আব্দুল হাই রঞ্জু
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাকশিল্পের পরের স্থানটি ধরে রেখেছে প্রবাসী আয়। খাত দুটির আয়ের ওপর নির্ভর করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির সে ধারা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। যদিও দীর্ঘদিন ধরেই রেমিট্যান্স প্রবাহে নিম্নমুখী প্রবণতা জেঁকে বসেছিল। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কম ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নমুখিতার জন্য দায়ী ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অস্থিরতা ও তেলের মূল্যপতন এবং দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য কমে আসা। এ ছাড়া ব্যাংকের তুলনায় খোলাবাজারে ডলারের মূল্য বেশি থাকায় ভিন্নপথে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ঢোকায় রেমিট্যান্স কম এসেছে। আবার মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহারে হুন্ডিওয়ালারা অবৈধ পথে টাকা দ্রুত প্রবাসীদের আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় এ ধারায় নেতিবাচক প্রবাহের রেশ সহসা কাটছেও না। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার আর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, দক্ষ জনশক্তির অভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ও আগস্টে ১৪১ কোটি ৮৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। পরবর্তী মাস সেপ্টেম্বরে হঠাৎ রেমিট্যান্স কমে দাঁড়ায় মাত্র ৮৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলারে। তবে এ নেতিবাচক প্রবাহে পরিবর্তন এসে অক্টোবরে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। নভেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১২১ কোটি ৪৭ লাখ ডলারে। এটি অক্টোবর মাসের চেয়ে ৫ কোটি ১৯ লাখ ডলার বেশি, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ কোটি ৩৩ লাখ ডলার বা ২৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে গড় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে। তবে শঙ্কার কারণ হচ্ছে, দালালদের হাত ধরে নানা প্রলোভনের কারণে অদক্ষ কর্মীদের বিদেশ গমন, যা আগেই বলেছি। দালালদের মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠানোসংক্রান্ত ‘দ্য হোমকামিং প্রোফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্রান্ট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীকর্মীর ৫১ শতাংশই দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি জমায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও সাম্প্রতিক সময়ে এক হাজার ২০০ জন প্রবাসী বাংলাদেশির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হওয়া মোট শ্রমিকের ৮০ দশমিক ৬ শতাংশই যাচ্ছেন দালাল ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে। পক্ষান্তরে দেশের প্রায় এক হাজার ৩০০ জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অভিবাসী হচ্ছেন মাত্র ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আর সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রবাসে যাচ্ছেন মাত্র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকারিভাবে বিদেশ গমনের এ হার যে উদ্বেগের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিদেশ গমনেচ্ছুকদের বাড়তি টাকা ব্যয় করতে না হয় এবং জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়রানির মুখে পড়ে যেন প্রতারিত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয়, সে উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফলে বেশ ক’বছর প্রবাসীদের অন্যতম কর্মক্ষেত্র মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় জনশক্তি রপ্তানির হার তলানিতে এসে দাঁড়ায়। মূলত সরকারের লক্ষ্য ছিল, জিটুজি পদ্ধতিতে জনশক্তি রপ্তানি করা সম্ভব হলে প্রতারণার আধিক্য কমে আসবে এবং সরকারিভাবে বিপুল পরিমাণ কর্মী বিদেশে পাঠানো সম্ভব। কিন্তু সরকারি সে উদ্যোগে শতভাগ সফলতা আসেনি বরং প্রবাসে যাওয়ার পথে নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার জিটুজি পদ্ধতির পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিলে অচলাবস্থা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। ফলে জনশক্তি রপ্তানির হার বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যেই যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, এখন বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশ গমন প্রতি বছরই কমবেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সূত্রমতে, ২০১৫ সালে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছে, যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জনে। আর ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৩ জন বাংলাদেশি। জনশক্তি রপ্তানির ইতিবাচক এ ধারা আমাদের জন্য খুশির সংবাদ।
মূলত জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করায় বেশ ক’বছর ধরে অবৈধ পথে বিদেশ পাড়ি জমানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। কক্সবাজার রুটে দালালদের দৌরাত্ম্যও বৃদ্ধি পায়। দলে দলে কর্মপাগল যুবশক্তি দালালদের হাত ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিঙায় উঠে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসিকতাকে আলিঙ্গন করে। এ পথ বন্ধুর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তা জেনেও শুধু এককু কাজের স্বপ্ন নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে কতজনকেই না ট্রলার ডুবে সলিল সমাধির শিকার হতে হয়েছে। আর ভাগ্যগুণে কেউ কেউ সাগর পাড়ি দিলেও মাসের পর মাস জঙ্গলে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে কাজের সন্ধান করতে হয়েছে। আবার কেউ কেউ অবৈধ অভিবাসীর অপরাধে বিদেশের কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এটাই দুর্ভাগ্য, দেশের এবং আপনজনদের মায়ামমতা ছেড়ে যারা বিদেশে গিয়ে কাজ করে রুটিরুজি করতে চায়, তাদের সেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাটুকু আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরা নিশ্চিত করতে পারে না। অথচ বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনার মানবসম্পদকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে দেশে অর্থনীতিকে মজবুত করা সহজ হবে। অর্থাৎ আমাদের দেশের মানবসম্পদই সমৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র অবলম্বন। শুধু পুরুষদের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের নারীরাও এখন বিদেশে পাড়ি দিতে প্রস্তুত। যদিও নিরাপত্তাজনিত নানা অভিযোগে এখন দেশের নারীরা বিদেশ গমনে অনেকটা বিমুখ হচ্ছেন। সরকার প্রবাসে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে এ হার আরও প্রসারিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেহেতু দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী সেহেতু প্রবাসে নারীদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্রকে নিশ্চিত করতে সরকারকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাস্তবে আমরা কথায় যতটা পটু, কাজে ততটাই ফাঁকিবাজ। বিশেষ করে বিদেশে নারীদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের তরফে এ ক্ষেত্রে সামান্য শৈথিলতা প্রবাস গমনে নারীদের নিরুৎসাহিত করলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের পদচারণা সংকুচিত হবে, যা আমাদের গোটা অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে না। মোদ্দ কথা, বাংলাদেশের বিপুল মানবসম্পদের যথাযথ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে দেশকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব।
আব্দুল হাই রঞ্জু : কলাম লেখক