বাবা এবং আমি

ডাঃ সওকত আরা বীথি

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে আমাদের সময়ে সাধারণত হিন্দু পরিবারে পিতাকে “বাবা” বলে ডাকা হত। আর মুসলমান পরিবারে আমরা “আব্বা” বলে ডাকতাম। আমি আমার আব্বার দ্বিতীয় সন্তান। সত্যিকার অর্থে দ্বিতীয় নয়, তৃতীয় সন্তান। অর্থাৎ আমার আগে এক পুত্র সন্তানের মৃত্যুর দু বছর পর আমার জন্য । অবশ্য, মেজ মেয়ে নামেই পরিবারে আমার অবস্থান। এর বোধ হয় একটা কারণ আছে। কারণ আমরা বোনেরা, ভাইদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলাম- – নয় বোন তিন ভাই। তাই বোধ হয় বোনদের অবস্থান অনুযায়ী পরিবারে নামকরণ হয়েছে আমার এবং আমার পরবর্তী বোনদেরও। আমার আগের যে ভাইটি এই পৃথিবীর আলোবাতাস গ্রহণের সুযোগ পেলনা,তার মৃত্যুও বড় করুণ। আম্মার কাছে শুনেছি , একদিন ঘুম ভেঙে আম্মা দেখতে পান তার কোলের শিশুটি আর এ পৃথিবীতে নেই। আজ বুঝতে পারি, এক কিশোরী, অনভিজ্ঞ মায়ের সন্তান হারানোর ব্যথা কতখানি বেজেছিল মায়ের প্রাণে। অনভিজ্ঞ মাই ,বলব , কারণ চৌদ্দ বছর বয়সে যদি একটি মেধাবী কিশোরী মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ে দেয়া হয় এবং পরের বছরই মা বনে যান; তারপর আবার দু বছরের মাথায় দ্বিতীয় সন্তান এসে পড়ে তখন সংসারে অনাবশ্যক সমস্যার জন্ম হয়ে থাকে। কারণ হাত দিয়ে ত হাতি ঠেলা যায়না। তদ্রƒপ অভিজ্ঞতা ছাড়া ঘর-সংসারের পাশাপাশি সন্তান-সন্ততি সামলানো যায়না। তদুপরি সে আমলে সর্বত্রই একান্নবর্তী পরিবার ছিল । বিয়ের পর শ্বশুর, শাশুড়ী, ভাসুর, জা, দেওর ননদের বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের মাঝে এসে নিজের দু শিশুর দেখাশুনার সময় কতটুকু পেতেন সেটাও ভাবার বিষয় । আমার সে ভাইটি নিশ্চয়ই অসুস্থ ছিল । তার চিকিৎসা সময়মত করা গিয়েছিল কিনা, রোগের তীব্রতা কতখানি ছিল, এসব বোঝার ক্ষমতা আমার কিশোরী মায়ের সম্ভবতঃ ছিলনা। আমার ভাইটি বুঝি তাই অভিমান করে চলে গেল এই পৃথিবী ছেড়ে ।
এর দু বছর পর আমি এলাম এ পৃথিবীতে। আমার আগমনে যে নিশ্চয়ই কেউ খুশী হয়নি আমি তা বেশ বুঝতে পারি। তবে আম্মা আব্বা একথা স্বীকার করতেন না। একে তো ছেলের মৃত্যুর পর মেয়ের আগমন তদুপরি মেয়েটির গায়ের রং শ্যামলা। আমাদের দেশে শ্যামলা মেয়েদের আদর-কদর একটু কমই। সে যাহোক আমি ধীরে ধীরে বড় হলাম। আমাদের সময়ে পরিবারে অবস্থান অনুযায়ী ভাইবোনের মর্যাদার তারতম্য ছিল। বড় ভাই এবং বোনদের খবরদারি করার অধিকার ছিল। আবার কোন একজনকে সংসারের প্রয়োজনে বাইরে যাবার কাজটি করতে হত । যেমন, আম্মা বললেন ‘লবণ ফুরিয়ে গেছে, বীথি- দোকান থেকে একসের লবণ কিনে নিয়ে আয় ‘। আবার হয়ত কখনও বা হুকুম হল- “ওষুধের দোকান থেকে কয়টা মাথা ব্যথার বড়ি কিনে নিয়ে আয়”। হ্যানিম্যান ফার্মেসী নামের একটি ফার্মেসীতে একজন নামকরা হোমিওপ্যাথী ডাক্তার ছিলেন, আব্বার বন্ধু। সুতরাং ছোট ভাইবোন অসুস্থ হলে, কোলে নিয়ে আমি তাঁর কাছে চলে যেতাম । তিনি খুব আন্তরিকভাবে রোগী দেখে ওষুধ দিয়ে দিতেন । খুব ভাল মানুষ ছিলেন। আব্বার মেয়ে হিসাবে বাড়তি আদরও পেতাম সবার কাছ থেকে। আমার আব্বা অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন ।
সংসারে আরও কিছু দায়িত্ব ছিল আমার। সংসারের দায়িত্ব সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়, একথা শিখেছি আমরা সেই ছেলেবেলা থেকেই। সন্ধ্যেবেলায় নিজের স্কুলের পড়া তৈরি করার সাথে সাথে ছোট ভাইবোনদের পড়া তৈরিতে সাহায্য করতে হত। এসব কাজ আমাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয়ই ছিল। তবে বাইরে যাবার কাজগুলো কেন আমাকেই করতে হত, সেটা একটু বুঝিয়ে বলছি: প্রচলিত নিয়মে বাইরে যাবার কাজটি সাধারণত বাড়ির ছেলেদের উপরই বর্তাত। কিন্তু আমাদের সংসারে তখন ছেলের আগমন বেশিদিন হয়নি। যখন আমার বয়স আট/ নয় হবে । আমার বড়বোন আমার চেয়ে চার বছরের বড়। অর্থাৎ বার / তের বছরের কিশোরী । বড় হয়ে উঠছে । সুতরাং তাকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতে দেওয়া হবেনা। দোকানে তো নয়ই । আবার আমার পরে ছোট বোন, আমার তিন বছরের ছোট। অর্থাৎ সে আবার বেশি ছোট। অগত্যা বাড়ির বাইরে যাবার কাজগুলো আমার জন্য বরাদ্দ থাকত । এবার আমার আব্বার সাথে ছেলেবেলার আনন্দময় দিনগুলোর একটি আনন্দদায়ক স্মৃতিচারণ করছি।
সে সময় অফিসের সময়সূচি ছিল, সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত । আমার আব্বা সকাল বেলা একবারে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে বাজার করে দিয়ে যেতেন। সঙ্গে নিতেন আমাকে। কেনাকাটা শেষে আমাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে, তারপর আব্বা অফিসে যেতেন। বাজার সওদার আগে প্রথমেই আমি আর আব্বা একটা খাবার দোকানে ঢুকতাম নাশতা খাবার জন্য। সাধারণতঃ গরম গরম লুচি, অথবা পরাটা সাথে সন্দেশ অথবা বুন্দিয়া দিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে খাওয়া হত। আব্বা বেশ ভোজনরসিক ছিলেন। বেশ মনে পড়ে, একজনের আয়ে চলা এতগুলো ভাইবোনের সংসারে খাবারের কোন স্বল্পতা কখনও টের পাইনি । কেমন কওে তা সম্ভব হত আজও বুঝিনা। আমিও আমার আব্বার মত ভোজনরসিক। দেখতেও অনেকটা আব্বারই মত । যে কেউ দেখলেই জিজ্ঞেস করত, ”তুমি বুঝি কাশেম সাহেবের মেয়ে?” আমিও গর্বের সাথে মাথা নাড়তাম । যাহোক, বাবার সাথে বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে আমিও খুব আনন্দ পেতাম। সে সময়ে তো ভেজালের দিন ছিলনা। ব্যাগ ভর্তি টাটকা শাকসবজি, মাছ মাংস, ফল মূল দেখতে খুব ভাল লাগত। কেনাকাটা শেষে আব্বা আমাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিতেন । তারপর বাড়িতে এসে আম্মার কাছে বাজারের ব্যাগ হাওলা করে দিয়ে আমার ছুটি ।
মা বাবার সাথে ছেলেবেলার এ সকল মাধুরিমন্ডিত অতীত স্মৃতি সকলকেই বুঝি এমন করে পিছু ডাকে । সে সব দিনে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানটির কথা ও সুর ভেসে আসে মনের মুকুরে । আমার আব্বাও বুঝি, আমাকে দেয়া তাঁর প্রিয় নামটি ধরে ডেকে বলছেন,” আয় ‘মিনি’ আয়, বাজারে যেতে হবে, অফিসের দেরী হয়ে যাবে যে!“
আমিও যেন শুনতে পাই সে ডাক। দেখতেও পাই যেন , আবসা অন্ধকারে সেইসব দৃশ্যপট , যেখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয় সর্বক্ষণ।
– মিনেসোটা।