ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :
হঠাৎ করেই যেনো নিত্যদিনের রুটিন কাজের ব্যতিক্রম ঘটলো! বিকেল বেলায় মায়ের প্রতিদিনকার নির্দেশ ছিলোÑ খেলাধুলার পর সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ফিরে হ্যারিকেনগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, তেল কমে গেলে তাতে কেরোসিন তেল ঢালা, ফিতা পুড়ে ছোট হয়ে গেলে তা কিছুটা উপরে তোলা ইত্যাদি। এরপর হাত-মুখ ধুয়ে মায়ের মাগরিবের নামাজ শেষ হলেই দাওয়ায় পাটি পেতে এবং একটা হ্যারিকেন জ্বেলে স্কুলের পড়া শেখা। কিন্তু আজ একটু অন্যরকম নির্দেশ আসায় আমার একটু অবাক হবারই কথা!
মা হুকুম করলেন
-ছোটকা! বড় কাঠের বাক্সটা খুলে তোর বাবার বন্দুকটা বের করে একটু পরিষ্কার করে রাখতো।
-তা না হয় করলাম মা! কিন্তু হঠাৎ করে বন্দুক পরিষ্কার করতে বলছো কেনো, তা তো বললে না? আমি কারণটা জানতে চাইলাম মায়ের কাছ থেকে।
উত্তরে মা বললেন
-তোর মেজ ভাই কাল-পরশু খুলনা থেকে বাড়িতে আসবে। চাঁটগাইয়া মুরগির বাচ্চাগুলোকে একটা চিল প্রায়ই ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে যায়! ভাবছি ছালাম বাড়িতে এলে ওকে বলবো চিলটাকে গুলি করে মারতে। তাইতো তোকে বলছি বন্দুকটা পরিষ্কার করে রাখতে।
মায়ের কথা শুনে মনে মনে বেশ আনন্দ পেলাম। মায়ের আঁচল থেকে চাবির গোছাটা চেয়ে নিয়ে বন্দুকটা বের করলাম। তারপর এক টুকরো শুকনো ন্যাকড়া আর কেরোসিন তেল দিয়ে ভালো করে বন্দুকটাকে পরিষ্কার করে রাখলাম। যথাসময়েই মেজ ভাই বাড়িতে এলেন। সদ্য খনন করানো পুকুরটা দেখা, গুহদের ভিটেয় থাকা একতলা দালানটা ভেঙে কড়ে-বর্গাগুলো খুলনায় নেয়াসহ আরো কীসব কাজকম নিয়ে বাবার সাথে পরামর্শ করাই ছিলো মেজ ভাইয়ের গ্রামে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু মায়ের মুখে চিল (বাজপাখি)-এর জ্বালাতনের কথা শুনতে পেয়ে মেজ ভাই বললেন
-দাঁড়াও মা! ব্যাটা চিলকে মজা দেখাচ্ছি! তুমি বাচ্চাসহ মুরগিটাকে উঠোনে খাবার দেবার ব্যবস্থা করো।
সম্ভবতঃ তখন আষাঢ় মাস। আকাশটা মেঘে ঢাকা। মাঝে মধ্যে দু-এক পশলা বৃষ্টিও হচ্ছে। দেখা গেলো চিলটা আমাদের বড় নারিকেল গাছের আগায় একটা পত্রশাখের উপর বসে তীক্ষè দৃষ্টিতে উঠোনে খাদ্যরত মুরগি ও তার সঙ্গের ৪/৫টা ছোট বাচ্চাকে লক্ষ্য করছেÑ কখন ঝোঁপ বুঝে ছোঁ মারা যায়! মেজ ভাই বন্দুকে গুলি ভরে আমাদের বড়ঘরের পশ্চিম দিককার বারান্দায় বসে বাজপাখিটাকে তাঁক করে গুলি ছুড়লেন। আর যায় কোথায় বেচারা চিল? গুলি খেয়েই ধপাস করে নারিকেল গাছের নিচে মাটিতে পড়ে গেলো!
এা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন
-যাক বাবা! এবার বাঁচা গেলো। চাঁটগাইয়া মুরগির বাচ্চাগুলো একটু বোকা ধরনের। চিলে ছোঁ মারলে দৌড়ে পালাতেও পারে না। আট-আটটা বাচ্চা ফুটিয়েছিলাম রে বাবা! অর্ধেকটাই গেছে চিলের পেটে!
বন্দুকের আওয়াজ শুনে আশেপাশের বসতবাড়ি থেকে উৎসুক অনেকেই এসে জড়ো হলো আমাদের ভিতর বাড়ির উঠোনে। মহিলাই বেশি, এর সাথে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছাড়াও কিশোর-যুবকরা দু-চারজন একত্রিত হয়েছে। এদের মধ্য থেকে জাহিদ (নন্টু) ভাইয়ের বাল্যবন্ধু শেখ মহর আলী বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কারণ, সে মেজ ভাইকে খবর দিলো
-চাচাজান! রায়গে পুকুর পাড়ের বটগাছটায় ঝাঁকে-ঝাঁকে হরেল ঘুঘু আসতেছে বটের ফল খাতি। পাখি শিকার করবেন না কি?
-তাই না কি? খুব ভালো খবর তো! তা হরিয়াল পাখিরা বটগাছে কখন বসে?
মেজ ভাই মহরকে জিজ্ঞাসা করলেন।
-আমি রায় গে পুকুর পাড়ে যাইয়ে পেথম দেহে (দেখে) আসে (এসে) আপনারে জানাবানি।
মহর জবাব দিল।
মহর তার কথামতো পরদিন দুপুর বেলা অমাদের বাড়িতে এসে খবর দিলো যে, বেশ কয়েকটি হরিয়াল পাখি বটের ফল খাচ্ছে এখন। মেজ ভাই খবরটা শুনেই বন্দুকে চার না আট নং গুলি ঢুকিয়ে জাহিদ ভাই আর মহরকে সঙ্গে নিয়ে রায়দের পুকুরের দিকে রওনা হলেন। আমি বয়সে ছোট বলে আমাকে সঙ্গে নিলেন না।
টিপ-টিপ বৃষ্টির শব্দের মধ্যে প্রায় আধা বা পৌনে এক ঘন্টা পর দূও থেকে একটা গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। মনে মনে আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে, হরিয়াল ঘুঘু দেখতে কেমন তা জীবনে এই প্রথম দেখতে পাবো! কিছুক্ষণ পরেই শিকারির দল বাড়িতে ফিরে এলো। জাহিদ ভাইয়ের হাতে একটা চটের থলি ঝুলানো। আর মহরের হাতে বাবার বন্দুকটা। মেজ ভাই খালি হাতে, লুঙ্গি পড়া অবস্থায় অনেকটা বীরের মতোই হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে এসে ঢুকলেন।
থলিটা রান্নাঘরের দাওয়ায় উপুড় করে ঢেলে দেয়ার পর দেখলাম মোট তিনটা অপূর্ব সুন্দর হরিয়াল ঘুঘু। আসলে এরা এক প্রকারের সবুজ কবুতর। কারণ, এদের পাগুলো হলুদ রংয়ের, গলার দিকটা কমলাটে-হলুদ। এদের ঘাড়ের উপর ধূসর-লম্বা দাগচিহ্নই এদেরকে চিনবার জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
যা হোক, শিকার করা তিনটা হরিয়ালের মধ্যে একটাকে মা দিয়ে দিলেন মহরকে। বেশ খুশি হয়েই পাখিটাকে হাতে নিয়ে বলতে লাগলো
-দাদিজান! গুলি খাইয়ে চার-চারডা পাহি পড়িছেলো। কিন্তু এট্টা জঙ্গলের মধ্যি পড়ায় আমরা খুঁজতি খুঁজতি দেহি ওডারে শিয়েলে ধরে নিয়ে গেছে!
-কী আর করবা? যা কপালে ছিলো, তাই-ই পাইছো! আল্লাহ্র কাছে শোকর করো। একটাও যদি না পাইতা, তাহলে কি করতা?
মহর আর কথা না বাড়িয়ে একটা হরিয়াল পাখি নিয়ে খুশি মনে বাড়িতে চলে গেলো।
বছর গড়িয়ে শীতকাল আসতে শুরু করেছ। মাঠের ফসল কাটা শেষ। রাতের বেলায় ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুগুলি সকালের রোদে চিকমিক করতে থাকে। রাতের শেষ প্রহরের দিকে কিছুটা শীত লাগে। খুব সম্ভব তখন কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস। মেজ ভাই জমিজমার কীসব কাজ সম্পন্ন করতে আবার গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। জাহিদ ভাই তাঁকে খবর দিলো যে, নলডাঙার বিলে বেশ কয়েকদিন যাবৎ দু-দুটা বিরাট আকারের শামুকখোলা বা মদনটাক্ পাখি পড়ছে। খবরটা জানতে পেয়েই মেজ ভাই পাখি শিকার করতে যাবেন বলে মনস্থ করলেন। সঙ্গে নিলেন জাহিদ ভাইকে। রাতের শেষ প্রহরে দু’জন বের হলেন বন্দুক নিয়ে। অবশ্য এ খবরটা আমার জানার কথা ছিলো না। কারণ, আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
কিন্তু সকাল ১০-১১টার দিকে রান্নাঘরে কিছুটা হৈচৈ শুনে এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের মেঝের উপর চোখ পড়তেই বুঝতে পারলাম যে, পাখি শিকার অভিযান সফল হয়েছে। জাহিদ ভাই মাকে বলছিলো কীভাবে হামাগুড়ি দিয়ে বন্দুক নিয়ে কাদা পানির মধ্যে এগুতে হয়। দুইটা শামুকখোলা খাবার খুঁজছিলো। কিন্তু মেজ ভাই কেবলমাত্র একটাকেই গুলি করতে পারলেন, অন্যটা উড়ে গেলো!
লক্ষ্য করলাম যে, পাখিটা দেখতে অনেকটা বকের মতোই। পা দুটো বেশ লম্বা, ডানা ও পালকের রঙ ধূসর, বকের মতো সাদা নয়। এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এর বড় মাথা, যা পালক শূন্য অবস্থায় নগ্ন দেখতে। সম্ভবতঃ এজন্যই পাখিটির অন্য একটি নাম হয়েছে ‘মদনটাক্’।
যা হোক, পাখিটির মাংসের পরিমাণও বকের তুলনায় অনেক বেশি। কমপক্ষে আড়াই/তিন কেজি পরিমাণ মাংস হয়েছিলো শিকার করে আনা পাখিটির। কিন্তু দুঃর্ভাগ্যবশত আমরা খেতে বসে ভাগে তেমন একটা পাইনি! কারণ, মা অধিকাংশ পরিমাণ মাংসই ভুনা করে একটা পাতিলে সরিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। পরদিন মেজ ভাইয়ের সাথে তাঁর বাসা খুলনায় পাঠাতে!