বাসের ভেতরে রুদ্ধশ্বাস ৮ মিনিট

তামিমের মুখে সেদিনের ঘটনা

এখনও চোখ বুজলে সেই বীভৎস দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসে তার। দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। তামিম মনে করেন, মানসিক এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে আরও অনেক সময় লাগবে তাদের। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে। ক্রিকইনফোকে দেওয়া সেদিনের সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়েও তামিমের গা কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মৃত্যুর দুয়ার থেকে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড দূরে দাঁড়িয়ে দেখা তার সেদিনের গা হিম করা অভিজ্ঞতার কথা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

স্পোর্টস রিপোর্ট : আগে একটু বলে নিই সেদিন বাসে ওঠার আগে কী ঘটেছিল। তাতে পুরো ঘটনা বুঝতে সুবিধা হবে, কীভাবে দুই থেকে তিন মিনিটের জন্য আমরা সবাই বেঁচে ফিরেছি। সাধারণত জুমার নামাজে মুশফিক ও রিয়াদ ভাই খুতবার সময় উপস্থিত থাকতে চান। সে কারণেই আমরা নামাজের একটু আগে সেখানে পৌঁছাতে চাইছিলাম। আমাদের জন্য যে বাসটি অপেক্ষা করছিল, তার সময় দেওয়া ছিল বেলা দেড়টা। কিন্তু রিয়াদ ভাই তার আগে সংবাদ সম্মেলনে চলে যান। সেখানে কিছু সময় দেরি হয়। সেখান থেকে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে সে যখন ড্রেসিংরুমে আসেন তখন সেখানে আমরা কয়েকজন ফুটবল খেলছিলাম। তাইজুল ফুটবলে হারতে চাইছিল না, কিন্তু অন্যরা তাকে হারানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সেখানে তাইজুল আর মুশফিক ওয়ান টু ওয়ান লড়ে যাচ্ছিল। ওখানে কিছুটা সময় দেরি হয়ে যায় আমাদের। এসব ছোট ছোট কিছু কারণে সময় দেরি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই বেঁচে যাই। তারপর আমরা সবাই মিলে মসজিদে যাওয়ার জন্য বাসে উঠি। আমাদের প্ল্যান ছিল মসজিদ থেকে সোজা হোটেলে ফিরে যাব। সে কারণেই আমাদের সঙ্গে বাসে উঠে বসে শ্রী (শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন, টিম অ্যানালিস্ট) আর সৌম্য সরকার। যেহেতু সেদিন অপশনাল প্র্যাকটিস ছিল, তাই যারা কি না অনুশীলন করবে না তারা হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আর যারা অনুশীলন করবে বলে ঠিক করেছিল, তারা চাইছিল নামাজ শেষ করে মাঠে ফিরে আসবে।

আমি সব সময় বাসে বাঁ-দিকের ছয় নম্বর সিটে বসে থাকি। সেদিনও সেখানেই বসেছিলাম। যখন আমাদের বাসটি মসজিদের খুব কাছাকাছি এসে গেছে তখন ডান দিকের জানালার ধারে বসে থাকা কয়েকজন উঁকি মেরে কিছু দেখছিল। আমিও সিট থেকে উঠে গিয়ে দেখতে যাই কী হয়েছে। দেখি একটি মানুষ রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে আসে। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, কেউ হয়তো মদ্যপ অবস্থায় ওভাবে শুয়ে আছে। বাস তখনও চলছিল। কিন্তু অনেকে তখনও ওই রাস্তায় শুয়ে থাকা লোকটির দিকেই তাকিয়ে ছিল। এরপরই আমার চোখে পড়ে রাস্তায় আরেকটি লোকের দিকে। লোকটি রক্তাক্ত ও আহত ছিল। সেখান থেকেই আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের বাসটি মসজিদের সামনে একটি গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে থেমে যায়। দেখতে পাই আমাদের বাসচালক এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। কাঁপা কাঁপা গলায় মহিলাটি কাঁদছিলেন। তিনি আমাদের বলতে থাকেন- সামনে গোলাগুলি চলছে, ওদিকে যেও না, ওদিকে তোমরা যেও না। আমাদের বাসচালক ওই মহিলাকে বলতে থাকেÑ বাসের সবাই মসজিদে যাবে। তখন ওই মহিলা বলতে থাকেনÑ না, না, মসজিদে কিছুতেই যেও না। গোলাগুলি মসজিদেই চলছে। আমরা সবাই মহিলার কথাগুলো শুনতে পাই। আমরা তখন মসজিদ থেকে মাত্র কুড়ি পা দূরে ছিলাম। সাধারণত ওই দূরত্বটুকু আমরা বাস থেকে নেমে এমনিতেই হেঁটে যাই। দেখতে পাই, মসজিদের সামনে ও আশপাশে আরও কিছু রক্তাক্ত শরীর পড়ে আছে।
যখন আমরা বুঝতে পারি লোকগুলো মৃত, তখন বুঝতে পারছিলাম না, আমাদের ঠিক কী করতে হবে। বাসের মধ্যে যারা টুপি পরেছিল তারা সেগুলো খুলে রাখে। যারা পাঞ্জাবি পরেছিল তারাও গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে নেয়। ওই মুহূর্তে আর কিছুই মাথায় আসছিল না। আমরা সবাই বাসের পাটাতনে মাথা নিচু করে বসে পড়ি। ওভাবে মাথা গুঁজে সাত থেকে আট মিনিট ছিলাম। তখনও কেউ জানতাম না ঠিক কী হচ্ছে, তবে এটুকু বুঝতে পারি মসজিদে কোনো সহিংস কিছু ঘটেছে। সবার মধ্যে ভীষণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমাকে দেখুন, ঠিকভাবে এখন কথাও বলতে পারছি না। আমরা বাসচালককে বলতে থাকি এখান থেকে বাস সরিয়ে নিন। কিছু একটা করুন, কিন্তু সে বাস সরাচ্ছিল না। সবাই তখন চিৎকার করে তাকে বলতে থাকে, বাস ঘুরিয়ে নিতে। আমিও চিৎকার করে বলতে থাকি, বাস পেছনের দিকে নিয়ে যেতে। ওই সাত থেকে আট মিনিট কোনো পুলিশ সেখানে ছিল না।

এরপর পুলিশ দেখতে পাই আমরা এবং তাদের স্পেশাল ফোর্স পুরো মসজিদ ঘিরে রাখে। আমরা সবাই তখন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। আমার পুরো শরীর ঠা-া হয়ে যায়। দেখতে পাই মসজিদের ভেতর থেকে আরও আহত রক্তাক্ত মানুষ বেরিয়ে আসছে। ওই মুহূর্তে আমাদের কারও ওপরই কারও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমরা আর্তনাদ করতে থাকিÑ আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কেউ বলছিল, আমরা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে যদি গুলি করে। কেউ কাঁদছিলÑ আমরা বাসের মধ্যে থাকলে মারা যাব। আমারও তখন মনে হয়েছিল, বাস থেকে বেরোতে পারলে হয়তো বাঁচতে পারব। আমাদের বাসটি আক্রমণকারীর বড় টার্গেট হতে পারে; কিন্তু আমরা তখন কোথায় যাব। বাসের সব দরজাই তখন বন্ধ।

কোনো কারণে বাসচালক আরও ১০ গজ সামনে নিয়ে যায় বাসটিকে। আমি জানি না কেন সে সেটা করেছিল। চূড়ান্ত একটা পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। কিছু একটা করতেই হতো। আমরা তখন বাসের দরজা ধাক্কাতে থাকি, লাথি মারতে থাকি এবং সেটা দেখে বাসচালক বাসের মাঝের দরজাটি খুলে দেয়।
আমার মনে হয়, প্রায় আট মিনিট পর আমরা বাস থেকে বেরোতে পারি। সবাই বলতে থাকে পার্কের মাঝ দিয়ে হেঁটে স্টেডিয়ামে ফিরে যাই। কেউ কেউ বলতে থাকে, পার্কের মাঝ দিয়ে দৌড় শুরু করি। তখন পাশ থেকে কেউ আরেকজন বলছিল, আমরা যদি পার্কের মাঝ দিয়ে দৌড়াতে থাকি তাহলে সহজেই টার্গেটে পড়ে যাব। পরের মুহূর্তেই আমার মাথায় আসতে থাকে, আমরা যদি ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে থাকি তাহলে পুলিশও ভুল বুঝতে পারে। সব দিক থেকেই ঝুঁকি ছিল। তখনই দেখতে পাই আপনারা তিন সাংবাদিক (বাংলাদেশি সাংবাদিক) এ দিকে আসছেন। সত্যি কথা বলতে কী, আপনাদের দেখে তখন সাহস ফিরে পাই। তখন দ্রুত পায়ে সবাই হাঁটতে থাকি।

ওই ঘটনার পর প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের এক আতঙ্কে কেটেছে। আমি দলের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, তারাও সবাই একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভালো ব্যাপার এই যে, সবার মুখেই এখন কিছুটা হাসি ফিরেছে। তবে বিশ্বাস করুন, বাসের মধ্যে ওই মুহূর্তে আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম।
আমরা টিম হোটেলে ফিরে সবাই রিয়াদ ভাইয়ের রুমে যাই। টিভিতে দেখতে থাকি ওই বন্দুকবাজ কীভাবে গুলি চালাচ্ছিল মসজিদের মধ্যে। ওই দৃশ্য দেখেও কাঁদতে থাকে ক্রিকেটাররা। ড্রেসিংরুমে ফিরেও কাঁদছিল অনেকে। একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, এই ঘটনার মানসিক ধাক্কা কাটাতে অনেক সময় লাগবে। আশা করি, প্রত্যেকের পরিবার সেটা কাটাতে সাহায্য করবে। আমাদের এখন কাউন্সেলিং দরকার। এখনও আমি চোখ বন্ধ করলে ওই দৃশ্যগুলো দেখতে পাই। হোটেলে ফিরে আমরা কেউ একা একা ঘুমাতে পারিনি। ছোট ছোট দল হয়ে আমরা একসঙ্গে ঘুমিয়েছিলাম। আমি, মিরাজ আর সোহেল ভাই (দলের ম্যাসাজ বয়) একসঙ্গে ছিলাম। রাতেও স্বপ্ন দেখছিলাম- ওই লোকগুলো বাইকে গোলাগুলি করছে।
হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট ফিরতে ফিরতে আমরা একে অন্যের সঙ্গে বলাবলি করছিলাম- যদি আমাদের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটত, তাহলে আজ আমাদের মৃতদেহগুলোই দেশে ফিরত। আমরা কেউ আর এভাবে দেশে ফিরতে পারতাম না। মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জন্য আমরা বেঁচে ফিরলাম।