বাংলাদেশ সরকার প্রতি অর্থবছরে বাজেট পেশ করে থাকে। বাজেট সরকারের পুরো একটি বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব। অর্থবছর শুরু হয় ১ জুলাই থেকে শেষ হয় ৩০ জুন। ১ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেন। ৩০ জুন সংসদে বাজেট গৃহীত হয়। একটি মাস বাজেট নিয়ে সংসদে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিছু সংশোধনী সংসদ গ্রহণ করে। তারপর সংশোধনীসহ ৩০ জুন ভোটের মাধ্যমে সংসদে বাজেট চূড়ান্তভাবে পাস হয়।
বাজেট কেমন হলো, কার লাভ, কার ক্ষতি, কার মুনাফা বাড়বে, কার সংকট বাড়বেÑবিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বিভিন্নভাবে কাটাছেঁড়া করেন। তবে সাধারণভাবে দেখা যায়, যারা ধনী ব্যবসায়ী, যারা পুঁজিপতি-শিল্পপতি, অনেক পুঁজির মালিক, তারা বাজেটকে যেভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, তার সঙ্গে যারা নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত, তাদের বিচার-বিশ্লেষণ কখনো মিলে না। সাধারণ গরিব মানুষের গায়ে বাজেটের তাপ প্রতিদিন অনুভূত হয়। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ‘আগুন’ প্রতিদিন তাদের পোড়ায়। তাদের পকেট খালি করে, বুকে হাহাকার তোলে।
বাংলাদেশে বাজেট নিয়ে প্রতিবছর একটি অভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে। এই প্রতিক্রিয়া মনে হয় বাজেট সংসদে তোলার আগেই ঠিক করে রাখা হয়। বাজেট পাঠ শেষ করার আগেই সরকারি দলের মানুষেরা সড়কে-মহাসড়কে আনন্দ মিছিল বের করে ফেলে। ওদিকে বিরোধী দল নানা আলোচনা-সেমিনারে সমালোচনা শুরু করে দেয়। সরকারি দল বলে, এর চেয়ে ভালো, জনবান্ধব, সময়বান্ধব বাজেট হয় না। আর বিরোধীরা বলতে শুরু করবে, বাস্তবতা-বিবর্জিত। কল্পনাবিলাস। গরিবকে আরো গরিব, ধনীকে আরো ধনী করার বাজেট। তবে অর্থমন্ত্রী আহম মোস্তফা কামাল বাজেট বাস্তবায়নে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
২০২৩-২৪ সালের বাজেটে একটু চোখ ফেরানো যাক। মোট বাজেটের অর্থ ৭ লাখ ৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এবারের বাজেট বড় রকমের ঘাটতি বাজেট। ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সরকার এই বড় রকমের ঘাটতি পূরণের উৎস দেখছে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট ঘাটতি বিদেশি অনুদান, সাহায্য থেকে সরকার আশা করছে পূরণ হবে। ঘাটতি পূরণের প্রত্যাশা সরকারের সবটুকু আটকে আছে ‘যদি’র মধ্যে। ডেমস্টিক ঘাটতি পূরণের আরেকটি উৎস ব্যাংক থেকে ঋণ। যার পরিমাণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা, অর্থাৎ ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এতে ব্যাংকের তারল্য সংকটের আশঙ্কা দেখা দেবে।
সিপিডি বাজেট আলোচনায় বলেছে, এই বাজেটে যেসব প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। অবাস্তব, অসম্ভব। বাস্তবতা-বিবর্জিত। অনেকেই মনে করেন, এবারের বাজেট আইএমএফের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই জনগণের ওপর করের বোঝা চেপেছে। এবারের বাজেটে যেমন পূর্ণাঙ্গ পেনশন স্কিম চালু করার প্রস্তাব রয়েছে, তেমনি করের আওতাও বেড়েছে। যেসব বিষয়ে সাধরণ মানুষের সম্পর্ক নেই, সাধারণ মানুষের ভোগের আওতার বাইরে, সেসব ক্ষেত্রেও করারোপ করা হয়েছে। আয়কর রিটার্নেও এবার প্রত্যেককে দুই হাজার টাকা করে গুনতে হবে। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের চাহিদাকে আঘাত করবে এবারের বাজেট। বাজারের অনেক ক্রেতা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, এত দিন মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যতালিকা কাটছাঁট করতে হয়েছে, এবার তালিকা থেকে অনেক পণ্য ছেঁটে ফেলতে হবে। এদিকে মুদ্রাস্ফীতির যে হার ৬ শতাংশ ধরা হয়েছে, সেটাও অর্জন করা সম্ভব হবে না। ফলে সাধারণ মানুষ, যাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা, তাদের এবার পান্তায় হয়তো লবণও জুটবে না।
এবারের বাজেট নির্বাচনী বছরের বাজেট। অন্যান্য নির্বাচনী বছরের বাজেট সাধারণত যতটা জনবান্ধব হওয়ার কথা, বাজেট বিশ্লেষক অনেকেই মনে করছেন, এবারের বাজেট ঠিক ততটা জনবান্ধব হয়নি। তবে এক মাস আলাপ-আলোচনা, যাচাই-বাছাই, কাটছাঁট শেষে, সব সংশোধনী শেষে চূড়ান্তভাবে যে বাজেট পাস হবে, তখন বলা যাবে কতটা জনবান্ধব বাজেট পাস হলো। সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে নাকি তাদের অস্বস্তি বাড়বে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কতটা স্মার্ট বাজেট মানুষ পেল।