
নূরুল ইসলাম : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই বর্জন করে। তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পুরো পাঁচ বছর নির্বিঘ্নে পার করে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে অংশ নেয় বিএনপি। ওই নির্বাচনেও বিএনপির ভরাডুবি হয়। ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মহাজোট পায় ২৮০টি আসন। ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন আর অন্যান্য দল পায় ১১টি আসন। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ উঠলেও পাঁচ বছর ক্ষমতার প্রায় শেষ প্রান্তে আওয়ামী লীগ।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের মহাসংকটে বিএনপি। ২০১৪ সালের মতো এবারও বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তবে নির্বাচনে না গেলে বিএনপিসহ ৫৪ দলে ভাঙন দেখা দিতে পারে বলে বিএনপিরই বড় একটি অংশ মনে করছে। তাদের মতে, দ্বাদশ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাতে না পারলে বিএনপির সামনে ২০১৪-এর মতো আরও একটি পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাদের আশঙ্কা, সরকার উপরে উপরে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বললেও আসলে তারা বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছে। বিএনপি যাতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, সে পথ তৈরি করছে। তবে দলের অস্তিত্ব বাঁচাতে ও ভাঙন রোধে একাদশের মতো নির্বাচনে যেতে পারে বলেও ধারণা দলটির বড় একটি অংশের।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আদালতের নির্দেশে নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দলটির প্রতীক ‘সোনালি আঁশ’। নিবন্ধন পাওয়ার পর ২০ ফেব্রুয়ারি দলটির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর নাজমুল হুদার স্ত্রী সিগমা হুদা জানান, ‘বড় মেয়ে অন্তরা ইতিমধ্যে রাজনীতির ময়দানে আছে। প্রয়োজনে সে বাবার দলের দায়িত্ব নেবে। এত লড়াই-সংগ্রামের পর যখন তৃণমূল বিএনপি নিবন্ধন পেয়েছে, এই দল চলবে।’ এ ঘটনায় বিএনপির আশঙ্কা, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে তৃণমূল বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারে সরকার। দলটির কিছু নেতাকে চাপ দিয়ে বা লোভ দেখিয়ে তারা নির্বাচনে নিতে পারে। প্রয়োজনে কিছু আসনও ছাড় দেবে। বিএনপি মনে করছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ থাকায় সরকার তৃণমূল বিএনপির প্রভাবশালী কিছু নেতাকে আসন দিয়ে ভোটে নিয়ে যাবে। একই সঙ্গে ৫৪ দলের শীর্ষ কিছু নেতাকে কয়েকটি আসন দিয়ে শেষ সময়ে নির্বাচন করাবে। এতে করে পশ্চিমা দেশগুলো যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে, সেটি পূর্ণ হয়ে যাবে, ভোটে গ্রহণযোগ্যতা থাকবে।
এদিকে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল। তখন ৩৯টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৭টি দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। বিএনপিসহ ১২টি দল সেই সংলাপের আমন্ত্রণ নাকচ করেছিল। তখন থেকেই ইসির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনে কূটনৈতিক অঙ্গন থেকে চাপ আসে। ইসি কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় জোর দিয়ে বলেছিল, কাউকে ভোটে আনা তাদের দায়িত্ব নয়, রাজনৈতিক আর কোনো সংলাপও করবে না তারা। এমন দৃঢ়তার মধ্যেও নির্বাচন সামনে রেখে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপিকে গত ২৩ মার্চ ফের চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যদিও ২৮ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপিকে আলোচনার জন্য দেওয়া আমন্ত্রণপত্রে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে ইসি কোনো চিঠি দেয়নি। বিএনপিকে দেওয়া ওই পত্রে সংলাপের কথা উল্লেখ করা হয়নি, বরং অনানুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য চিঠি দিয়েছে ইসি।
এ বিষয়ে বিএনপি ও দলটির বুদ্ধিজীবী মহল মনে করছে, সরকার জানে বিএনপিকে আলোচনায় ডাকলে এ মুহূর্তে সাড়া মিলবে না। তাই নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বিএনপি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায় না-এ বিষয় বিদেশি কূটনীতিকদের হয়তো দেখাতে চায় নির্বাচন কমিশন ও সরকার। তাদের মতে, সরকারের এমন আচরণগুলোতে স্পষ্ট, বড় ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে। সরকার বিএনপিকে মুখে মুখে ভোটে অংশগ্রহণের কথা বলছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা চাচ্ছে বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে। এ জন্য তারা বিএনপির তৃণমূলে ভাঙনের চূড়ান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিএনপিকে ভোটের প্রস্তুতি, জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা এবং যেকোনো মূল্যে সরকারের অধীনে ভোট ঠেকিয়ে দলের অবস্থান মজবুত রাখতে নীতিনির্ধারণী ফোরামকে চতুরতা দেখাতে বলেছেন তারা।
এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক হুইপ জয়নুল আবেদীন ফারুক বলেন, ‘সরকার আমাদের দল ও জোট ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে। তবে আমাদের নেতা তারেক রহমান যে পলিসিতে রয়েছেন, তাতে সরকারের পরিকল্পনা সফল হবে না। অবশ্যই তারেক রহমান সফল হবেন। সরকারের ষড়যন্ত্র ভেসে যাবে। বিএনপি অবশ্যই জনগণের সমর্থনে আবারও নেতৃত্ব দেবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ভোট ছাড়া ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত সরকার। তারা অনেক কূটচাল করে যাচ্ছে। এটি জনগণ হতে দেবে না, আগামী নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না, সবাইকে এক থাকতে হবে।’
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি সংলাপে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না। কারণ, বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে। এ বিষয়ে ইসির কিছু করার নেই। এটি সরকারের বিষয়। বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করার সংলাপ ছাড়া অন্য কোনো আলোচনায় অংশ নেবে না। নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে রাজনৈতিক দলকে সংলাপের চিঠি দেওয়া সরকারের নতুন কৌশল মাত্র।