বিএনপি : আশায় আশায় দিন যায়

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

নতুন করে আন্দোলনে তেজ বা টেম্পু তোলার চেষ্টা করছে বিএনপি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও সংসদ বিলুপ্ত করাসহ ১০ দফা দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ সেই চেষ্টার অংশ মাত্র। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। এবারই প্রথম বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের কোনো শীর্ষনেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাদের মধ্যে শুধু কুশলবিনিময় হয়েছে, রাজনীতি বা চলমান আন্দোলন নিয়ে কোনো কথা হয়নি- এমনটি মনে করার কারণ নেই। মান্নার সঙ্গে বেগম জিয়ার বৈঠকের আগে, বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা দলটির চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এর দুদিন বাদে গত ১৭ মে, সন্ধ্যায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি জানানো হয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে দিয়ে।

সুদিনের আশায় সোয়া যুগ পার হতে চলেছে বিএনপির। ক্লান্ত হতে হতে নিরাশ হয়; কিন্তু হাল ছাড়ে না। এর মধ্যেই দেখতে দেখতে সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সরকার সংবিধানের দোহাইতে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের যে ছকে এগোচ্ছে, তা থেকে বাঁচার কোনো দিশা এখন পর্যন্ত নেই বিএনপির সামনে। হয় তাদের এ নির্বাচনে যেতে হবে, নয় বয়কট করতে হবে। এ দুই পথই তাদের আছে। আর একটি পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচনটি হতে না দেয়া, বানচাল করা। বিএনপি নির্বাচন ঠেকিয়ে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার শক্তি তাদের আছে বা অর্জন হয়েছে মনে করার কারণ নেই।

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে কী হয়, না গেলে কী পরিণতি হয়-দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছে বিএনপির। ২০১৪ সালে তারা নির্বাচনে না গিয়ে দেখেছে। আর ২০১৮ সালে দেখেছে নির্বাচনে গিয়ে। কোনো অভিজ্ঞতাই সুখকর হয়নি। তাহলে আগামীতে কোন পথ ধরবে? এবার আর তারা নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়ার কথা সামনে আনছে না। বলছে, তাদের বাদ দিয়ে আগের মতো একতরফা নির্বাচন করতে পারবে না সরকার। কিসের বলে কোন যুক্তিতে দলটির এমন কনফিডেন্স, তা বড় দাগের প্রশ্ন। তবে, টানা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার এত যন্ত্রণা-ভোগান্তির মধ্যেও দলটি যে এখনো ভাঙেনি, বিএনপির জন্য তা বিশাল ব্যাপার।

দেশে রাজনৈতিক দল অনেক থাকলেও সব দলের নির্বাচনে অংশ নেয়া-না নেয়া ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ দুটি দলের কথা ভিন্ন। যেকোনো একটি দলের কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়া-না নেয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিএনপি ২০১৩-১৪ সালের পর টানা কয়েক বছরের চেয়ে গত মাস কয়েক তুলনামূলক বেশ চাঙ্গা। দলের এক নম্বর-দুই নম্বর নেতা থেকেও না থাকার অবস্থা। এর মধ্যেও কর্মীদের মাঠে তৎপর থাকার মাঝে রাজনীতির অনেক উপাদান ও বিশ্লেষণ বিদ্যমান। কতিথ তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলন জমাতে না পারলেও মাঠ ছাড়েনি। প্রায় সব কর্মসূচিই কম-বেশি জমছে।

সামনের নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরটি কেমন হবে তাও অস্পষ্ট। এমন প্রশ্নযুক্ত অবস্থার মাঝে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চায় বিএনপি। তাদের এমন চাওয়ার পক্ষে পর্যাপ্ত যুক্তি থাকলেও তা সম্ভব করার রাজনৈতিক সামর্থ্য কি তাদের আছে?

রাজনীতিতে সে রকম সামর্থ্য এখন পর্যন্ত দেখাতে না পারলেও বিএনপি মাঠে আছে জোরেশোরেই। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখার মাঝে আন্দোলনের ১০ দফাও আছে। তাদের দেখাদেখি জামায়াতে ইসলামীও ১০ দফা দিয়ে রেখেছে। গণতন্ত্র মঞ্চ দিয়েছে ১৪ দফা। গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের ১৩ দফা, গণফোরাম একাংশ ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টি যৌথভাবে ৭ দফার ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনে শরীক আছে। সংখ্যায় গুনলে অন্তত ৩৮টি রাজনৈতিক দলই সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে দফারফায় ব্যস্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না তারা বিএনপির সঙ্গে বা ধারেকাছেই আছে। তাদের এত এত দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে কোনো ঢেউ উঠছে না। মাঝেমধ্যে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ ‘ডু অর ডাই’ মানসিকতার কথা জানান। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

এভাবে কতদিন আন্দোলন টানতে পারবে বিএনপি। নির্বাচনের সাত-আট মাস সময় থাকলেও আন্দোলনের জন্য এত সময় নেই। সামনেই বর্ষা মৌসুম। এর আগে-পরে ঈদুল আজহা ও শোকের মাস আগস্ট। এগুলোতে কেটে যাবে মাস তিনেক। এতে বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে আরেকটি নির্বাচন সেরে নেয়া সরকারের জন্য মোটেই কঠিন কাজ হবে না।
আন্দোলন-গণ-অভ্যুত্থান কখনো দিন-তারিখ ঠিক করে না হলেও মাস-মৌসুমের বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ের মাঝেই বিএনপির মিত্রশক্তি গণ অধিকার পরিষদ আচমকা বেরিয়ে গেছে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে। বাদবাকি মিত্ররা কদ্দিন থাকবে, সেই প্রশ্ন তাজা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ সরকারকে হটাতে এর আগেও বিএনপি একাধিকবার আন্দোলন করেছে। আন্দোলন জমেছেও। কিন্তু, ফল আসেনি। দেশ এখন রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কঠিন বাঁকে। বিএনপিও একটি বিশেষ সন্ধিক্ষণে। এ সন্ধিক্ষণ সামনের দিনগুলোতে বিএনপিকে কোন পর্যায়ে নেবে দেখার অপেক্ষা রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহীরা।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলা পোস্ট, ঢাকা।