বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে ঢাকায় গরম হাওয়া

ডিসেম্বর মাস এলেই বাঙালি জাতি আনন্দ-উচ্ছ্বাস নিয়ে নানা উদ্্যাপনে মেতে ওঠে। প্রতিটি জনপদের বাঙালিরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবারের যেসব সদস্য ১৫ আগস্ট বিপথগামী কতিপয় সেনাসদস্যের হাতে শাহাদাতবরণ করেন, সব জীবিত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাÑযারা দেশ স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে নানা কর্মসূচি নিয়ে বিজয় উদ্্যাপন করেন। শ্রদ্ধা জানাতে কেউ যান জাতীয় স্মৃতিসৌধে, কেউ যান শহীদ মিনারে। কেউ দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। কেউ কেউ আলোচনা, সেমিনারের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার দাবি জানান। স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধ অন্তর্ভুক্ত করা কতটা জরুরি, তা তুলে ধরেন।

বিগত ৫০ বছরে এভাবেই উদ্্যাপিত হয়েছে বিজয় দিবস। ডিসেম্বর মাসজুড়েই চলে বিজয়ের উদ্্যাপন। দেশের মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। আনন্দ করেন শঙ্কাহীন চিত্তে। কিন্তু এবার যেন কেমন ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে। চারদিকে একটা গরম হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। থমথমে আবহাওয়া দেশজুড়ে। রাজনীতির ঝোড়ো হাওয়া যেন বিজয়ের আনন্দ উড়িয়ে নিতে চায়। ঢাকায় যেন যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ। বিভিন্ন বিভাগে সমাবেশ শেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে। অন্যদিকে ‘খেলা হবে’ বলে আওয়ামী লীগ হাওয়া আগে থেকেই গরম করে আসছে।

রাজধানীর মানুষ তো বটেই, সারা দেশের মানুষের মনেই ভয় ঢুকে যাচ্ছে, না জানি কী হয়। বিশ্বজুড়েই নানা সংকট। কোভিড-১৯-এর ছোবলে প্রায় তিন বছর লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এখনো আতঙ্ক কাটেনি। বিভিন্ন দেশে মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও হাজার শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিন। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
ইতিমধ্যেই ঢাকায় শুরু হয়েছে বিএনপির মহাসমাবেশের স্থান নিয়ে সরকারের সঙ্গে বাহাস। সরকার মহাসমাবেশের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অনুমোদন দিয়ে রেখেছে। বিএনপি জেদ ধরে আছে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করবে না। তারা করবে নয়াপল্টনে, পরিণতি যা-ই হোক।

এ যেন রাজনীতির রশি টানাটানি। রশি ছিঁড়ে যায় যাক। কারো গায়ে কাদা লাগে লাগুক। এই পরিস্থিতিতে সবদিকে একটা থমথমে ভাব। ‘ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’Ñএ রকম ভয় ভয় পরিস্থিতি। ঘরের বাইরে যেন ওত পেতে আছে অশুভ একটা কিছু। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যেমন উত্তেজনা, রাজনীতিতে তেমনি ভয়। ভোট এক বছর পরে। উত্তেজনা এক বছর আগেই শুরু হয়ে গেছে। মানুষের কথাবার্তায়, তর্কে-বিতর্কে, খবরের কাগজে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। করোনা গিয়েও যাচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও থামার লক্ষণ নেই। জ্বালানি সংকট। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। রেমিট্যান্স সংকট। জীবনযাপনে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। নানা রকম গুজব-গুঞ্জন। খবরে বলা হচ্ছে, ‘সুখবর নেই রেমিট্যান্সে’, ‘১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স কমেছে এক বছরে’। রেমিট্যান্স কমছে ধারাবাহিকভাবে। চলতি অর্থবছরের শুরুর দুই মাস, জুলাই-আগস্টে, দুই বিলিয়ন ডলার করে দেশে রেমিট্যান্স গেলেও এরপর কমতে শুরু করেছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে অনেকটাই ঠিক হয়ে যাবে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটাও পূরণ হওয়ার লক্ষণ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রণোদনা ও নানা উদ্যোগ নিয়েছে। হুন্ডি প্রতিরোধেও অনেক কৌশল গ্রহণ করেছে।

এত সব ব্যবস্থা নিয়েও কতটা প্রতিরোধ করা যাবে হুন্ডিকে, কে জানে? হুন্ডি কখনোই শতভাগ দূর করা যায় না। সহনীয় পর্যায়ে আনতে পারাটাই অনেক বড় সাফল্য। হুন্ডিও দুর্নীতির মতো। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে শিরে সংক্রান্তির মতো সংকট হচ্ছে দুই বড় দলÑআওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। বিশেষ করে, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মানুষ যখন দেশের ৫১তম বিজয় দিবস উদ্্যাপনে উন্মুখ, তখন রজানীতির এই ঝোড়ো হাওয়া জনগণের কাম্য নয় মোটেও।

জনগণের কাম্য না হলেও, জনগণের নামে যারা রাজনীতি করেন, তাদের কাছে জনগণের দিকটা বিবেচিত হয় না কখনো। এখনো যেমন জনগণ, ডিসেম্বর মাস, বিজয় উদ্্যাপনÑএসব কেউ ভেবে দেখছে না। বর্তমানে সংকট ঘুরপাক খাচ্ছে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে। সংবাদপত্রের সব চোখ এখন ১০ ডিসেম্বরের দিকে। ঠিকানার ৩০ নভেম্বর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি সংবাদের শিরোনাম ‘রাজনীতিতে গরম হাওয়া/১০ ডিসেম্বর ঢাকায় কী ঘটতে যাচ্ছে?’ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ। সেই নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। স্থান জটিলতার সমাধান হয়নি। প্রশাসন অনুমোদন দিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কিন্তু তারা যেকোনো মূল্যে করতে চায় নয়াপল্টনে। প্রশাসনের বক্তব্য : যত লোক সমাবেশে হবে বলে বিএনপি দাবি করছে, সেই বিবেচনাতেই সোহরাওয়ার্দী অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিএনপির দাবিমতে, চার-পাঁচ লাখ লোকের সমাবেশ কখনোই নয়াপল্টনে হতে পারে না। বিএনপির এই গোঁ ধরে থাকার পেছনে নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।

খবরটিতে বলা হয়েছে, ‘…দিনটিকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও নড়েচড়ে বসেছে, পাল্টা বক্তব্যের পাশাপাশি চলছে পাল্টা কর্মসূচিও। একই দিন পুরো ঢাকাতেই ব্যাপক লোকসমাগমের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি। সরকারবিরোধী অন্যান্য দলও ১০ ডিসেম্বর নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করবে। বিএনপি ওইদিন নির্বাচনের রূপরেখা উপস্থাপন, যুগপৎ গণ-আন্দোলন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা করবে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হচ্ছে। কূটনীতিপাড়াও রাখছে সূক্ষ্ম দৃষ্টি। ব্যবসায়ীরাও বড় ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে সতর্ক।’ সব মিলিয়ে ১০ ডিসেম্বর দেশে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে চরম উদ্বেগে জনগণ দিন কাটাচ্ছে।

সরকারি দল আওয়ামী লীগের বড় উদ্বেগের বিষয় ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা এবং সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটে। এ জন্য তারা আওয়ামী লীগের থানা, ওয়ার্ড, ইউনিট পর্যায়ে দলকে সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। রাজধানীর সব প্রবেশপথে আওয়ামী লীগ দলীয় সমাবেশ করবে। রাজধানীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা বিএনপিকে এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। অন্যদিকে বিএনপিও তাদের মহাসমাবেশ সফল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ও দাবিদাওয়া নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেবে। এই সমাবেশ ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপি অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, হুমকি-পাল্টা হুমকি দিয়ে চলেছে। এর মধ্য দিয়ে উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করেছে। পাবলিকের বুকের কম্পনও বেড়ে যাচ্ছে।

সব দলই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ঘোষণা দিচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কতটুকু শান্তিপূর্ণ থাকে, সেটাই বড় প্রশ্ন। জনগণের প্রার্থনা, বিজয়ের মাসে সব দল তাদের কর্মসূচি পালনে সংযমের পরিচয় দেবে এবং বিজয় দিবসের সব কর্মসূচি শান্ত পরিবেশে পালনের সুযোগ দেবে। বিজয়ের মাস শুরু হয়েছে, ঠিকানার পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী, সব মুক্তিযোদ্ধাসহ ঠিকানার সব গ্রাহক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের বিজয়ের মাসের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।