাজিক আন্দোলন হচ্ছে সেই সব আন্দোলনের সম্মুখভাগে থাকি।
ঠিকানা: আপনার লেখালেখির ব্যাপারে কে বেশি আপনাকে উৎসাহ দেয়- আপনার স্ত্রী না ছেলে?
সুনীল: আমার সন্তান তো বিদেশে থাকে। আর ত্যাগ স্বীকার করে আমার স্ত্রী। তার সাহায্যতো অবশ্যই আছে।
ঠিকানা: অনেক সময়ই দেখা যায় বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকারের মধ্যে অনেক দূরত্ব সেই দূরত্বের কারণে দু’ দেশের জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়- এই সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
সুনীল: এটা দু:খজনক ঘটনা। আমরা চাই যাতায়াতে যেন কোন বাধা সৃষ্টি না হয়, মতামত বিনিময়ে যেন বাধার সৃষ্টি না হয়- যাওয়া আসা বাড়তে থাকলে আমরা বাঙালী হিসাবে আরো শক্তিশালী হবো- এটাই আমাদের রক্ষা করা উচিত।
ঠিকানা: আপনার কতটা বই প্রকাশিত হয়েছে?
সুনীল: আমাদের ওখানে রফিকুল ইসলাম নামে একটা ছেলে আছে সে গবেষণা করে বের করেছে আমার বই এর সংখ্যা কত। সেখান থেকে জানতে পারলাম আমার বই এর সংখ্যা সাড়ে তিন শ’র বেশি।
ঠিকানা: কিছু দিন আগে নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক উইলিসিয়াংকার সাথে সাক্ষাত হয়েছিলো। উনার বক্তব্য থেকে জানতে পরলাম তিনি সর্বমোট ১২ টা বই লিখেছিলেন এবং তার মধ্যে একটি নাটকের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের দেশের লেখকরা অনেক বেশি বেশি বই লিখেন- অন্যদিকে তারা খুব কম লিখেন -এর কারণ কি?
সুনীল: কারণটা সহজ। আমি যে সাড়ে তিন শ বই লিখলাম। একজন মানুষের পক্ষে সাড়ে তিন শ বই লিখা খুব শক্ত। এইগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আছে কালেকশন। মানে আগেকার দুই তিনটা বইকে এক করা হয়েছে বা অন্য লোকদের বই আমার নামে সম্পাদনা করেছি। সেই দিক থেকে আমার আসল বই দু’শর মত হবে। দুই শ বই লেখাওতো শক্ত। এই দেশের লোকজন শুনলে আঁতকে উঠবে। এত লেখা একজন মানুষ লিখে নাকি। কিন্তু আমাদের দেশেতো লেখকদের জীবিকা হয় লেখা দিয়ে। এদেশেতো প্রথম কথা সার্থক লেখকরা অনেক বেশি পয়সা পায়। দ্বিতীয় কথা এদেশে অনেক ফাউন্ডেশন আছে তারা লেখকদের পেট্রোনাইজ করে। তারা হয়ত একটা বই লেখার জন্য লেখককে তিন বছর ধরে টাকা দেয়। যার জন্য এই দেশের লেখকদের কোন চিন্তা করতে হয় না- আমাদের দেশেতো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। পৃথিবীর কোন কোন দেশে বড় বড় লেখকদের জন্য সন্দুর পরিবেশে বাড়ি তৈরী করে তাদের দেয়া হয়েছে নাম মাত্র ভাড়ায়। আমাদের দেশে যদি এই রকম ব্যবস্থা থাকতো তাহলে লেখকদের অনেক সুবিধা হতো। আমাদের দেশেতো লেখকদের পত্রিকায় লিখে পয়সা কামাতে হয়, অনেক সময় বই এর পয়সাও প্রকাশকদের কাছ থেকে ঠিক মত পাওয়া যায় না। এই সব কারণে বেশি বেশি লিখতে হয়।
ঠিকানা: আপনি অনেক দিন বিদেশে ছিলেন, আপনার লেখায় তার ছাপ রয়েছে এবং এর জন্য আপনার লেখাও অনেক শক্তিশালী। যেমন বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে জাফর ইকবাল, হুমায়ুন আহমেদ, এমদাদুল হক মিলন তারাও বিদেশে ছিলেন যে জন্য তাদের লেখাও বেশ সমৃদ্ধ। আপনি কি মনে করেন বিদেশে না এলে আপনার লেখা এত সমৃদ্ধ হতো না?
সুনীল: এখন তো অনেক লেখক বিদেশে যাতায়াত করছেন। আমি যেটুক উপকৃত হয়েছি- আমি যেখানে ছিলাম সেখানে বহুদেশের লেখকদের জমায়েত ছিলো। এদের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকার ফলে তাদের দেশের সাহিত্যের অগ্রগতি সম্পর্কে আমি ধারণা পেয়েছিলাম। বিশ্ব সাহিত্য কোন অবস্থানে ছিলো তার ধারণা পেয়েছিলাম। এটা আমার উপকারে এসেছিলো। না হলে আমি যদি কলকাতায় বসে লিখতাম তাহলে হয়ত কুপমুন্ডক হতাম। যা লিখতাম তাই মনে হতো আধুনিক হচ্ছে।
ঠিকানা: গত বছর এখানে সমরেশ মজুমদার এসেছিলেন তার একটা ইংরেজি বই প্রকাশের জন্য। সেখানে এদেশের লেখকদের অনেকেই বলেছেন, বইটি আমেরিকান ওয়েতে লিখতে হবে- যদি আমেরিকায় বাজারজাত করতে হয়।
সুনীল: তারা ঠিক বলেছেন।
ঠিকানা: আপনার যে লেখা- আপনার সাহিত্য সম্পর্কেতো এদেশের বা ওয়েস্টটার্ণ লেখকরা খুবই কম জানে কিন্তু আপনি আপনার সাহিত্য কর্ম এদের কাছে পৌঁছানোর জন্য কোন ব্যবস্থা করছেন কি?
সুনীল: অনেকে করে আমি করি না। কারণ সাহেবেরা আমার লেখা না পড়লে আমার কিছু আসে যায় না। আমার বাঙালী পাঠকরা যদি আমার লেখা পড়ে, ভালবাসে, আমাকে চিঠি লেখে এতেই আমি খুশি। সাহেবেরা আমার লেখা পড়লো কি পড়লো না তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, অনেক পাঠক আমাকে চিঠি লেখে। যেগুলো পড়ে আমি ধন্য হয়ে যাই। এবার আমি জামার্নিতে বই মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে এক সাহিত্য সভায় শুনলাম- বার্লিন থেকে এসে একটি মেয়ে হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি হয়েছে। তার এক হাতে আইভি দেয়া হচ্ছে। অন্য হাতটি ডাক্তারকে বলে মুক্ত রেখেছে। কারণ হিসাবে সে উল্লেখ করেছে বাকি হাতটি দিয়ে আমি যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে পূর্ব- পশ্চিম বইটি পড়ে শেষ করতে পারি এবং শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে পারি। এর চেয়ে বড় পাওনা একজন লেখকের পক্ষে আর কি হতে পারে।
ঠিকানা: তাহলে ওয়েস্টার্ণ লেখকরা আপনার লেখা সম্পর্কে জানবে কি করে?
সুনীল: নাই জানুক না কেন? তাদের আগ্রহ থাকলে জানবে, আগ্রহ না থাকলে জানবে না। আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে কিছু করবো না।
ঠিকানা: বাংলাদেশের কোন কোন লেখকের লেখা আপনি পড়েছেন?
সুনীল: বাংলাদেশী লেখকদের মধ্যে শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, আল মাহমুদের লেখা আমি পড়েছি। তবে আল মাহমুদ এখন কেমন জানি হয়ে গেছেন।
ঠিকানা: কী কী ভালবাসেন?
সুনীল: আড্ডা মারতে, ভ্রমণ করতে, বই পড়তে এবং খেতে। খাওয়ার ব্যাপারে আমি মুক্ত মনা কিন্তু পেটুক না। এমন কি আমি কুমিরের মাংস পর্যন্ত খেয়েছি।
ঠিকানা: ঠিকানা পাঠক এবং প্রবাসীদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুনীল: আমি যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে প্রবাসী বাঙালীদের শক্তি বাড়ছে। বাঙালীদের নিজস্ব পত্র পত্রিকার সংখ্যা বাড়ছে। এমন কি আমি দেখছি নিউইয়র্কে পত্রিকায় চাকরি করে বাঙালীরা জীবিকা নির্বাহ করছে। এই রকমভাবে যদি হয় তাহলে এখানে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অন্যান্য কাজে যারা জড়িত আছেন এবং বাংলা ভাষা চর্চা করছেন এবং বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য কাজ করছেন তাদের সকলের প্রতি আমার ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা।
ঠিকানার পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা।
সুনীল: ঠিকানা পরিবারের সকলকে এবং আপনাকে শুভেচ্ছা। ১ ডিসেম্বর ২০০৬ সাল সংখ্যা
বাংলায় লিখবো বলেই যৌবনেও আমেরিকার হাতছানি উপেক্ষা করেছি
ঠিকানার সাথে একান্ত কথামালায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়