বিজয়ী বাইডেন ও হ্যারিসকে উষ্ণ অভিনন্দন

আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর আমেরিকায় নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর কমলা হ্যারিস। আমেরিকার স্বাধীনতার ২৪৪ বছরের ইতিহাসে ৫৯তম নির্বাচনে কমলা হ্যারিসই হলেন আমেরিকার প্রথম একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট। ঠিকানার পক্ষ থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে উষ্ণ অভিনন্দন। একজন নারীকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্নের হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানাতে প্রায় আড়াই শ বছরের জড়তা কাটিয়ে নির্বাচিত করায় আমেরিকার নাগরিকদের প্রতিও আন্তরিক অভিনন্দন।

এবারের নির্বাচনে স্মরণীয় সব ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর ভোট গ্রহণ শেষ হলেও উত্তেজনা এবং আশা-নিরাশার পেন্ডুলাম দুলতে থাকে জো বাইডেন-কমলা হ্যারিসের পক্ষে ২৭০-এর ম্যাজিকাল ফিগার ঘোষণার আগ পর্যন্ত। যার সমাপ্তি ঘটে নির্বাচনের চার দিন পর ২৭৯ ইলেকটোরাল ভোট প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে। যদিও চূড়ান্ত ফল নিয়ে এখনই নিশ্চিত হওয়া যাবে না ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করায়। তবে ফল ছিনতাই হওয়ার আর কোনো শঙ্কা আছে বলে মনে করেন না বিশ্লেষক ও আইনজ্ঞ সমাজ।
এবারের নির্বাচন বহু ঘটনায় বিশিষ্ট। এবার ভোটার ছিলেন রেকর্ড সংখ্যক, প্রায় ২৪ কোটি। এবার ভোট দিয়েছেনও রেকর্ড সংখ্যক, প্রায় ২০ কোটি ভোটার। আবার মেইল-ইন ব্যালটসহ আগাম ভোট প্রদানেও রেকর্ড হয়েছে। সে সংখ্যা ১০ কোটির ওপরে। আমেরিকার মতো দেশে ২৪৪ বছরে প্রথম একজন নারী প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তাও একজন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এবং কৃষ্ণাঙ্গ। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভোটপ্রাপ্তিতেও রেকর্ড করেছেন। বিশাল বিশাল লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের ভোটদানের দৃশ্যও ছিল অভূতপূর্ব। একটি মৌলিক পরিবর্তন, বিশেষ করে আমেরিকার গৌরবময় ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার আশায় ভোটারদের এই আগ্রহ।

বিভিন্ন মিডিয়ায় জো বাইডেনকে ৪৬তম প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পেনসিলভানিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক, দেলওয়ারের উইলমিংটনসহ বাইডেনের সমর্থকেরা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাস্তায় নেমে এসে আনন্দে মেতে ওঠেন। মনে হচ্ছে, ২৭০-এর ঘোষণা বাইডেনের পক্ষে না আসা পর্যন্ত সবার নিশ্বাস আটকে ছিল! শেষ পর্যন্ত স্বস্তির আনন্দে তারা রাস্তায় নেমে আসেন। গত চার বছর ধরে জাতির দেহে যে বিভেদের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, এবার বাইডেন সেই ক্ষতে প্রলেপ লাগিয়ে সারিয়ে তুলবেন। আমেরিকার পতাকা, বাইডেন-কমলার ছবিসহ বড় বড় প্ল্যাকার্ড নিয়ে সমর্থকদের উল্লাসেও সেটারই প্রকাশ পায়। রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশ জুনিয়র, সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনিসহ বিশ্ব নেতারা বিজয়ীদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছেন।

এ এক স্মরণীয় জয়। এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী জয়। দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে বিনয়ের জয়। অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সুরাজনীতির জয়। অশোভনের বিরুদ্ধে শোভনের জয়। ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসার জয়। আমেরিকান সমাজে নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষবাদী সমাজের শতাব্দী-প্রাচীন ট্যাবু ভেঙে দেওয়ার জয়। এই ঐতিহাসিক জয় আমেরিকার সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে নেওয়ার জয়। ২০২০ এর আমেরিকার নির্বাচন পৃথিবীর নির্বাচনী ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কেননা এবারের এই ব্যতিক্রমী নির্বাচন ইতিপূর্বে আর কেউ প্রত্যক্ষ করেনি।
কেন এই বিপুল বিজয় বাইডেন-হ্যারিসের? কারণ অনেক আছে। তবে যদি এককথায় বলতে হয়, তবে বলতে হয়Ñবিদায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাম্ভিকতা, একক কর্তৃত্ব জনমনে অস্বস্তি এবং অসন্তোষের যে কারণ তৈরি করেছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে পরিবর্তনের যে আকাক্সক্ষা মার্কিন জনমনকে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল, সেই জায়গাটাকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিলেন জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস। মানুষ তাই আস্থা রেখে আশাতীত ভোটে বিজয়ী করেছেন তাদের। ট্রাম্পের কোনো বিরূপ এবং অশোভন কথা ভোটাররা কানে তোলেননি। কোনো বর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের যে আমেরিকায় স্থান নেই, সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছেন ভোটাররা। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার যে আন্দোলন আমেরিকায় তোলপাড় তুলেছিল, ব্ল্যাক ভোটার ম্যাটার সেটা প্রমাণিত হয়েছে।

এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মূলত স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এত দিনের গৌরবময় ঐতিহ্য এবং গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। অতীতকে সামনে না এনেও বলা যায়, মানুষকে অবজ্ঞা-অসম্মান এবং তুচ্ছজ্ঞান করার পরিণতি শুভ হয় না। এবং বর্তমান যুগে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলও ভালো হয় না। জনগণের ভোটের ক্ষমতায় আস্থা না রেখে যিনি আদালতের রায়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চানÑআমেরিকার জনগণ তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন মানুষের শক্তি! গণতন্ত্র কারো বশ্যতা মানে না। গণতন্ত্র তার নিজস্ব ধারা অনুসরণ করে চলে। কেউ যখন গণতন্ত্রকে নিজের অনুগত রাখতে চায়, তখন নিজের শক্তি প্রকাশ করা ছাড়া গণতন্ত্রের আর কোনো উপায় থাকে না। আমেরিকার ২০২০ নির্বাচনে অনেক সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগামীতে যা থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। আরও একটি কথা, যে দেশের প্রতিষ্ঠানের ভিত মজবুত, সে ভিত কেউ ইচ্ছা করলেই ধ্বংস করতে পারে না। এই নির্বাচনে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিকতা এত ধাক্কার পরও নষ্ট হয়নি। তাই তো নিজের ইচ্ছামতো নির্বাচনের মাত্র কদিন আগে একজনকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না ট্রাম্প। নির্বাচনের চার দিন পরও আমেরিকার ঐতিহ্যকে আবারও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন পরাজয় মেনে না নিয়ে। ২৭৯ ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট হওয়ার আগে গত ৬ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে জো বাইডেন তার স্বভাবসুলভ শান্ত ও বিনয়ী কণ্ঠে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা বিজয়ের পথে হাঁটছি। তিনি বিজয়ের দাম্ভিকতা প্রকাশ না করে বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে সব সমস্যা ও সংকট সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে মোকাবিলা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। এবার জনগণের সমস্যা এবং প্রত্যাশা মেটাতে বাইডেন তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। জনগণের মনে অনেক দিনের বঞ্চনা-ক্ষোভ জমে আছে। যার প্রকাশ ঘটেছে ভোটের ফলে। তিনি সব ভোট গণনার ওপর জোর দিয়েছেন সব সময়। ৭ নভেম্বর বিজয়ী ভাষণে বাইডেন আমেরিকার ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড’ এর কথা বলেন। তিনি বলেন, যারা তাকে ভোট দেননি এবং যারা দিয়েছেন তিনি সবার প্রেসিডেন্ট। এবার সব ভোটারের প্রত্যাশা পূরণে তার সততা প্রমাণের পালা।

জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিসকে অনেক বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। যা গত চার বছরে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এবার তা পবির্তনের দায়িত্ব বর্তেছে বাইডেন-হ্যারিসের ওপর এবং ব্যক্তিস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সবকিছু করতে হবে জাতির স্বার্থে। প্রথমেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিতে হবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আর অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মহামারি কোভিড-১৯ ও অভিবাসন নীতি ঢেলে সাজানোর প্রতি। আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, বাণিজ্যনীতিÑসব ক্ষেত্রেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গণমানুষের স্বার্থে সংস্কার করায় উদ্যোগী হতে হবে। ক্লাইমেট চেঞ্জসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় নেতৃত্বের আসন ফিরে পেতে হবে।

সবক্ষেত্রেই ইনক্লুসিভনেসের নীতি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কোনো দেশকেই কেউ একক দক্ষতায় এগিয়ে নিতে পারেন না। কথায় কথায় ফায়ার আর নিজের খুশিমতো হায়ার করে রাষ্ট্র পরিচালনার পরিণতিও মার্কিন জনগণ দেখতে পেয়েছে। তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমেরিকাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এতটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন যে সেই বিশ্বাস এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে।

আমেরিকাকে মিত্রহীন করার পথ থেকে সরে আসতে হবে। কোভিড ১৯ বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধান, স্বাস্থ্যসেবায় নিরাপত্তা, সংবিধান সমুন্নত ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিতে হবে। নারীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদাদান, মানুষের প্রতি মর্যাদা দিয়ে কথা বলতে এবং ভোটের মর্যাদা দিতে হবে।

শেষ কথা : আমেরিকার জনগণ মহান আমেরিকার গৌরব ও ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করে স্বাধীনতার আদর্শ ও চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখতে চায় বলে এবার এত বিপুলভাবে ভোট দিয়েছেন বিজয়ীদের। সেই চাওয়া পূরণে অত্যন্ত আন্তরিক দেখতে চায় আমেরিকার নতুন কান্ডারিদের। তারা কেউ আর এখন ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান বা নীল-লালের প্রেসিডেন্ট নন। তারা আমেরিকার সব মানুষের প্রেসিডেন্ট। তাদের সুখ-দুঃখের সাথি দেখতে চায় তারা। আমেরিকার সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতীক তার প্রেসিডেন্সি। সেই প্রেসিডেন্সিকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সময় এসেছে।

নির্বাচন শেষ। এবারের প্রার্থনা-মানবজাতির মহাশত্রু করোনা মহামারি থেকে মানবজাতি পরিত্রাণ লাভ করুক।