বিদ্বেষীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন যে মুসলিম নারী এমপি

ঠিকানা ডেস্ক : জলেম সারা সেকিচ। তুরস্ক থেকে ডেনমার্কের অভিবাসী হয়েছেন। কুর্দি সম্প্রদায়ের তিনি। তবে সেসব ছাপিয়ে তার এখন বড় পরিচয় ডেনমার্কের প্রথম মুসলিম সাবেক নারী এমপি। তিনি উগ্র ডানপন্থি ও ডেনমার্কের মূলধারার সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আলোচনার সূচনা করেছেন। এজন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।
তাকে গায়ে জ্বালা ধরানো, বর্ণবাদী মন্তব্য করেন অনেক মানুষ। সামাজিক গণমাধ্যমে তাকে দেয়া হয়েছে হত্যার হুমকি। কিন্তু তাতে দমে যাননি তিনি। উল্টো তাকে যে বা যারা হুমকি দেন তিনি তাদের সঙ্গে সরাসরি বসে যান আলোচনায়। তাদের কথা শোনেন। সামাজিক সম্পর্ক বুননের চেষ্টা করেন। তিনি ছিলেন সোমালিস্ট পিপলস পার্টির (এসএফ) সাবেক এমপি। এখন মানুষে মানুষে বন্ধন সৃষ্টিতে তিনি নিজেকে নিবেদিত করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্রিজ বিল্ডার্স বা সম্পর্কের সেতুবন্ধন নামের একটি সংগঠন।
তিনি শৈশবে তুরস্ক থেকে ডেনমার্কে গিয়েছেন। এখানে তিনি এখন তার কাজের পরিধি বিস্তৃত করেছেন। সেকিচের বাড়ির ঠিকানা নিরাপত্তাজনিত কারণে গোপন রাখা হয়। উগ্র ডানপন্থিদের হামলা থেকে সুরক্ষিত থাকতে তিনি নিয়মিত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তিনি জানান, ৬ মাস আগে তিনি ৩১ টি অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, নিজের সুরক্ষার জন্য আমি কিছু নিয়ম মেনে চলি। বছরে দুইবার আমি অভিযোগ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা তখন ওই (অভিযোগ আনীত) ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এমনকি কয়েকজনের বিরুদ্ধে আমি আদালতে মামলাও করেছি।’ সেকিচ জানান, একবার অবস্থা বেশ বিপজ্জনক রূপ নিয়েছিল। ডেনিশ নাজি পার্টির এক চরমপন্থি সদস্য তার পেছনে লেগেছিল। সেকিচ দাবি করেন, ওই ব্যক্তিকে তার চরমপন্থি আচরণের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, সেটা একটা দুর্বিষহ সময় ছিল। ওই লোক সারাদিন বিরতিহীনভাবে আমার বাড়ির নম্বরে ফোন দিতেই থাকতো । আমি তার চিন্তায় প্যারানয়েড হয়ে থাকতাম। আমার মনে হতো সে আমার বাসার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তিনি বলতে থাকেন, ওই লোক আমাকে ৮ মাস ধরে এভাবে ফোন দিয়েছিল। সে সব সময় একটি গোপন নম্বর থেকে ফোন দিতো আর বলতো- তুমি আমার দেশ থেকে বের হয়ে যাও। এ রকম অভিজ্ঞতা তার জন্য বিরল নয়। তবে সেকিচ দাবি করেন তার বেশির ভাগ সাক্ষাতই কোনো ঝামেলা ছাড়াই শেষ হয়। আর তাকে বিদ্বেষমূলক মেইল (হেট-মেইল) পাঠানো ব্যক্তিগুলো বাস্তব জীবনে এমন নয়। তিনি বলেন, যারা আমাকে হেট-মেইল পাঠায় তারা মূলত সাধারণ মানুষ। তারা চাকরি করে। তাদের বেশির ভাগই বিবাহিত, সন্তান আছে- এমন মানুষ।
সেকিচ প্রথম এমপি নির্বাচিত হন ২০০৭ সালে। কিন্তু ২০১৫ সালের নির্বাচনে তার আসন হারান। এই বছরের মার্চ মাসে তিনি তার দল সোশ্যালিস্ট পিপল’স পার্টি (এসএফ) থেকে বেরিয়ে আসেন। তার বেরিয়ে আসার পেছনে কারণ ছিল দলের শরণার্থী বিষয়ক এক সিদ্ধান্ত। এসএফ নেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, একাকী আসা অল্পবয়স্ক শরণার্থীদের ডেনমার্কে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। সেকিচ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য তার দলও তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টায়। প্রথমদিকে তিনি মেইলগুলো ডিলিট করে দিতেন। তবে পরবর্তীতে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ডেনিশ ফটোগ্রাফার জ্যাকব হল্ডটের এক উপদেশ শুনে তিনি ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। হল্ডট তাকে যারা এসব মেইল পাঠায় তাদের সঙ্গে দেখা করতে ও তাদের বোঝার চেষ্টা করতে বলেন। হল্ডটের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় সেকিচ বলেন, তারা আমাকে খুন করে ফেলবে। এর জবাবে হল্ডট বলেন, প্রথমত, তারা তোমায় খুন করবে না। আর দ্বিতীয়ত, তারা তোমায় খুন করলে, সবার কাছে তুমি শহীদ হিসেবে পরিচিতি পাবে। পরিস্থিতি যেদিকেই মোড় নিক না কেন, তুমি লাভবানই হবে। হল্ডটের এই পরামর্শের পর থেকেই সেকিচের সামাজিক সমপর্ক গড়ার অভিযান শুরু হয়।
তার প্রথম সাক্ষাৎ নিয়ে সেকিচ বলেন, ‘আমার প্রথম সাক্ষাতের আগে আমি প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সে আমার গলা কেটে ফেলবে। সে আমাকে প্রচুর পরিমাণে হেট-মেইল পাঠিয়েছিল। আমি তাকেই ফোন দিলাম। ফোন দিয়ে বললাম, হ্যালো, আমি ওজলেম। আপনি আমায় চেনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না। কিন্তু আপনি আমাকে এত পরিমাণ হেট- মেইল পাঠিয়েছেন যে, হয়তো আমরা একসঙ্গে সকালের নাস্তা করতে পারবো। আমি কি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারি? উত্তরে ওই ব্যক্তি বলেন, আমার স্ত্রী’কে জিজ্ঞেস করতে হবে। তার উত্তর শুনে আমার প্রতিক্রিয়া ছিল এমন- কি! এই বর্ণবাদী লোকটারও স্ত্রী আছে? তো, এরপর আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। দেখা করার সময়, আমার হাতে আমার ফোন ছিল। ফোনে ‘হেল্প মি’ ও ওই বাড়ির ঠিকানাসহ একটি মেসেজ লেখা ছিল, আমার স্বামীর নম্বরে পাঠানোর জন্য। এছাড়া আমার স্বামীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল যে, সে যদি এক ঘণ্টার মধ্যে আমার কাছ থেকে কিছু না শোনে তাহলে সে পুলিশকে খবর দেবে।” তবে তেমনটা করতে হয়নি। সেকিচ প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ওই লোকের সঙ্গে কথা বলেন। কথা শেষে তারা বেশ ভালো বন্ধুও বনে যান। তিনি বলেন, আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন আমি ভাবছিলাম, ‘এ রকম একটা মানুষের কিভাবে এত ভয়ঙ্কর বর্ণবাদী চিন্তাধারণা থাকতে পারে! সেখান থেকেই শুরু।’
তার প্রতি এত বিদ্বেষমূলক মনোভাব থাকা সত্ত্বেও সেকিচ কিভাবে ওইসব মানুষদের সঙ্গে প্রশংসনীয় সভ্যভাবে আলোচনা করেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সাক্ষাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমি যার সঙ্গে কথা বলছি তাকে বোঝার চেষ্টা করা। আলাপের সময় আমি সামনের মানুষটিকে একজন মানুষ হিসেবে বুঝতে চাই। আমি চাই যে, তারাও আমাকে একজন মানুষ হিসেবে জানুক। কারণ, হ্যাঁ, আমি একজন মুসলিম। কিন্তু আমার আরো পরিচয় আছে। আমি একজন সেবিকা, আমি একজনের মেয়ে। আমার মা ক্যান্সারে ভুগছেন। আমার তিনটি সন্তান আছে। আমার স্বামী একটি ব্যাংকে কাজ করে। তিনি আরো বলেন, আমার জানা দরকার ও বোঝা দরকার এই বিদ্বেষ আসে কোত্থেকে! আমি তাদের মতো মানুষদের ভয় পাই। তারা আমার মতো মানুষদের ভয় পায়। আমরা যদি একে-অপরকে নিয়ে ভয় পেতে না চাই, তাহলে আমাদের দেখা করতে হবে। আমি যাদের সঙ্গে দেখা করি তাদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে, দয়া করে একে-অপরের সঙ্গে কথা বলুন। শুধু নিজের কথা বলবেন না।