ওয়াকিল আহমদ
বাংলা সন ও পূজা-পার্বণ-ব্রত-মেলা : ‘বার মাসে তেরো পার্বণ’ বহুল প্রচলিত একটি বাংলা প্রবাদ। ক্ষুদ্রাকার হলেও প্রবাদ লোকসাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ফর্ম বা আঙ্গিক। প্রবাদটির দুটি অংশ- ‘বার মাস’ ও ‘তের পার্বণ’। বার মাসের নাম জানি, তেরো পার্বণ কি কি? তার নাম আমাদের জানা নেই। বার মাসের ধারণা ‘বারমাসিতেও রয়েছে; সংখ্যাটি পূরণবাচক। তের সংখ্যাটি পূরণবাচক, না বহুত্ববাচক- তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সম্ভবত এটি বহুত্ববাচক, কেননা লোকসমাজে তের অপেক্ষা অনেক বেশি পালাপার্বণ প্রচলিত আছে। ‘আইনের বার মুখ তের ছিপি’ একই আঙ্গিকের অপর একটি প্রবাদ, যেখানে ‘তের’ সংখ্যাটি বহুত্ববাচক বলে প্রতিভাত হয়।
‘পার্বণের আভিধানিক অর্থ- ‘অমাবস্যাদি পর্বদিনে দেব বা পিতৃলোক উদ্দেশ্যে যা কৃত বা দত্ত হয়।’ এ অর্থে হিন্দুসমাজে শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠান এক একটি পার্বণ। আবার বিবাহাদি আচার-অনুষ্ঠান পার্বণ বলে গণ্য হয়। পর্ব থেকে পার্বণ শব্দের উৎপত্তি- ‘যা পর্ব সম্বন্ধীয় তাই পার্বণ।’
‘পঞ্চপর্ব’ বলতে অষ্টমী, চতুর্দশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও সংক্রান্তি- এ পঞ্চক্ষণ বা কালকে বোঝায়। হিন্দুশাস্ত্রমতে পঞ্চপর্বে রতিবিহার, মাংসভক্ষণ, তৈলমর্দন ইত্যাদি নিষিদ্ধ। বাংলা ভাষায় পৌষপার্বণ, ব্রতপার্বণ, পালাপার্বণ, পূজাপার্বণ ইত্যাদি শব্দদ্বৈতের বহুল ব্যবহার আছে। বিষয় বা বস্তুর নৈকট্য বা অভিন্নতা বোঝাতে ‘বার-তের, উনিশ-বিশ, বায়ান্ন-তেপান্ন’ ইত্যাদি জোড়সংখ্যার উল্লেখ করা হয়। আবার সংখ্যা বা পরিমাণ বোঝাতে ‘দশ-বার, বিশ-ত্রিশ, আশি-নব্বই’ ইত্যাদি জোড়সংখ্যারও উল্লেখ করা হয়। এ থেকে প্রবাদের ‘তের পার্বণের সঠিক নির্দেশনা মেলে না। প্রবাদের সূচনাতে নির্দিষ্ট তেরটি পার্বণ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন বহুবিধ পার্বণ বোঝাতে সংখ্যাটি ব্যবহৃত হয়।
হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সব ধরনের পূজা-পার্বণ-ব্রত বছরের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অনুসারে পালিত হয়ে থাকে। মাস-দিন-বার-তিথির নামেই কতক পার্বণ আছে। যেমনÑ মাসের নামে পৌষপার্বণ; দিনের নামে জন্মাষ্টমী, জামাইষষ্ঠী, বৌদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি। পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ মাসের শেষ দিনে ‘পৌষপার্বণ’ পালিত হয়। এটি ‘পিঠা-উৎসব’ নামেও পরিচিত। নতুন চালের গুঁড়া, নারিকেল ও খেজুরগুড় দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। প্রাচীনকালে এভাবে পিঠা তৈরি করে পিতৃপুরুষ অথবা বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ প্রদান করা হতো; এখন এটি আনন্দোৎসবে পরিণত হয়েছে। সব সম্প্রদায়ের মানুষ পিঠা-উৎসব পালন করে থাকে।
‘নবান্ন’ অপর একটি পার্বণ যা অগ্রহায়ণ মাসে পালিত হয়। নতুন আমন ধানের চাল দিয়ে অন্ন প্রস্তুত করে প্রথমে পিতৃপুরুষ, দেবতা ও কাকের প্রতি উৎসর্গ করা হয়, পরে পরিবারের লোকজন খায়। কাকের মাধ্যমে এই অন্ন মৃত আত্মার কাছে পৌঁছায় বলে লোকেরা বিশ্বাস করে।
পৌষপার্বণ ও নবান্ন উভয়ই শস্যোৎসব। বলা বাহুল্য, এগুলো খুবই প্রাচীন প্রথা-সংস্কার। জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লা ষষ্ঠীতিথিতে পালিত হয় জামাইষষ্ঠী ব্রত বা পার্বণ। ঐদিন মেয়ে ও জামাইকে নিমন্ত্রণ করে এনে অন্ন-ফলাদি আহার দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। আদিতে এটি ছিল ষষ্ঠীপূজা; দেবীষষ্ঠী হলেন মাতৃত্বের প্রতীক। তাই ষষ্ঠীপূজা প্রজননের সঙ্গে জড়িত।
‘জন্মাষ্টমী’ শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব; ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালন করা হয়। এরূপ পূজা-পার্বণও প্রাচীন প্রথা।
‘কার্তিক ব্রত’ পালিত হয় কার্তিক মাসে। কার্তিক মাসের শেষ ১৫ দিনের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার উপবাস করে এ ব্রত পালন করা হয়।
‘বৌদ্ধপূর্ণিমা’ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মুখ্য উৎসব যা বৈশাখ মাসের পূর্ণিমাতিথিতে উদ্যাপিত হয়। একই তিথিতে বুদ্ধদেব জন্মগ্রহণ, বুদ্ধত্ব অর্জন ও নির্বাণলাভ করেন। এ জন্য দিনটি তাদের কাছে খুবই পবিত্র। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ‘দীপাবলী উৎসব’ পালিত হয়।
এককালে হিন্দুর ঘরে ঘরে ব্রতোৎসব পালিত হতো। ব্রত মূলত হিন্দু রমণীরা পালন করে থাকেন। সমীক্ষায় জানা গেছে, এরূপ ব্রতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। পার্বণের মতো ব্রতগুলিও বাংলা সনের দিন-ক্ষণ-বার-তিথি অনুযায়ী পালিত হয়। মাসের নামে কতক ব্রতের নামকরণ হয়েছে, যেমনÑ চৈত্রসংক্রান্তি ব্রত, মাঘীপূর্ণিমা ব্রত, মাঘম-ল ব্রত, পৌষ আগলানো ব্রত ইত্যাদি।
ফাল্গুনের কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়; ঐ রাত্রিতে শিবব্রত পালিত হয়। ‘ভাইফোঁটা ব্রত’ পালিত হয় কার্তিক মাসের পঞ্চম দিনে। লক্ষ্মী সম্পদের দেবী; হিন্দুর ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবার তার পূজা হয়। তার আনুষ্ঠানিক পূজা হয় কোজাগরী পূর্ণিমাতে। আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিকে ‘কোজাগরী পূর্ণিমা’ বলে।
জ্যৈষ্ঠ মাসে খরা দেখা দিলে বৃষ্টির কামনায় ‘বসুধারা ব্রত’ পালন করা হয়। এভাবে হিন্দুরমণীরা প্রতি মাসে গড়ে চার-পাঁচটি ব্রত পালন করে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে সচল করে তোলেন। অর্থাৎ বাংলা সনের রূপায়ণে তাদের বিশিষ্ট ও বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিলো।
লৌকিক মেলা আরেকটি উৎস, যেখানে বাংলা বর্ষপঞ্জির চর্চা ছিল। আশ্রয় নেয়া হতো। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এরূপ মেলার সংখ্যা শতাধিক। অর্থাৎ দেশের নানাস্থানে মাসে গড়ে আট-দশটি করে মেলার আয়োজন হতো। এর সবগুলোর উৎস প্রাচীন নয়। ধর্মোৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত মেলাগুলো প্রাচীন ছিলো সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ দুর্গাপূজা, কালীপূজা, চড়কপূজা, রথযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি উপলক্ষে আয়োজিত মেলার নাম করা যায়। পূজা ও মেলা একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত দুর্গাপূজা, কার্তিক মাসের আমাবস্যা তিথিতে কালীপূজা, চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়কপূজা, আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে রথযাত্রা পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্নানযাত্রার মধ্যে বারুণী স্নান, লাঙ্গলবন্দের স্নান বিখ্যাত।
চৈত্রমাসের শুক্লাষ্টমীতে নারায়ণগঞ্জে লাঙ্গলবন্দের স্নান এবং কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেশের নানাস্থানে বারুণীস্নান অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চৈত্রমাসের শিবচতুর্দশীতে ‘চৈতপূজার মেলা’ মেলাটি খুবই বিখ্যাত। পূজা উপলক্ষে মেলা শুরু হলেও কোনো কোনো মেলা কয়েকদিন স্থায়ী হয়। কিছু মেলা আছে, যেগুলি মাসের নামেই পরিচিত। যেমন- চৈতিমেলা, বৈশাখিমেলা, পৌষমেলা ইত্যাদি। এগুলোর সাথে ধর্মের সম্পর্ক নেই।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মেলাগুলো পূর্ণিমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন আশ্বিনী পূর্ণিমা মেলা, মাঘীপূর্ণিমা মেলা, চৈত্র সংক্রান্তিতে ‘মহামুনি মেলা’ ইত্যাদি। বৈশাখ মাসের বৌদ্ধপূর্ণিমাতে ‘বৌদ্ধপূর্ণিমা’ মেলা হয়।
বাংলার মেলাগুলোর নানা মাত্রিকতা রয়েছে। মেলার প্রধান লক্ষ্য স্থানীয় পণ্যের বেচাকেনা। এতে গানবাজনা, যাত্রা, সার্কাস, খেলাধুলা প্রভৃতি বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এজন্য উপলক্ষ যাই হোক, মেলায় সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করে। মেলা মানুষের মিলনক্ষেত্র। মেলার আয়োজন বড়, আয়োজনকারী, পূজারী, দর্শনার্থী, ক্রেতা-বিক্রেতা মিলে এর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও বিপুল। বাংলা সনের রূপায়ণে ও চর্চায় তাদের অবদানের কথাও স্মরণ করতে হয়। [চলবে]
– ভার্জিনিয়া। ৯ জুন, ২০১৮।