বাংলা সন ও সংস্কৃতির মর্মকথা-৫

ওয়াকিল আহমদ

বাংলা সন ও পঞ্জিকা : বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন, প্রহর, তিথি ইত্যাদির ধারাবাহিক হিসাব রাখার দুটি উপায় অবলম্বন করা হয়- একটি ‘দিনপঞ্জি’ (ঈধষবহফধৎ), অপরটি ‘বর্ষপঞ্জি’ (অষসধহধপ) বা ‘পঞ্জিকা’। বর্তমানে ব্যবহৃত দিনপঞ্জিতে সপ্তাহভিত্তিক বার মাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকে। বর্ষপঞ্জির পরিসর অনেক বড়; এতে জ্যোতিষশাস্ত্রের অনেক তথ্যসহ সাংবার্ষিক মাস-পক্ষ-সপ্তাহ, দিন-রাত, তিথি-লগ্নের সুবিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে যাঁদের জ্ঞান আছে, তাঁরাই পঞ্জিকা রচনার অধিকার রাখেন। বাংলা সনের রূপ-রূপায়ণে দিনপঞ্জি ও বর্ষপঞ্জির অবদান রয়েছে। আমাদের দেশে দিনপঞ্জির ধারণা আধুনিক যুগের, কিন্তু বর্ষপঞ্জির ধারণা ও ব্যবহার প্রাচীনকালেও ছিল। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে ‘পাঁজি’ (<পঞ্জিকা)-র উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণগণ পূজার্চনায় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে শুভাশুভ দিন, ক্ষণ, লগ্ন নির্ণয় করার জন্য পঞ্জিকা ব্যবহার করতেন। এতে বছরব্যাপী নানাবিধ কৃত্যানুষ্ঠানের নির্দেশনা থাকতো। যে ব্রাহ্মণ এর চর্চা করতেন তাঁকে ‘গণকঠাকুর’ বলা হতো। মুকুন্দরামের ‘চ-ীমঙ্গল’ কাব্যে বর্ণিত ভাঁড়ুদত্ত এরূপ একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি ‘পাঁজিপুঁথি’ নিয়ে নতুন নৃপতি কালকেতুর দরবারে হাজির হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষে বৈদিকযুগে রচিত ছয় ‘বেদাঙ্গ’ হলো পঞ্জিকার আদি উৎস। বেদাঙ্গের ওপর ভিত্তি করে খ্রিস্ট্রিয় চার শতকে রচিত হয় ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’, যা ছিল অধিক বিজ্ঞানসম্মত এবং পূর্ণাঙ্গ পঞ্জিকা। যুগে যুগে এর সংস্কার-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক সৌরপঞ্জিকার রূপায়ণে যাঁরা অবদান রাখেন, তাঁরা হলেন আর্যভট্ট (৫ম শতক), বরাহমিহির (৬ষ্ঠ শতক), ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর (১২শ শতক) প্রমুখ জ্যোতির্বিদ। বিশেষজ্ঞের অভিমতঃ “তাঁরা পঞ্জিকার গণনাকে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তিথ্যাদির সূক্ষ্ম কাল গণনার সূত্রাদি দ্বারা দৈনিক গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, লগ্ন, ক্ষণ, তিথি প্রভৃতির পূর্তিকাল পঞ্জিকার মধ্যে পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন। এতে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সহজেই পঞ্জিকা থেকে পাওয়া যেতো।” [বাংলাপিডিয়া]
বলা বাহুল্য, বঙ্গদেশে শকাব্দকে কেন্দ্র করেই পঞ্জিকার চর্চা হয়েছে। ৮ম-৯ম শতকে বাংলা ভাষার উদ্ভবের পর ঐ পঞ্জিকা অনূদিত হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না। ১৬শ শতকে বাংলা সনের প্রবর্তনের পর কখন কিভাবে প্রচলিত তথ্যসমূহ বাংলা পঞ্জিকায় গৃহীত হয়, তাও আমাদের জানা নেই। মধ্যযুগে বঙ্গীয় জ্যোতির্বিদ ও সংশ্লিষ্ট পঞ্জিকার ইতিহাস সম্বন্ধে অতি সামান্যই জানা যায়। স্মার্ত ও পন্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য সম্পাদিত নবদ্বীপ পঞ্জিকার নাম পাওয়া যায়। তিনি ১৬শ শতকে অবির্ভূত হন। রঘুনন্দনের পরে পঞ্জিকা গণনার দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে রামরুদ্র বিদ্যানিধি (১৮শ শতক) এবং বিশ্বম্ভর জ্যোতিষার্ণব। উভয়ে নবদ্বীপের অধিবাসী সংস্কৃত পন্ডিত ছিলেন।
আধুনিক যুগে মুদ্রণশিল্পের প্রচলনের পূর্বে বাংলা পঞ্জিকা প্রণিত হয় নি বলে আমাদের ধারণা। কলিকাতায় আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণির বিকাশ এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত-প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে দিনপঞ্জি-বর্ষপঞ্জির চাহিদা সৃষ্টি হয়। ১৮৬৯ সালে প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকার সন্ধান পাওয়া যায়। ১২৯৭ মোতাবেক ১৮৯০ সালে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ‘লোকনাথ পঞ্জিকা’, ‘বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা’, ‘মদনগুপ্তের পঞ্জিকা’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের কাছে ‘লোকনাথ পকেট পঞ্জিকা’ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ‘মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা’ খুব জনপ্রিয় হয়। দিনপঞ্জির মতো পঞ্জিকাও প্রতি বছর নতুন করে প্রণয়ন ও মুদ্রণ করতে হয়, কেননা বার, তিথি, লগ্ন ইত্যাদি অভিন্ন থাকে না। বিশেষত চান্দ্রমাস-চান্দ্রদিন নির্ভর সময়গুলো পরিবর্তিত হয়।
মুদ্রণশিল্পের সুবাদে দিনপঞ্জি ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হলেও বর্ষপঞ্জির ব্যবহার সীমিত ছিল। বড় গৃহস্থ পরিবারে দু-একখানা পঞ্জিকা থাকতো; গ্রামের মানুষ প্রয়োজনীয় তথ্য সেখান থেকে জেনে নিত। বছরব্যাপী সৌর ও চান্দ্র মানের সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব হলো পঞ্জিকা। পঞ্জিকায় আছে কি? হিন্দু পঞ্জিকার সারবস্তু বা মুখ্য দিকগুলো হলোঃ দিন (৩৬৫টি), তিথি (৩০টি), বার (৭টি), নক্ষত্র (২৭টি), যোগ (২৭টি), করণ (৬০টি), মাস (১২টি), রাশি (১২টি), ঋতু (৬টি), যুগ (৪টি), বর্ষফল, রাশিফল, মাসফল ইত্যাদি। আমরা পূর্বে মাস, বার, ঋতু, রাশিচক্র সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছি। এখন অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করা যায়।
পঞ্জিকার দিন নির্ধারণের পাঁচটি অঙ্গ, যথা- তিথি, বার, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। তিথি হলো চান্দ্রদিন, যা চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধি দ্বারা নিরূপিত হয়। প্রতিপদ বা প্রথমা, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, ত্রয়োদর্শী চতুর্দশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা ইত্যাদি এক একটি তিথি। পঞ্জিকার শুভাশুভ বিচারে তিথির প্রভাব আছে। তিথি ও লগ্ন দেখে বিবাহ, যাত্রা, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাসন ইত্যাদির সময় নির্ধারণ করা হয়। হিন্দুসমাজে জন্মলগ্ন ও বিবাহলগ্নকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাজা লক্ষ্মণ সেনের জন্মলগ্ন নিয়ে মিথ রয়েছেঃ জ্যোতিষীর গণনা অনুযায়ী তিনি মাতৃগর্ভ হতে লগ্ন মাফিক ভূমিষ্ঠ হলে আশি বছর আয়ু নিয়ে রাজত্ব করবেন। জন্মলগ্ন পার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে মায়ের পা বেঁধে উপর থেকে ঝুলিয়ে জন্ম ত্বরান্বিত করা হয়েছিল। বিবাহলগ্ন পার হলে কনে ‘ভ্রষ্টলগ্না’ হয়; অপয়া বিবেচনায় ভ্রষ্টলগ্না মেয়ের বিয়ে পরবর্তী সময়ে কঠিন হয়ে পড়ে। জ্যোতিষশাস্ত্রে এক দিবারাত্রের মধ্যে বারটি রাশি পর্যায়ক্রমে পূর্বদিকে উদিত হয়। নির্দিষ্ট সময়ে রাশির এই উদয় কালকে ‘লগ্ন’ বলে। বারটি রাশি বারটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ যাই ঘটে, তা এই রাশি-লগ্নের ফল বলে লোকে বিশ্বাস করে।
‘তিথি’ সম্পর্কে পঞ্জিকার ভাষ্য হলোঃ “এক চান্দ্রমাসের গড় মান ২৯.৫৩ দিন। একে পূর্ণ সংখ্যাতে রূপান্তরিত করলে ৩০ দিন হয়। ৩০ দিনকে ৩০টি সমান সমান ভাগে ভাগ করে, এক একটি অংশকে বলা হয় তিথি …. অমাবস্যাকে আদি তিথি বা ১ম দিন ধরা হয়। যখন চন্দ্র ও সূর্যের একই সরলরেখায় মিলন হয় তখন অমাবস্যা হয়। সুতরাং তিথি = ১ চান্দ্রদিন। অমাবস্যার পরের দিন প্রতিপদ বা প্রথমা তিথি, যা দিয়ে শুক্লপক্ষের শুরু।…. তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে। এর কারণ চন্দ্রের জটিল গতি। চন্দ্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এক কক্ষপথে ঘুরে চলেছে। কক্ষপথটি কিন্তু উপবৃত্তাকার (ঊষষরঢ়ঃরপধষ), যার ফলে চন্দ্রের গতি সেই কক্ষপথে সব জায়গায় সমান নয়। কখনো ধীরে, কখনো জোরে।…. সেই জন্যেই তিথির মান ২০ থেকে ২৭ ঘন্টা পর্যন্ত হয়। সুতরাং পাঞ্জিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হোল তিথি।”- উইকিপিডিয়া (ইন্টারনেট)। ভারতবাসীর জীবনে তিথিসংক্রান্ত সংস্কার কত প্রবল ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে রাজস্থানের ‘পদ্মাবতী’ কাহিনীতে। মুহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য থেকে জানা যায় যে, রাজা রতœসেনের সভাপন্ডিত রাঘব চেতন তাঁর জাদুশক্তি বলে রাজাকে কোনো এক উপলক্ষে দ্বিতীয়ার চাঁদকে প্রতিপদ রূপে দেখান। কিন্তু তাঁর এই চাতুরি ধরা পড়লে রাজা তাঁকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। প্রতিশোধ স্পৃহাবশে রাঘব চেতন দিল্লির বাদশাহ আলাউদ্দিন খালজিকে চিতোর আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে রাজ্যের সমূহ ধ্বংস ডেকে আনেন। লগ্নের মতো তিথিরও শুভাশুভ ফল বিচার করা হয়। একদিনে তিন তিথির মিলনকে ‘ত্র্যহস্পর্শ’ বলে। এটি অশুভ তিথি বা ক্ষণ।
সপ্তাহের সাত ‘বারে’র নাম ও নামের উৎসের বিষয় পুর্বে উল্লেখ করেছি। ‘নক্ষত্র’ হলো চান্দ্র মাসের ১/২৭ অংশ, প্রায় ২৫ ঘন্টা ১ মিনিট। চন্দ্র রাশিচক্রের ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসে। এই রাশিচক্রের ভাগ ২৭টি। ক্রমানুসারে এগুলোর নাম হলো- ১. অশ্বিনী, ২. ভরণী, ৩. কৃত্তিকা, ৪. রোহিণী, ৫. মৃগশিরা, ৬. আর্দ্রা, ৭. পুনর্বসু, ৮. পুষ্যা, ৯. অশ্লেষা, ১০. মঘা, ১১. পূর্বফাল্গুনি, ১২. উত্তরফাল্গুনি, ১৩. হস্তা, ১৪. চিত্রা, ১৫. স্বাতী, ১৬. বিশাখা, ১৭. অনুরাধা, ১৮. জ্যেষ্ঠা, ১৯. মূলা, ২০. পূর্বাষাঢ়া, ২১. উত্তরাষাঢ়া, ২২. শ্রবণা, ২৩. ধনিষ্ঠা, ২৪. শতভিষা, ২৫. পূর্বভাদ্রপদ, ২৬. উত্তরভাদ্রপদ এবং ২৭. রেবতী। প্রতি ভাগের ব্যবধান হলো ১৩ ডিগ্রি ২০ মিনিট। এরূপ এক একটি ভাগকে নক্ষত্র বলা হয়। এই ভাগের প্রধান উজ্জ্বল তারাকে ‘যোগতারা’ বলা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলা বারো মাসের নামগুলি এসব নক্ষত্রের মধ্য থেকেই গৃহীত হয়েছে।
‘করণ’ হলো তিথির ১/২ ভাগ বা অর্ধাংশ। ৩০টি তিথির করণ সংখ্যা হলো ৬০টি। এসূত্রে করণ হলো এক সৌরদিনের ১/৬০ ভাগ। ৬০টি করণের আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে; ব্যবহার কম বিধায় এখানে সেগুলি উল্লেখ করা হলো না। পঞ্জিকার শেষ অঙ্গ ‘যোগ’; সৌরমাসের ১/২৭ অংশকে যোগ বলা হয়।
পঞ্জিকার ‘কালচক্রে’র ধারণাটি সংক্ষেপে এরূপঃ ১ বছর ৩৬৫ দিন, ১২ মাস (প্রতি সৌরমাস ৩০/৩১ দিন) ও ৬ ঋতু (এক ঋতু- ২ মাস, ৬০ দিন)। ১ চান্দ্রমাস ২ পক্ষ (শুক্লপক্ষ- প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিন; কৃষ্ণপক্ষ- অমাবস্যাসহ ১৫ দিন)। দিন-রাত- ২৪ ঘন্টা বা ৮ প্রহর বা ৩০ মুহূর্ত বা ৬০ ঘটিকা। কালের ক্ষুদ্রতম অংশ ‘পল’; ৬০ পলে এক ‘দন্ড’ (২৪ সেকেন্ড)।
উপরে বর্ণিত তথ্যগুলি পঞ্জিকার অভ্যন্তরিণ উপাদান। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃত পঞ্জিকার উপাদানসমূহ আত্মীকরণ করে বাংলা পঞ্জিকা যে রূপ লাভ করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। এসব উপাদানের সাথে বাংলা সনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মুখ্যত হিন্দু প-িতগণ অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমান বিদ্বজ্জন ‘মোহাম্মদী পঞ্জিকা’ প্রকাশ করে তাঁদের সহযোগী ও সহগামী হন।
ভার্জিনিয়া ।