ওয়াকিল আহমদ
পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে, যাদের নিজস্ব কোনো অব্দ বা বর্ষপঞ্জী নেই, আমাদের আছে- এ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে বাঙালি আছে। বর্তমানে বাঙালি আরও ছড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে এক কোটির অধিক প্রবাসী বাঙালি আছে। অভিবাসনের কারণে আমাদের জাতীয়তার পরিবর্তন হলেও বাঙালি জাতিসত্তার পরিবর্তন হয় নি। আমরা সবাই মিলে একটা ‘বাঙালিবিশ্ব’ গড়ে তুলেছি। সব জায়গা থেকে বাংলা নববর্ষ পালনের খবর পাওয়া যায়। আমরা বাঙালি সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রচারক। বঙ্গাব্দ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের ‘জাতীয় অব্দ’ রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে; ১লা বৈশাখ এখন সরকারি ছুটির দিন। বাংলা নববর্ষ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস আছে, যার প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন। এর উদ্ভব ও প্রবর্তনের সাথে বঙ্গীয় কোন ব্যক্তির স্মৃতি বা ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা জড়িত নেই। পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে, আর তা হলো ‘সুবেহ্ বাঙ্গালা’র কৃষিসম্পদ ও কৃষিব্যবস্থা। বাংলা সন প্রবর্তনের কৃতিত্ব দিল্লির বাদশাহ আকবরের। তিনি খাজনা আদায়ের সুবিধানিমিত্ত চান্দ্রসন হিজরিকে সৌরসনে রূপান্তরিত করেন। প্রথমে এর নাম ছিল ‘আকবরি সাল’ বা ‘ফসলি হিজরি’। বাদশাহ আকবরকে এই কাজে সহায়তা দান করেন তাঁর সভাসদ ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজি। তিনি চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌরবর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার মূল দায়িত্ব পালন করেন। শিরাজি ৯৯২ হিজরিতে (১৫৮৪) কাজটি সম্পন্ন করলেও আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর থেকে এর গণনা শুরু হয়। ঐ সময়টি ছিল ৯৬৩ হিজরির মহররম মাস (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৫৫৬)। বাংলাদেশের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও ফসল তোলার সময় লক্ষ্য করে এর প্রথম মাস হয় বৈশাখ, আর প্রথম দিন বা ১লা বৈশাখ হয় নববর্ষ (খ্রিস্টীয় ১৪ই এপ্রিল)। ঐ দিন হিজরি সনের প্রকৃত দিন-মাস যাই হোক, তা গণনায় না নিয়ে কেবল ৯৬৩ বছরটিকে ধরা হয়েছে। পরের বছর বাংলা সনের আয়ু হয় ৯৬৪।
ফসলি হিজরি যখন প্রবর্তিত হয়, তখন বার মাসের নাম ছিল- ১. কারওয়াদিন, ২. আরদি ভিহিসু, ৩. খোরদাদ, ৪. তীর, ৫. আমারদাদ, ৬. শাহরিয়ার, ৭. মিহির, ৮. আরান, ৯. আয়ুব, ১০. দাই, ১১. বাহাম ও ১২. ইসকান্দার মিজ। এগুলো ফারসি ভাষার শব্দ। এগুলির অর্থ আমার জানা নেই। বলা বাহুল্য, মাসের এসব নাম বাংলা সনে গৃহীত হয় নি। যেসব নাম চালু আছে, সেসব ভারতে বহুল প্রচলিত ‘শকাব্দ’, ‘বিক্রমাব্দ’ থেকে গৃহীত হয়েছে। পূর্বে সেসব উৎসসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
ফসলি হিজরি সারা ভারতের সব অঞ্চলের জন্য প্রযাজ্য হলেও মুঘল বাদশাহ্র মূল লক্ষ্য ছিল ‘সুবেহ বাঙ্গালা’র রাজস্ব সংগ্রহ। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম মিলে পূর্ব ভারতের বৃহৎ ভূখন্ডের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলার রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য বাদশাহ আকবরের নির্দেশে সভাসদ রাজা তোডরমর ভূমিজরিপের ব্যবস্থা করেন এবং জঙ্গল কেটে নতুন আবাদি ভূমির বিস্তার এবং কৃষির সম্প্রসারণ ঘটান। এদিকে এ অঞ্চলের চাষাবাদ ছিল ঋতুর ওপর নির্ভরশীল। কৃষক অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে প্রধান ফসল আমনধান এবং দুই মাসের ব্যবধানে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোরোধান ও চৈতিফসল ঘরে তোলে। ফসলের বিনিময়ে অথবা ফসল বিক্রয় করে অর্থের বিনিময়ে রাজস্ব আদায়ের উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে বেছে নেওয়া হয়।
আমরা পূর্বে বলেছি যে, বাংলা সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, রাশি ইত্যাদির উৎস ভারতীয় সৌরবর্ষ শকাব্দ। চলতি ১৪২৫ বঙ্গাব্দের মধ্যে প্রথম ৯৬৩ বছর হলো হিজরিভুক্ত চান্দ্রবছর, বাকি ৪৬২ বছর হলো সৌরবছর। বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করলে প্রথমটি যদি শিকড় হয়, তবে দ্বিতীয়টি হবে কান্ড। হিজরি সন ও শকাব্দের সমন্বিত ফল হলো বঙ্গাব্দ। শুধু কান্ড নয়, ডালপালা, পাতা, ফুলফল সবই শকাব্দের অবদান। শিকড় থাকে মাটির নিচে, যা দেখা যায় না। কান্ড থাকে মাটির ওপরে, যা প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হয়। আমাদের ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে শকাব্দের প্রভাব বেশি।
শুধু উৎস নয়, বাংলা সন ও শকাব্দের মাস-সপ্তাহের নামগুলোও অভিন্ন। মাসের উৎস ও নাম হলো একই নামের ভিন্ন ভিন্ন তারা বা নক্ষত্র। সাপ্তাহিক বারের উৎস ও নাম থেকেও বোঝা যায় যে, এগুলি একই নামের গ্রহ-উপগ্রহ থেকে গৃহীত হয়েছে। রবি বা সূর্য নক্ষত্র, সোম বা চন্দ্র উপগ্রহ, অবশিষ্ট মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি হলো বিভিন্ন গ্রহ। এককথায়, শকাব্দকে আত্মসাৎ করেই বঙ্গাব্দের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি। এ রীতিতে সূর্যোদয় থেকে দিনের সূচনা হয়।
খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে বঙ্গাব্দের সম্পর্ক: ৯৬৩ হিজরি সন ফসলি হিজরির কেবল প্রতিষ্ঠার বছর নয়, এটি তার আয়ুষ্কালও বটে। তখন খ্রিস্টীয় সন ছিল ১৫৫৬। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ৫৯৩ বছর। খ্রিস্টাব্দ থেকে বঙ্গাব্দ ৫৯৩ বছর কম হয়। উভয় সৌরবছর হওয়ায় এরূপ ব্যবধান (২০১৮-১৪২৫= ৫৯৩) আজও অটুট রয়েছে; এর কোনো হেরফের হয় না। শুধু খেয়াল রাখতে হয়, উভয় সনের বছরের শুরু একই সময় হয় না। ১৪২৫ সনের ১লা বৈশাখ ছিল ২০১৮ সালের ১৪ই এপ্রিল; আবার ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারি ছিল ১৪২৪ সনের ১৭ই পৌষ।
উভয় বছরের দিন-সংখ্যা অভিন্ন হলেও সব মাসের দিন-সংখ্যা অভিন্ন নয়, কিছু হেরফের আছে। এপ্রিল, জুন, সেপ্টেম্বর, নভেম্বর ৩০ দিনে এবং জানুয়ারি, মার্চ, মে, জুলাই, আগস্ট, অক্টোবর ও ডিসেম্বর ৩১ দিনে মাস হয়। ফেব্রুয়ারি ২৮ দিনে, লিপ ইয়ার বছরে ২৯ দিনে মাস হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯৬৭ সালে সংশোধিত যে বাংলা বর্ষপঞ্জী প্রণীত হয় ১৯৮৭ সালে তাই সরকারিভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। এতে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস ৩১ দিন, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও চৈত্র ৩০ দিন নির্ধারণ করা হয়। যে বছর লিপ ইয়ার বা অতিবর্ষ হয়, সে বছর চৈত্র মাস হয় ৩১ দিনে।