ওয়াকিল আহমদ
পটভূমিঃ বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে- “যে ছাও উড়ে সে বাসায় র্ফ্কায়।” কবি নজরুল ইসলামের পাখার ঝাপটি শৈশবকালেই শোনা গিয়েছিল। এগার-বার বছর বয়সে গ্রামীণ জীবন ও পরিবেশের উপযোগী আখ্যানমূলক ও নাট্যধর্মী ‘লেটোগান’ লিখে তিনি প্রথম কবিতার রাজ্যে প্রবেশ করেন। নজরুল রচিত এরূপ ১২টি লেটোগানের সন্ধান পাওয়া গেছে। গানগুলির কতক বিষয় পৌরাণিক, কতক ঐতিহাসিক ও সামাজিক, হাস্যরসাত্মক ছিল। পৌরাণিক বিষয় নিয়ে রচিত গানের সংখ্যাই বেশি, যেমন ‘দাতাকর্ণ’, ‘শকুনি বধ’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ’, ‘মেঘনাদ বধ’ ইত্যাদি। নজরুল ইসলাম ঐ বয়সে রামায়ণ-মহাভারতের সাথে শুধু পরিচয় লাভ করেন নি, ঐ দুই মহাকাব্যের অন্তর্নিহিত রত্নভাণ্ডারের সন্ধানও লাভ করেছিলেন। শেখ চকোর নামে লেটোদলের জনৈক কবিয়াল নজরুল সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “আমার ‘ব্যাঙাচি’ বড়ো হয়ে সাপ হবে।” তিনি নজরুলকে ‘ব্যাঙাচি’ বলে ডাকতেন। তাঁর মন্তব্যটি যে কত বড় সত্য ছিল, পরবর্তীকালে তা আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণিত হয়েছে।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে দু-চারটা খ- কবিতাও রচনা করেন। ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে বিশ্বযুদ্ধ উপলক্ষে গঠিত ‘বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ বা ‘বাঙালি পল্টনে’ যোগদান করে প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে ও পরে লাহোরের নওশেরায় সামরিক ট্রেনিং শেষে করাচি সেনানিবাসে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯১৯ সাল ১৯ জুন প্যারিসের ভার্সাই চুক্তির ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে এবং ১৯২০ সালের মার্চ মাসে পল্টন ভেঙ্গে দিলে তাঁর সৈনিকজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সৈনিকজীবনের প্রায় সাড়ে তিন বছরের অভিজ্ঞতা ছিল অভিনব ও বিচিত্র। এ পর্বে তাঁর অর্জনগুলি ছিল এরূপঃ
১. নজরুল ইসলাম গ্রামের গ-ি ছাড়িয়ে বৃহত পরিম-লে প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সংগ্রবে থেকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ ও বিচিত্র জ্ঞান অর্জন করেন।
২. তিনি সাধারণ ‘সিপাহি’ থেকে ‘কোর্য়াটার-মাস্টার হাবিলদার’ পদে উন্নীত হন।
৩. তিনি লাহোরের এক মৌলভির কাছে ফারসি ভাষা শিখেন এবং ফারসি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন।
৪. করাচি সেনানিবাসে সংগীতচর্চার ও বাদ্যযন্ত্রসংগীত শিক্ষার সুযোগ পান।
৫. বিশ্বযুদ্ধের মতো একটি বৈশ্বিক ঘটনার সাথে যুক্ত হন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও যুদ্ধের দৈনন্দিন খবরাখবর পেতেন। এতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার ও চিন্তাশক্তির প্রসার ঘটে।
এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক যে, নজরুল ইসলাম যে বছর বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন সে বছর অর্থাৎ ১৯১৭ সালে ‘রুশবিপ্লব’ সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার স্বৈরশাসক জার সম্রাটের পতন হয় এবং প্রলেতারিয়াত বা কৃষক-শ্রমিক-জনতার সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সৈনিকজীবনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও কঠোর অনুশীলনের মধ্যেও তাঁর নিজস্ব সাহিত্যচর্চা অব্যাহত ছিল। তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা সংগ্রহ করতেন এবং কবিতা ও গল্প রচনা করে সেগুলিতে প্রকাশ করতেন। করাচি সেনানিবাসে অবস্থানকালে রচিত এবং কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গদ্যপদ্য রচনার একটি তালিকা এভাবে নির্ণয় করা যায়ঃ
কবিতা : ১. মুক্তি, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৬/জুলাই ১৯১৯
২. কবিতা-সমাধি, সওগাত, ভাদ্র ১৩২৬
৩. আশায় (হাফিজের গজল), প্রবাসী, পৌষ ১৩২৬
গল্প-প্রবন্ধ : ১. বাউ-েলের আত্মকাহিনী, সওগাত, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬/মে ১৯১৯
২. স্বামীহারা, সওগাত, ভাদ্র ১৩২৬
৩. তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা, সওগাত, আশ্বিন ১৩২৬
৪. হেনা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৩২৬
৫. ব্যথার দান, নূর, মাঘ-ফাল্গুন ১৩২৬
গল্পগুলির মধ্যে ‘ব্যথার দান’ ও ‘হেনা’ সম্পূর্ণ যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। নজরুল ইসলাম বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন নি, কিন্তু নানাসূত্রে যুদ্ধের খবরাখবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই কল্পনায় হলেও যুদ্ধের বিধ্বংসী রূপ ও ভয়াবহ চিত্র অঙ্কন করতে অসুবিধা হয় নি তাঁর।
বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে যাওয়ার পর নজরুল ইসলাম করাচি থেকে গ্রামে না ফিরে কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে উঠেন এবং সমিতির সম্পাদক মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে একত্রে বসবাস শুরু করেন। সাপ্তাহিক বিজলীতে বিদ্রোহী কবিতার প্রকাশকাল (৬ জানুয়ারি ১৯২২) এবং মুজফ্ফর আহমদের প্রদত্ত বিবরণ থেকে অনুমিত হয়, নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কবিতাটি রচনা সম্পন্ন করেছিলেন। এর মধ্যবর্তী সময়ে নজরুলের জীবনে কি কি ঘটেছিল?
নজরুল ইসলাম জীবিকার প্রয়োজনে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন। তিনি মজফ্ফর আহমদের সাথে যুগ্মভাবে এ. কে. ফজলুল হকের অর্থানুকূল্যে সান্ধ্য ‘দৈনিক নবযুগ’ সম্পাদনা শুরু করেন। ১৮২০ সালের ১২ জুলাই তারিখে পত্রিকাখানি আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকায় সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে তাঁর রচিত সম্পাদকীয়-প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে ঐ সময় ভারতব্যাপী অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন চলছিল। নবযুগে কাজ করার সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। পত্রিকায় ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ প্রবন্ধ লিখে তিনি সরকারের বিরাগভাজন হন; সেপ্টেম্বর মাসে জামানত বাজেয়াপ্ত হলে নবযুগ বন্ধ হয়ে যায়। ‘মোসলেম ভারতে’ ‘বাঁধন-হারা’ উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মোসলেম ভারত, সওগাত, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, কোরবানী প্রভৃতি কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি এ সময়ে গান ও স্বরলিপি রচনা করে এবং আসরে গেয়ে পরিবেশনাও শুরু করেন। পত্রিকা সম্পাদনার, গল্প-উপন্যাস, কবিতা-গান রচনার মাধ্যমে তিনি কলকাতার কবি-সাহিত্যিক ও গুণীজনের সাথে পরিচিত হওয়ার ও তাঁদের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। সাহিত্য সমিতির অফিসে মোহিতলাল মজুমদারের (১৮৮৮-১৯৫২) সাথে কবির পরিচয় হয় এবং এক পর্যায়ে তাঁর মুখে তাঁর রচিত ‘আমি’ শীর্ষক একটি গদ্যরচনা শোনার সুযোগ হয়। ‘আমি’ প্রবন্ধ ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্যে বিষয়গত মিল আছে, কিন্তু স্বীকৃতি না থাকায় মোহিতলাল মজুমদার শুধু অভিযোগ করে ক্ষান্ত হন নি, প্যারোডি লিখে রীতিমত বাক্বিত-ায় জড়িয়ে পড়েন। পরে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম জুন মাসে পুস্তক-ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লা গমন করেন এবং তাঁর ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন (১৮ জুন, ১৯২১); কিন্তু বাসররাতেই সে বিবাহ-বন্ধনের অবসান হয়, যার রহস্য আজও জানা যায় নি। ফেরার সময় কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর স্নেহাশ্রয়ে নজরুল ইসলাম পক্ষকাল অতিবাহিত করেন; সেখানে ভবিষ্যতের সহধর্মিণী প্রমীলা দেবীর সঙ্গে কবির সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়। ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ অন্দোলনের সভা ও মিছিলে যোগদান করে এবং স্বরচিত স্বদেশি গান গেয়ে নজরুল ইসলাম ‘চারণকবি’ রূপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কলকাতায় ফিরে তিনি ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে শান্তিনিকেতনে যান এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ লাভ করেন। নজরুল ইসলাম নভেম্বর মাসে পুনরায় কুমিল্লা গমন করেন এবং প্রিন্স অব ওয়েলস্-এর ভারত-আগমন উপলক্ষে কুমিল্লা শহরে যে প্রতিবাদ মিছিল হয়, তাতে স্বরচিত সংগীত গেয়ে সকলের মন জয় করেন। ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। কাজী নজরুল ইসলাম ঐ মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাত্রে বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেছিলেন। একুশ-বাইশ বছরের তরুণ কবির ব্যক্তি ও শিল্পী জীবনে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জিত ও ভাবাবেগ সঞ্চিত হয়েছিল, এ কবিতার মধ্যমে সেসবের একত্রে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
ভার্জিনিয়া।