বাঙালি, বাংলা ভাষা ও ঠিকানা

হুসনে আরা : শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর সকালে তারই কল্যাণে এই নশ্বর পার্থিব অপরূপ ধরাধামে আসার সুযোগ হয়েছিল। তাকে দেখেছি জানা-অজানায়, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বৃষ্টিতে, কাক্সিক্ষত সৃষ্টি সুধামাখা উষালগ্নে ও দিবাসনে। আজকের এই আমিত্বের প্রকাশ তারই মাঝে অদৃশ্য এক মাপকাঠিতে। আমি কে? কী আমার পরিচয়? এই প্রশ্নের উত্তর তার মুখাবয়বের চিত্ররেখায় স্পষ্টই দৃশ্যমান। রাতের আঁধারে বুকের স্পর্শে মানুষ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসার গন্ধমাখা স্পর্শে একে অপরের হৃৎস্পন্দনে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে এই আমিত্বের। আমার একটা মা আছে আকাশের মতো। আকাশের মতো মায়ের সোদাগন্ধ মাখা আঁচলে মুখ লুকিয়ে আমাদের এ বিশ্ব দেখার প্রচেষ্টা। তারই কল্যাণে বিষবাষ্প আর বন্ধুর কাঁটা বিছানো পথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলা শান্তি আর প্রগতির পথে। মানুষ আর প্রকৃতিকে ভালোবাসা ধর্ম এ শিক্ষা তো মায়ের দেওয়া অহর্নিশ সাদামাটা কথার আবরণে। মনে পড়ে প্রচলিত সেকেলে ধারণাপ্রথম অ আ ক খ কলার পাতায় লিখতে শিখলে বিদ্যা আয়ত্তে আসে। আজও মনে পড়ে সেই সে মায়ের অহংকারী মিষ্টি মুখ। অসময়ে খেলতে যাবার অনুমতি পেয়ে মাকে ছুঁয়ে দেখার অনুভ‚তি। এক কিশোরীর গ্রামের আকাশপথ ধরে শহরমুখী ও পাশ্চাত্যমুখী শত পথঘাট নিঃসংকোচে ছুটে বেড়ানো তারই সতর্ক দৃষ্টির প্রহরায়।

স্বল্প পুঁথিগত বিদ্যা আর সশিক্ষায় শিক্ষিত মানবতার দীক্ষায় দীক্ষিত মহীয়সী সেই তারই আলাপন যেন জীবন চলার পথে আলোর মশাল। উঠতি বয়স, মধ্যবয়স এবং সকল বয়সকালেই আটপৌঢ়ে শাড়িজড়ানো হাস্যোজ্জ্বল সেই তো সব ঝড়ঝঞ্ঝা শত প্রতিক‚লতাকে তুচ্ছ করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহসের জন্মপাত্রী।

ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে তাই তো দেখা যায় বাঙালির সকল সংগ্রাম ছাপিয়ে এমনকি বাঙালির সকল সংগ্রামে তার চেতনার প্রকাশ। এই মায়েরা ছিল বলেই তো সাহসী যুবকেরা সকল ভয় তুচ্ছ করে মায়ের মুখের ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হয়েছিল আর সেই পথ ধরে স্বাধীনতা-সংগ্রামে জাতির পিতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কৃষক, শ্রমিক, যুবা, বৃদ্ধ থেকে সকল পেশার নারী-পুরুষ মানুষেরা আর ভয়ংকর সাগরের অতল থেকে বিজয় শব্দটি ছিনিয়ে এনেছিল। সেই সংগ্রামকালে বিভ্রান্ত একদল যুবক চেনা দরজায় হানা দিলে ভিতু মায়ের কঠিন হুংকারে তারা বলতে বাধ্য হয়েছিল, ‘এ বাড়ি নয়।’ মায়ের লম্বা জীবন বড় সুন্দর, বড় কঠিন। তাই তো বুঝি এই জীবনকে জড়িয়ে আমরা জীবনমুখী। জীবনে পথ চলায় মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভ‚মি তুমি আমাদের দিকনির্দেশক, উভয়দাতা। তাই তো আমরা আজ শুধু বাংলাদেশের বাঙালি নই, আমরা বিশ্ব বাঙালি-বিশ্বমানব।

হঠাৎ কখনো একখণ্ড মেঘ এসে তোমাকে আড়াল করে দিতে চায় কিন্তু সাধ্য কী সেই শ্রাবণ মেঘের। তুমি সূর্যসন্ধানী-সূর্যের আলোর মতো তুমি চির উজ্জ্বল।

আজ আমরা বাঙালিরা অনেকে স্বদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছি। আমাদের অনেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশের মানবতার পতাকা তুলে ধরেছে। এই ফেব্রæয়ারি মাস মাতৃভাষা রক্ষার মাস, নিজ ভাষা রক্ষার সাথে সাথে বিশ্বে সফল ভাষা রক্ষার দাবিদার ও সাফল্যের অধিকারী এই বাঙালি। এমনই এক তাৎপর্যপূর্ণ মাসে এই প্রবাসে জন্ম নিয়েছে নিজ ভাষার ধারক এবং তাৎপর্যপূর্ণ এক অগ্রসরমান বাহক ‘ঠিকানা’। স্বদেশ ছেড়ে প্রবাসে এসে আমাদের নিজ ঠিকানার সন্ধানে মহাসাগরের পারে গড়ে উঠেছে এই ‘ঠিকানা’। নিজ ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশের এক বাতিঘর এই ‘ঠিকানা’। প্রকৃত মুক্তির চেতনার প্রধানতম দুটি উপাদানÑগণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা। এই চেতনাকে ধারণ করে সুদীর্ঘকাল পথ চলবে প্রবাসে আমাদের এই ‘ঠিকানা’। একুশের জাতক এই ‘ঠিকানা’ আমাদের অদম্য সাহসের প্রতীক। তাই আমরা আজ শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে চাই ভাষা রক্ষাসহ সকল স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবনদানকারী সম্ভ্রম হারানো বীরদের। সেই সাথে আমাদের অহংকারের প্রতীক ‘ঠিকানার’ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তাদের প্রতি, যারা এই আলোকবর্তিকা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেদের জড়িয়ে আমাদের উজ্জ্বল করে চলেছেন। জয়তু ঠিকানা, জয়তু ঠিকানার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা, সেবক ও পাঠকদের প্রতি। ঠিকানা মা, মাটি আর মাতৃভাষার আকর হয়ে থাক।

হুসনে আরা : প্রাক্তন অধ্যাপক, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা।

নিউ ইয়র্ক।