
নিজস্ব প্রতিনিধি : বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটগুলোর মধ্যে ভাঙনের সানাই বাজতে শুরু করেছে। জোট গঠিত হওয়ার ছয় মাস যেতে না যেতেই সমমনা বলে কথিত দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা, এমনকি ভাঙনের সুর বাজতে শুরু করেছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেছেন, সরকার বিরোধী জোট ও দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করছে। সরকারের পতন ঘটিয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি নস্যাৎ করার জন্যই তাদের এই অতৎপরতা। বিএনপি সরকার ও সরকারি দলের ওপর দায় চাপানোর যে চেষ্টা করছে, তা সঠিক ও বাস্তবসম্মত নয় বলে সরকারদলীয়রা মনে করেন। তাদের মতে, এসব দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ থেকেই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে মাস কয়েক আগেও জোট আর ছোট ছোট দলগুলোর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিএনপির নেতৃত্বাধীন এসব জোট যুগপৎ আন্দোলনের শুরুর দিকে ছিল আলোচনায়। একে একে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে ৫৪টির মতো দল। জোটের এ বহর নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকেও শুনতে হয়েছে টিপ্পনী। কয়েকটি কর্মসূচির পর এখন জোটগুলোর তেজ ও ধার কমেছে। জোটের মধ্যে দেখা দিয়েছে মান-অভিমান। দুয়েকটি দল ইতিমধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। আর যুগপৎ আন্দোলনের প্রধান বিএনপি তাদের এসব কার্যক্রম পর্যালোচনা করছে। দলটির ভাষ্য, এখনো চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়নি। এর আগে যারা দৌড়ে টিকে থাকতে পারবে, পরবর্তী সময়ে তারাই থাকবে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে মতানৈক্যের কারণে ১২ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লেবার পার্টি। জোটের প্রধান সমন্বয়কারী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দারকে চিঠি দিয়ে দলটি এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
জানা গেছে, নিকট প্রতিবেশী ভারতকে সন্তুষ্ট করে তাদের আস্থা অর্জনের মুখ্য উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ২০ দলীয় জোট থেকে বাইরে রাখা হয়। জামায়াতের সঙ্গে গভীর সমঝোতায় তাদের নেতৃত্বে নেজামে ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত মজলিসসহ সমমনা অপর বেশ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন নিয়ে পৃথক জোট গঠন করা হয়। সাতটি বাম গণতান্ত্রিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতন্ত্র মঞ্চ। আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, জোনায়েদ সাকীর গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নুরুল হকের গণঅধিকার পরিষদ, রফিকুল ইসলামের ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও হাসনাত কাইয়ূম নামের একজনের বিপ্লবী রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এতে রয়েছে। এসব দলের অধিকাংশের কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। নামে মাত্র থাকা কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই। পারিবারিক সদস্য, নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক শুভানুধ্যায়ী ছাড়া তেমন কোনো সমর্থকও নেই। রাজনৈতিকভাবে এরা যে কতটা দুর্বল, অসহায় তা বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের সরকার অপসারণের আন্দোলনে অভাবনীয় দুর্বলতা যেকোনো একটি দলেরও জোটগত কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল না। দর্শকদের জন্য রাখা চেয়ারগুলোও তারা ভরতে পারেনি। এ দুরবস্থা কাটিয়ে সামনের কর্মসূচি কী করে অধিকসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের অংশগ্রহণে সফল করা যায়, তা নিয়ে মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির নেতারা দলগুলোর সঙ্গে দলগত ও জোটগত বৈঠক করেছেন। দলগুলো আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করলেও বিএনপির নেতাদের হতাশা দূর হয়নি।
জেএসডির আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের মান্না, অধিকার পরিষদের নুরুল হকের দেশে-বিদেশে যোগাযোগ, সরকারি মহলের সঙ্গে অপ্রকাশ্য সম্পর্ক নিয়ে জোটের মধ্যেই সংশয়, সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। এ ব্যাপারে আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার আন্দোলন ও নির্বাচন-সংক্রান্ত বক্তব্যে জোট ও বিএনপির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তারা নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বড় ধরনের ভুল হবে বলেও মন্তব্য করেছেন বলে বিএনপির নেতৃস্থানীয় সূত্রে জানা যায়। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের বিদেশে অবস্থান, রহস্যজনক তৎপরতা, বিশেষ করে ইসরাইলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনার বিষয় নিয়ে জোট থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা এড়িয়ে যান। বাহ্যত তিনি সরকারবিরোধী কঠোর অবস্থান দেখালেও ভেতরের চিত্র তা নয় বলেই জানা যায়। জোনায়েদ সাকী দুই দফা মেয়র নির্বাচন করে জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচন নিয়ে তার গভীর আগ্রহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করছে। অন্যদিকে জামায়াত, হেফাজতসহ আরো কয়েকটি ইসলামি সংগঠনের বিএনপির সরকার অপসারণের আন্দোলন নিয়ে কেন্দ্রীয় এবং জেলা, উপজেলার নেতাদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের বৃহত্তর অংশ বিএনপির সঙ্গে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে। তারা শক্তিও প্রদর্শন করেছে। তবে আন্দোলন কোন পথে নিয়ে যাওয়া হবে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে কি না, তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন ও শঙ্কা রয়েছে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যেই। এ অবস্থায় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি মহল স্বস্তিদায়ক অবস্থায়ই রয়েছে এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা এগিয়ে যাচ্ছে।