বাফেলোতে শ্বেতাঙ্গ তরুণের ‘ব্ল্যাকহক অপারেশন’, নির্বিচার গুলিতে নিহত ১০

অনলাইনে সরাসরি হত্যাকাণ্ড দেখিয়েছে হামলাকারী

ঠিকানা রিপোর্ট : নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৩৭৩ মাইল (৬০০ কিলোমিটার) দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তের কাছে নিউইয়র্ক রাজ্যের বাফেলো শহরে কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত জেফারসন অ্যাভিনিউর একটি সুপার মার্কেটে বর্ণবাদী হামলায় গুলিতে কমপক্ষে ১০ জন নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছে। পেইটন জেনড্রন নামে ১৮ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ এক তরুণ ১৪ মে শনিবার বেলা আড়াইটায় বাফেলো’র চেইন সুপারমার্কেট ‘টপস’-এ ঢুকে শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এ হত্যাযজ্ঞ চালায়। একটি ক্যামেরার মাধ্যমে সে পুরো হত্যাকাণ্ড অনলাইনে সরাসরি দেখিয়েছে।
এদিকে বন্দুক হামলা শুরুর এক মিনিটের মধ্যে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সুপার মার্কেটে পৌঁছতে সক্ষম হলেও হামলাকারীকে তাৎক্ষণিক নিবৃত্ত করা যায়নি। শক্তিশালী ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ‘ব্ল্যাকহক’ গেম স্টাইলে নির্বিচারে মার্কেটের ক্রেতাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় সে। ঘটনার ছয় মিনিট পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। নিহতদের রক্তে ভেসে যায় সুপার মার্কেটের বিভিন্ন ফ্লোর। মার্কেটের অন্য ক্রেতাদের তাৎক্ষণিক নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের আগে শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী পেইটন এস জেনড্রন অনলাইনে বিদ্বেষপূর্ণ একটি লেখা পোস্ট করেন। ১৮০ পৃষ্ঠা ওই লেখায় পুরোটাজুড়েই বারবার বোঝানো হয়েছে যে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা অন্য বর্ণের মানুষের সংখ্যাধিক্যের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পেইটন এস জেনড্রনের এই কৃষ্ণাঙ্গবিদ্বেষ নতুন নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত বছরের জুনে তরুণটি একটি হাইস্কুলে হামলার হুমকি দিয়েছিল। এ ঘটনা জানাজানি হলে তাকে মানসিক পরীক্ষা করানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে থাকা একজন তরুণ কীভাবে এই হামলা চালাতে সক্ষম হলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। উল্টো পুলিশ এখন বলছে, পেইটন এস জেনড্রন হামলার আগের দিন ঘটনাস্থল রেকি করেছে!
বাফেলো শহরের পুলিশ কমিশনার জোসেফ গ্রামাগলিয়া সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, নির্বিচার গুলিতে ১৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। আহত তিনজনই কাজ করতেন সুপার মার্কেটে। তাদের আঘাত প্রাণ-সংহারী নয়। নিহতদের মধ্যে সুপার মার্কেটটিতে নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ সদস্যও আছেন, যিনি নিহত হওয়ার আগে হামলাকারীর ওপর গুলি চালানোর চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা গেছে।
হামলাকারী পেইটন এস জেনড্রন কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে বাফেলো শহরের কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত জেফারসন অ্যাভিনিউতে পৌঁছায় বলে মনে করা হচ্ছে। হামলাকারী শক্তিশালী বন্দুক বহন করা ছাড়াও বর্ম ও হেলমেটে পরা ছিল। পরে ওই শ্বেতঙ্গ তরুণ অস্ত্র সমর্পণ করলে তাকে আটক করা হয়।
এদিকে শনিবারই শ্বেতাঙ্গ হামলাকারী পেইটন জেনড্রনকে আদালতে হাজির করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রথম মাত্রার হত্যাকাণ্ড (ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার) সংঘটিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে হামলাকারীর যাবজ্জীবন কারাভোগ করতে হতে পারে। হামলাকারীর বিরুদ্ধে পরে আরও কিছু অভিযোগ আনা হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল তদন্ত সংস্থা’র (এফবিআই) বাফেলো ফিল্ড অফিসের স্পেশাল এজেন্ট স্টিফেন বেলনগিয়া এ ঘটনাকে ‘সহিংস উগ্রবাদী’ কর্মকাণ্ড হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা একে বিদ্বেষমূলক অপরাধ ও বর্ণবাদ-অনুপ্রাণিত সহিংস উগ্রবাদী ঘটনা উভয় আলোকেই তদন্ত করছি।’
হামলার সময় দোকানে কাজ করা শনেল হ্যারিস সংবাদমাধ্যমকে জানান, পেছনের দরজা দিয়ে ভবন থেকে দৌড়ে পালানোর সময় তিনি ৭০টিরও বেশি গুলির শব্দ শুনেছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় সুপার মার্কেটে বিপুল ক্রেতা ছিলেন। হামলার সময় ওই শ্বেতাঙ্গ যুবক বর্ণবাদী স্লোগানও দিয়েছিল।
বাফেলো’র মেয়র বায়রন ব্রাউন বলেন, কোনো কমিউনিটির জন্য এটা সবচেয়ে বাজে দুঃস্বপ্ন। আমাদের কষ্ট হচ্ছে, হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। এই ঘৃণিত ব্যক্তি আমাদের কমিউনিটিকে বিভক্ত করবে, এমনটা হতে দিতে পারিনা আমরা।’ তিনি বলেন, সন্দেহভাজন ওই তরুণের লক্ষ্যই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা। যত বেশিসম্ভব কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হত্যা করতে চেয়েছিল সে।
এ ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোকুল। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এটা সামরিক কায়দায় লোকজনকে হত্যা, যেখানে এমন মানুষজনকে টার্গেট করা হয়েছে, যারা কেবল এলাকার দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, সবাই কী জানত এবং তারা কখন সেগুলো জানতে পেরেছিল, আমি সেসব তথ্য জানতে চাই।
নিউইয়র্কের অ্যাটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমস জানিয়েছেন, তারা অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া উগ্রবাদী কনটেন্টে মনোযোগ দেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি নিহত ও তাদের প্রিয়জনদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। হোয়াইট হাউজ থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে।
বাফেলো শহরে বিপুল প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করেন। সুলভে বাড়ি কেনা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ায় করোনা মহামারীর পর নিউইয়র্ক ও আশেপাশের শহর থেকে বহু বাংলাদেশি সেখানে স্থানান্তর হয়ে বসতি গড়েছেন। তবে যে স্থানে এই সহিংস ঘটনা ঘটেছে সেই জেফারসন অ্যাভিনিউ এলাকাটি কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত। এই এলাকার অদূরেই বাংলাদেশিদের বসবাস। ঘটনার সময় কোনো বাংলাদেশি ওই সুপারমার্কেটে ছিলেন না। তবে এ ঘটনার পর প্রবাসী বাংলাদেশিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নিউইয়র্ক শহরে থাকা তাদের স্বজনরাও ছিলেন উদ্বিগ্ন।
বাফেলো’র এরি কাউন্টির বাসিন্দা বাংলাদেশি জহিরুল ইসলাম স্বপন বলেন, তার বাসার অদূরে টপস সুপারমার্কেটে এ হামলার ঘটনায় তার পরিবারে আতঙ্ক নেমে এসেছে। তিনি বলেন, ‘স্বাচ্ছন্দে পরিবার নিয়ে বসবাস করবো বলে নিউইয়র্ক শহর থেকে বাফেলো স্থানান্তর হলাম। এখন দেখছি কোথায় গিয়ে শান্তি নেই। গত কয়েকদিন ধরে নিউইয়র্ক সিটিতে একের পর সন্ত্রাসী ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। এখন নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসরত স্বজনরা আমাদের নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। সন্তানদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় লাগবে, বলেন জহিরুল।