বাবা মায়ের বিচ্ছেদ সন্তানকে করে অসহায়

হাসিনা আকতার নিগার :

দুজন মানুষ বিয়ে নামক সম্পর্ক দিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সেখানে সুখস্বপ্ন ছাড়া কিছুই থাকে না। কিন্তু আবেগ আর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কখনো কখনো বিচ্ছেদ শব্দটাই জীবনের সব রং মুছে দেয়। দুজন মানুষের মিলনে যেমন অনেক দায়বদ্ধতা থাকে, তেমনি বিচ্ছেদে সে দায়বদ্ধতার ভার অনেক বেশি বইতে হয়।

প্রেমের আছে নানা রূপ, নানা রং। তাই আবেগময় জীবনে দুজন মানুষের সম্পর্কের পরিপূর্ণতা পায় তাদের সন্তান দিয়ে। সে সন্তান তার বাবা-মা থেকে শেখে পরিবারের প্রতি পারস্পরিক ভালোবাসা, মায়া-মমতা। জানে জগৎকে।

যখন একটি পরিবারের কান্ডারি বাবা-মায়ের সম্পর্ক তিক্ততাতে পরিণত হয়, তখন সেখানে নেমে আসে ভয়াবহ পরিবেশ, যাতে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় সন্তানেরা। সে অবস্থায় তাদের কাছে প্রশ্ন হয়ে যায়, বাবা ভালো না মা ভালো? কারণ দুজনই পরস্পরের প্রতি ঝগড়া আর দোষারোপের কাদা-ছোড়াছুড়ি করে সন্তানের সামনে। আলাদা হওয়ার কথা আসে। তখন সন্তান ভাবে, বাবা-মাকে নিয়ে এক ঘরে থাকা হবে না আর। তাহলে সে কার সঙ্গে যাবে?

এই যে প্রশ্নগুলো সন্তানের মনে জাগে, এর প্রভাব সারা জীবন বয়ে বেড়ায় সে। সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটে সন্তানকে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সবখানে শুনতে হয় ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চা’। কিন্তু দুজন মানুষের অমিলের মাঝে সন্তান নিয়ে টানাটানি করার আগে তাদের নিজেদের ভাবা উচিত, আমরা আমাদের সন্তানদের মানসিকভাবে কতটা ক্ষতি করছি।
এ অবস্থায় পরিবারে সন্তানদের সামনে কলহ-বিবাদ না করে তাদেরকে বাস্তবতা বোঝাতে হবে। তৈরি করতে হবে আগামী দিনের বৈরী পরিবেশের মাঝে বড় হতে। একজন সন্তানের কাছে বাবা বাবাই মা মা-ই। সে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ার আগে জীবনের অনেক কিছুই বুঝবে না। তাই সন্তানকে কেউই মিথ্যা দিয়ে কিছু না বোঝানোই শ্রেয়। বরং একটা স্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে তাকে সুযোগ দিতে হবে সব বুঝতে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব পারিবারিক জটিলতায় সন্তানেরা বিপথে যায়। তারা তাদের মতো করে বাঁচার পথ খুঁজে নেয় মাদক কিংবা অন্য কোনোভাবে বিপথে গিয়ে। একজন মা-বাবার জন্য এটা জীবনের চরম কষ্টের হয়। যার থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকে না।

না, তাই বলছি না সন্তানের মুখ চেয়ে নিজেদের অমিল নিয়ে এক ঘরে থাকতে হবে। তার চেয়ে অনেক উত্তম নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে বিচ্ছেদ হয়ে স্বাভাবিক জীবন বেছে নেওয়া।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে দেখা যায়, এ বিচ্ছেদের ঘটনায় সন্তানকে সালিস এমনকি আদালতে নিয়ে যায় তার থাকার বিষয় জানতে। যেখানে ছেলেমেয়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে, তাও তাদের মুখে শুনতে হবে সবকিছু। একবার কি কেউ চিন্তা করে দেখেন, আদালতের বারান্দায় বা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সন্তানের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যায়। কিংবা আগামী জীবনে সে পরিবার শব্দটির প্রতি কতটা বীতশ্রদ্ধ হবে এ ঘটনা থেকে।

আইনিভাবে বিচ্ছেদের মামলায় সন্তানদের আবেগ-ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়ে চেষ্টা করে সংসার ভাঙন করতে। বাংলাদেশের আদালতে বেশ কিছু মামলায় ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ রোধের চেষ্টা করেছে এবং সফল হয়েছে। এসব মামলায় ছেলেমেয়েদের আবেগময় কান্নায় বিচারকও চোখের জল ফেলেছেন, যা গণমাধ্যমে অনেকটা সিনেমার গল্পের মতো দেখছে পড়ছে সবাই। আদালত বাবা-মাকে অনুরোধ করছে সন্তানদের প্রতি সদয় হতে।

এমন পরিস্থিতিগুলোতে বাবা-মা কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা হয় সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু তাদের প্রতি সন্তানদের করুণ চাহনির অন্তরালে বিষাদের জীবনের ছায়া বোঝে না হয়তো কেউ। এমনকি বাবা-মা দুজনের কেউই একবার ভাবতে পারে না আজ তাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রথম শিকার তাদেরই সন্তানেরা। আদালত হয়তো আইনগত অধিকার দিতে পারবে কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা কারও কমাতে পারবে না। তাই আইনে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর সন্তানের অধিকারসহ সকল বিষয়ে বিধিবিধান থাকার পরও সন্তানকে আদালতে হাজির না করার বিষয়টা মানবিকভাবে বিবেচনা করা দরকার।
কথায় বলে, জোড়াতালি দিয়ে আর যা-ই হোক সংসার হয় না।’ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও নিজেদের বোঝাপড়ার নাম হলো সংসার। সে সংসারে সন্তান হলো দুটি মানুষের অস্তিত্বের প্রতীক, সংসারের বিকশিত রূপ। তাই সম্পর্কের মাঝে যখন বিচ্ছেদ হানা দেয়, তখন সন্তানদের হাতিয়ার করে নিজেদের প্রতিহিংসার প্রকাশ না ঘটানোই শ্রেয়। সন্তানের জন্মে বাবা-মায়ের নিজেদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঠিক একইভাবে বাবা-মায়ের প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব সন্তানদের সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবন গড়া। তাদের ভুলে গেলে চলবে না বিচ্ছেদ নামের শব্দটি দিয়ে সবার আগে বিপর্যস্ত হয় তাদেরই সন্তানদের জীবন। তাই আইনগত ও সামাজিক অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সন্তানদের স্বচ্ছ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বাবা-মাকে। কারণ তাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের দায় সন্তানদের নয়। সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের ভালোবাসা শর্তহীন। কে ভালো কে মন্দ, তা বোঝার মতো মন অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের থাকে না।

লেখক : কলামিস্ট।