স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছরেও জাতীয়তা প্রশ্নে নিষ্পত্তি ঘটেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বিতর্কে গোটা জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষের জাতিগত পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয়তা পরিবর্তিত হয়েছে বারবার। স্বাধীনতা-পূর্ব বিগত দুই শতাব্দীতে ব্রিটিশ ভারতে এ দেশের মানুষ ভারত ও পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্তে¡¡র ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও পরবর্তী সময়ে ভারতের সকল জাতি, উপজাতি ও ভাষাভাষীর মানুষের জাতীয়তা নির্ধারিত হয় ভারতীয় হিসেবে। অন্যদিকে পাকিস্তানে মুসলিম জাতীয়তার পরিবর্তে সকল ধর্ম ও ভাষাভাষী জাতি-উপজাতির জাতীয় পরিচিতি ঘটে পাকিস্তানি হিসেবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষেরই রয়েছে নিজস্ব জাতীয়তা। ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, স্বাধীনতার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থানসহ নানাবিধ উপাদানের সমন্বয়ে পূর্ণতা পায় জাতীয়তা। শুধু ভাষার ওপর ভিত্তি করে জাতীয় পরিচিতির বিকাশ ঘটতে পারে না।
জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি স্বতন্ত্র জাতি গঠনের প্রধান মৌলিক উপাদান। এই জাতীয়তাবাদ হতে হবে এক ও অভিন্ন। দ্বিমুখী জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব নিয়ে দেশ ও জাতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। একক জাতীয়তাবাদের সবগুলো উপদান বা বৈশিষ্ট থাকা সত্তে¡ও জাতীয়তা প্রশ্নে অমূলক বিতর্ক চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। নৃতাত্তি¡কভাবে আমাদের জাতীয়তাবাদের এ পরিচিতি হাজার বছরের। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন জাতিরাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছে। অভ্যুদয় ঘটেছে একটি নতুন জাতির। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের আগে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের যে অঙ্কুর সৃষ্টি হয় বৃক্ষাকারে পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বে তাকে করা হয়েছে বিকৃত ও বিতর্কিত। নতুন জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকদের জাতীয়তার নামকরণ ও সংজ্ঞা নির্ধারণ করা নিয়ে নতুন করে যে সমস্যা শুরু হয়, তা এখনো চলছে। একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পরিচয় কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক বাঞ্ছনীয় না হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের এই দুটি সমান্তরাল ধারায় হাঁটছে বিভক্ত জাতি। চলমান এ সমস্যা অনুধাবন করতে পারলেও রাজনৈতিক কারণে এর সমাধানে আগ্রহী নয় একটি পক্ষ। স্বাধীনতা-পূর্ব আমাদের সকল আন্দোলন-সংগ্রাম বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি-অবাঙালি সকল নাগরিকের জাতীয়তা বাঙালি হতে পারে না। একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কোনো বিকল্প নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভিমত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবে যেমন ভ্রান্ত ও অবাস্তব, তেমনি অসাড় রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সত্যিকার এবং পুুরোপুরি জাতীয় পরিচয়ের সুযোগ নেই। এতে বহুজাতিত্বের প্রশ্নটি উঠে আসে। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যে কয়েক কোটি বাঙালির বসবাস। তাদের কি বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব? বাংলা ভাষাভাষী, এমনকি আচার-আচরণে অনেকটা মিল থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জাতীয়তা ভারতীয়। তাদের জাতীয় পরিচয় ভারতীয় হিসেবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী জনগণ ও বাংলাদেশের জনগণের মাঝে স্পষ্ট কোনো পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। আর এখানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাড়তা প্রমাণিত। এক ভাষায় কথা বললেও বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাবাদর্শ অভিন্ন নয় বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পরস্পরবিরোধী। এই দুই অঞ্চলের পার্থক্য চিরন্তন। এই প্রভেদ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনধারা, দর্শন ও সাধনার, মননের-মানসের, ধর্মের-কর্মের, ঐতিহ্যের-উত্তরাধিকারের, আবেগের-অনুভ‚তির, খোরাকের-পোশাকের, আদবের-লেহাজের, নামের-নিশানের, কায়দা-কানুনের, জীবনবোধের। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ কোনোভাবেই আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি হতে পারে না। ভাষাই যদি জাতীয়তাবাদের একমাত্র এবং প্রধান বাহন হতো, তাহলে আরব সাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর, লোহিত সাগর থেকে ভ‚মধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত আরবি ভাষাভাষী দেশগুলোর জাতীয় পরিচয় হতো এক ও অভিন্ন। কিন্তু তা হয়নি। প্রতিটি আরব দেশের রয়েছে পৃথক জাতীয় পরিচয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের নাগরিকদের মাঝেও বিভেদ বিভক্তির সীমারেখা টেনে দিয়েছে। বাঙালি ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশে দুই ডজনেরও অধিক উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের জাতীয়তা যদি বাঙালি হয়, তাহলে উপজাতীয় নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় কী হবে? তারা তো বাঙালি নয়। বহির্বিশ্বেই-বা তাদের পরিচয় কী। পাসপোর্টে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয় বাংলাদেশি হলেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টি বারবার টেনে আনা হচ্ছে। একটি জাতির দ্বিমাত্রিক পরিচয় থাকতে পারে না। বিদেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে বাঙালিদের আমন্ত্রণ জানানোর একটি রেওয়াজ চলছে ইদানীং। এতে ভারতীয় বাঙালিরা আমন্ত্রিত হলেও বাংলাদেশের নাগরিক উপজাতীয়রা বাঙালি না হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অযোগ্য থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া স্বাধীনতার চার দশক পরও একটি শ্রেণি শুধু বাঙালির অর্জনের কথা বলে চলেছেন। তাদের মতে সবকিছুই বাঙালির জন্য। এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তা-ই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অবস্থান কোথায়? তারাও তো বাংলাদেশের নাগরিক। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই দেশের এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে উপজাতীয়দের বসবাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়, স্বাধীনতায় উপজাতীয়দের কি কোনো অংশীদারি নেই। এমনিতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছে অস্থিরতা। বাঙালিরাই যদি জাতির সকল অর্জনের একক দাবিদার হয়, তাহলে উপজাতীয়রা তাদের স্বাধিকার অর্জনের জন্য বাঙালির নাগপাশ থেকে নিজেদের ছিন্ন করতে চাইলে তখন তাদের রুখব কীভাবে? এমন সব মৌলিক প্রশ্ন এবং সমস্যা এড়িয়ে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়োজন একটি স্থায়ী সমাধান। জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে স্বাধীন ও একক স্বকীয় সত্ত¡া। এই বৈশিষ্ট্যই বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের স্পষ্ট পার্থক্য চিহ্নিত করবে। এক অনন্য ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে এ বিষয়ে চ‚ড়ান্ত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এখনই সুবর্ণ সময়। আমরা জাতিগত ঐক্য চাই। রাজনীতিতে আমাদের মতের অমিল থাকবে। কিন্তু জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। বাগানের সব ফুল যেমন একই রং, গন্ধ, বর্ণের হয় না। ফুল ছাড়াও থাকে লতাগুল্ম। তারপরও সব মিলিয়ে বাগানের একটা ঐক্য থাকে। আমাদের জাতীয় ঐক্যও হবে অনেকটা বাগানের মতো। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বকীয়তা অবলুপ্ত হবে না। চিন্তা-চেতনা ও দর্শনে ভিন্নতা থাকবে। তার পরও জাতীয়তা ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় হবে এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাঙালির পাশাপাশি চাকমা, গারো-মারমা, খাসিয়া যে যার জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হবে। কিন্তু জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের পরিচয় হবে বাংলাদেশি।
Ñডা. ওয়াজেদ এ খান, সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ।