নিজস্ব প্রতিনিধি : সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থার মধ্যে থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করবে বিএনপি এবং তাদের সহযোগী বিকল্পধারা, জেএসডি ও ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য। সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিকল্প প্রস্তাবও দেওয়া হবে। বি চৌধুরীকে নিয়ে সন্দেহ এবং ড. কামাল ও বি চৌধুরীর নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে জাতীয় ঐক্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বিএনপির অনেকের মধ্যেই। যদিও নিরুপায় হয়েই এ পর্যায়ে তাদের নিয়েই বিএনপিকে চলতে হচ্ছে।
বিএনপি এবং তার এই নতুন সহযোগী দলগুলোর নেতৃস্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা নিয়েই তারা কাজ করছেন। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের প্রস্তাবিত বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না দুই দফা আলোচনায় মিলিত হন। মির্জা ফখরুলসহ শেষ দফায় বসে প্রস্তাব চূড়ান্ত করার কথা। কিন্তু সেই বসা আর হচ্ছে না। বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে এ নিয়ে তাদের আলোচনা হলেও চূড়ান্ত করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। জামায়াত প্রশ্নে ড. কামাল, বি চৌধুরীর বৈরী অবস্থান জাতীয় ঐক্যকেই শুরুতেই দুর্বল করছে। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের প্রসঙ্গ টেনে আনা হলেও বিকল্পধারা, নাগরিক ঐক্যের এই চিন্তাভাবনা বিএনপি শিবিরে হাল পাচ্ছে না। কারণ ড. মাহাথিরের মতো ব্যক্তিত্ব এরা কেউ নন। জাতীয়ভাবে এমনকি বিএনপিতেও বি চৌধুরীসহ অন্যদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা নেই, বরং তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কোনো শক্তিই এদের নেই। দুই বছরের জন্য তাদের ক্ষমতা দেওয়ার কোনো যুক্তি তারা দেখছে না।
সরকারের আইনগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে বিএনপির দুর্বলতাকে পুঁজি করে যুক্তফ্রন্ট, জেএসডি, গণফোরাম আন্দোলন, নির্বাচন এবং বিজয়ী হলে রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে বিএনপি শিবিরেও প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকাসহ সারা দেশে যেখানে পাঁচটি আসনেও যাদের দলীয়ভাবে বিজয়ী হয়ে আসার সম্ভাবনা নেই, তারাও দেড় শ আসনে মনোনয়ন চাচ্ছেন। বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে অথবা তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও কর্মী বাহিনীর সর্বাত্মক ভূমিকা ছাড়া ছোট ছোট এই দলগুলোর শীর্ষ নেতাদেরও জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মালয়েশিয়ার মডেলে মেয়াদের অর্ধেক সময় তারা সরকার পরিচালনা এবং সরকারপ্রধানের দায়িত্বে থাকার প্রস্তাব করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো না হলেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত খবর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে বৈরী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করেন, বিএনপির কাঁধে কাঁঠাল রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার অভিলাষ গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবভিত্তিক নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আপত্তি সত্ত্বেও বিএনপির পক্ষে তাদের এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তারা একটি আপসরফায় মধ্যপন্থী ব্যবস্থায় আসার চেষ্টা করছেন। আন্তর্জাতিক সমর্থন, সহযোগিতা জরুরিভাবে বোধ করছেন বিএনপির নেতারা। উদারপন্থী বলে পরিচিত দলগুলোকে এ কারণেই প্রধানত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে সরকারের ওপর চাপ ও প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিএনপি, ড. কামাল অনুরূপ সহায়তা প্রত্যাশা করেন। ড. কামাল, ড. মঈন খান, ড. ওসমান ফারুক, ব্যারিস্টার মওদুদ ও মির্জা ফখরুল এ ব্যাপারে দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘও বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থার বাইরে কিছু করার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে না। তবে তারা অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে। সরকার তা নিশ্চিত না করলে তাদের নির্বাচন-পরবর্তী ভূমিকা সরকারের অনুকূলে না-ও যেতে পারে। ড. কামাল, বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাহ্যিকভাবে অনাগ্রহ প্রকাশ করলেও নির্বাচনে জয়ী হলে তারা সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পেতে আগ্রহী। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে ভবিষ্যতে সরকারপ্রধান পদে মনোনয়নের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপিতেও সমস্যা রয়েছে। সরকারপ্রধান পদে মনোনয়নের প্রশ্নে ভবিষ্যতে বিএনপি ও যুক্তফ্রন্ট, বিকল্পধারা, ড. কামাল হোসেনরা বড় রকমের সমস্যায় পড়তে পারেন। মোট আসনের অর্ধেকে মনোনয়ন দেওয়া, সরকারের মেয়াদের অর্ধেক সময় সরকার পরিচালনার প্রস্তাবিত ব্যবস্থা নিয়েই বিএনপিতে আপত্তি রয়েছে। তবে বৃহত্তর স্বার্থচিন্তায় তাদের অধিক সংখ্যক আসনে মনোনয়ন দেওয়া ও আগামী সরকারে এক-তৃতীয়াংশ মন্ত্রী দেওয়ার কথা বিএনপির নেতাদের ভাবনায় রয়েছে।
এদিকে যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবর্তে আওয়ামী লীগেরও অন্য কোনো সংসদ সদস্যকে অথবা রাষ্ট্রপতিকে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করছে। নির্বাচনকালীন সরকারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা দলগুলোর মধ্য থেকেও প্রতিনিধিত্ব রাখার কথা বলেছে। সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে থাকার জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্বহীনদের রাষ্ট্রপতির কোটায় মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে।
রাষ্ট্রপতির কোটায় ১০ শতাংশ প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার সর্বোচ্চ ২৫ সদস্যের হলে রাষ্ট্রপতির কোটায় ৩ জনকে নেওয়া সম্ভব হবে। সম্ভাব্য এ অবস্থা বিবেচনায় রেখে বিগত তিন সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল এমন দলগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে। এই সরকারেও রাষ্ট্রপতির কোটায় তিন সংসদে প্রতিনিধিত্বহীন দলের প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখার কথা বলা হবে।