এবিএম সালেহ উদ্দীন :
মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা একটি বিশ্বজনীন কাব্য উপাখ্যান। নজরুল যখন যৌবনের উপাত্তে (বয়স ২০-২১), তখন বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত হয়। কবিতাটি প্রকাশের পর সমগ্র ভারতবর্ষে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
সকল গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে, নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি কোনো সাধারণ কাব্যগাথা নয়। এটি একটি সর্বজনীন, সর্বব্যাপক অসাধারণ কাব্য উপাখ্যান। গতানুগতিক সকল ধারার ঊর্ধ্বে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম কবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সকল প্রকার বৈষম্য, অসাম্য ও অসংগতির বিরুদ্ধে এবং মানবসভ্যতার বিনির্মাণে এই কবিতার আবেদন প্রতিটি সময়ে, যুগ-যুগান্তরে বহাল থাকবে। এই কবিতার জ্বালাময়ী আবেদন বাংলা সাহিত্যে যে জাগরণ ও ঝংকার তুলেছে; তা চিরন্তন ও অবিস্মরণীয়।
বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি শব্দকণিকা অর্থময় ও বিশ্লেষণধর্মী। কবিতাটির সৌন্দর্যমণ্ডিত আবেদন এতই ব্যাপক ও প্রসারমান, যা কখনো ম্লান হবে না। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি স্থায়ী সম্পদ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। অবিস্মরণীয়ভাবে বাংলা সাহিত্যকে উজ্জ্বল ও আলোকিত করে তুলেছে।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি পূর্বের তুলনায় অনেক গুণ বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। বিদ্রোহী কবিতাটি পাঠকের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগায়। বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে এ ধরনের প্রতিবাদমুখর কবিতা বাংলা সাহিত্যে প্রকাশিত হয়নি। এই কবিতার মাধ্যমে কবি তৎকালীন শাসকের বিরুদ্ধে তিনি তার দুঃসাহসী অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। ভারতবর্ষের মানুষদেরকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলেছেন। এই কবিতায় তিনি নিজেকে বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে, পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজের বীরত্ব ও সাহসের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বিদ্রোহী কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতাসমূহের অন্যতম। এই কালজয়ী কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে।
কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতার ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী’ (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা’ (বৈশাখ ১৩২৯) এবং নিজের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়।
কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সমগ্র ভারতে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। এই কবিতার মধ্য দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃপ্ত বিদ্রোহী চেতনা শাণিত ও জাগ্রত হয়। অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালিমানসে কবিতাটি ‘চির উন্নত শির’ হয়ে বিরাজমান। বাংলা সাহিত্যভুবনে বিদ্রোহী কবিতাটি সর্বব্যাপী ঝংকৃত, সর্বাধিক আলোচিত, আলোড়িত। ধ্রুপদি কবিতার ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সমতুল্য অন্য কারও, আর কোনো ছন্দময় কবিতা বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়নি। বাংলা সাহিত্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এত বেশি সুরাশ্রিত, পঠিত ও আবৃত্ত হয়েছে, যার সমকক্ষ আর কোনো কবিতা পাওয়া যায় না।
কল্লোল যুগের অন্যতম নায়ক কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাকে ‘উচ্চণ্ড বজ্রনাদ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নজরুলের কবিতার শব্দগুলো যেন সর্বযুগের বোমারু বিমান থেকে উল্কা ছড়ানো বারুদ।
সত্যিকার অর্থেই নজরুল ইসলাম ছিলেন নিজের জীবনের সামগ্রিকতায় মানবতাবাদের সমুজ্জ্বল প্রতীক। মননে ও মানসিকতায় তিনি যা ভাবতেন, নিজের জীবনে তার কার্যকরণের চেষ্টা করেছেন। অসুস্থ হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি ও কল্যাণচিন্তার মধ্যেই ব্যস্ত ছিলেন। গণমানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও কল্যাণের জন্য মানবতাবাদী আন্দোলন ও রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। বাম ধারার রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন। নজরুলসৃষ্ট ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। যুগ যুগ ধরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা হচ্ছে গণমানুষের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার। মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে কবিতাটি প্রতীক হিসেবে চূড়ান্ত ও স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষাক্ত বিষক্রিয়ার ভয়াবহতার সময় নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মানুষের অধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য ঝড় তুলেছিল। কাব্য ঐশ্বর্যের বিভবে সেটি বাংলা সাহিত্যে সর্বজনবোধ্য হিসেবে অবিস্মরণীয়ভাবে অস্তিত্ব বিনির্মাণ করে আছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক কবিতা শিক্ষাদানের অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন বুদ্ধদেব বসু। তার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় (১৯৪৪) কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও সাহিত্যের ওপর পুরো একটি সংখ্যা করেছিলেন। একইভাবে রবীন্দ্রনাথের ওপর (১৯৫২) তার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের হয়। এ ছাড়া নজরুলকে নিয়ে কোনো একটি লেখায় বুদ্ধদেব বসু প্রায় দুই পাতা নজরুলের সাহিত্যিক মূল্যায়ন, অস্তিত্ব এবং নজরুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলেন।
অনেক মনে করে থাকেন, বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে যথার্থ মূল্যায়ন করেননি। কথাটি ঠিক নয়। বরং নজরুলের সাহিত্যের প্রতি সুবিচারের সঠিক মর্যাদার প্রতাপেই নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর ধারণা এবং মতামত অনেকের কাছে প্রশংসনীয় হয়েছে। সেটি সবার কাছে সহজভাবে গ্রহণীয় এবং প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সমীচীন মনে হয়েছে। সেখানে বিদ্রোহী কবিতাসহ নজরুলের পুরো একটি কবিতার খাতা পড়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার শব্দগুলো সকল দুর্বোধ্যতা ছাড়িয়ে বিস্ময়করভাবে সকল প্রকার বৈষম্য, অসাম্য, অসংগতির বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী হাতিয়ার হিসেবে যুগে যুগে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার খোরাক জোগাবে।
এই কবিতার ছত্রে ছত্রে নিজের কাব্যপ্রতিভার ঔজ্জ্বল্য বহিঃপ্রকাশের আনন্দ নজরুলকে আরও বেশি উদ্দীপ্ত ও উচ্চকিত করে তোলে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মধ্যেও আনন্দ আছে। তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রে চৌকস বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি তার মেধা ও সৃজনমননে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। তার লেখা প্রতিটি কবিতা, গান ও অন্যান্য বৈচিত্র্যময় রচনায় তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। প্রতিটি রচনায় যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রনিনাদ সংক্ষুব্ধতা ও প্রতিবাদ আছে, তেমনি রয়েছে মানবপ্রেম ও ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে এবং বাঁচিয়ে রাখার জন্য রয়েছে অব্যবহিত অনুপ্রেরণা।
কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নজরুলের অদম্য সাহস, নির্ভীক ও অকুতোভয় মানসিকতার অপ্রতিরোধ্য চেতনার বহিঃপ্রকাশ। তার কবিতার শুরুটাই হয়েছে আত্মবিশ্বাস, অদম্য সাহস ও দুর্জয় মানসিকতা ও দৃঢ়তার ওপর। শুধু বাংলা ভাষা নয়, বিদ্রোহী কবিতার স্থায়ী প্রেরণা ও আবেদন পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী মানুষের মুক্তি ও কল্যাণে নিবেদিত। কবিতাটি যাত্রালগ্নে তিনি শুরু করেছেন এভাবে :
“বল বীর-বল উন্নত মম শির!শির নেহারি আমারি,
নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি ‘চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!”
‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছত্রে ছত্রে কবির প্রত্যয়বোধ ও বিদ্রোহ-বিদ্রƒপ যেমনি প্রকাশিত হয়, তেমনি তার চোখে বিদ্রোহী, প্রতিবাদী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি খড়গহস্ত। এই কবিতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার দুর্দান্ত সাহস ও মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। মানুষের প্রতি প্রবল প্রেম, আবেগ বহিঃপ্রকাশের পাশাপাশি দুর্জয় সাহসের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। সকল প্রকার বৈষম্য ও অন্যায়ের প্রতিরোধে এবং তার প্রতিকারের জন্য দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন :
“আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি উদার!”
গণমানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয়বোধ নানানভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং হৃদয়হীন পাষণ্ড-পাষাণের বুকে চাবুক মেরেছেন। শোষক শ্রেণি তিনি, স্বৈরতন্ত্র ও শোষকের সকল নিয়মকানুন ভেঙে চুরমার করার ঘোষণা দেন :
“আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীরÑ
চির উন্নত মম শির !”
বিদ্রোহী কবিতায় বারবার উচ্চারিত ‘আমি’ বলতে শুধুই ব্যক্তিগতভাবে কবিকেই বোঝানো হয়নি। এ ‘আমি’ কোনো নির্দিষ্ট ‘আমি’ নয়, এর পরিচয় বিস্তৃত ও সর্ববিস্তারী। এই ‘আমি’ দ্বারা সকল প্রতিবাদী মানুষকেই বোঝানো হয়েছে। কবি এখানে মানুষের চিত্তজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে প্রকাশ করেছেন। শুধু নিজের মুক্তিই অনুভব করেননি। সব মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন। মনেপ্রাণে জেগে উঠেছে শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করার অদম্য নেশা। তিনি কেবল নিজে স্বাধীন, তা উচ্চারণ করেননি, তিনি সদ্য জাগ্রত মানুষের অগ্রণী ভূমিকার এবং তাদের চিত্তজাগরণের মন্ত্রে দীক্ষা করিয়েছেন।
মানুষ সৃষ্টির সেরা। এটি কবির কথা। এই মহাবাণীর শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং স্রষ্টা। যিনি ইহজগৎ, মহাজগৎ এবং সমগ্র মানবকুল সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দান করেছেন।
তাই সূত্র ধরেই কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতার প্রথমেই তিনি ওই সব জাগ্রত চেতনার মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে কবিতার শুরু করেছেন এভাবে :
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির…’
কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিটি রচনায় যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রনিনাদ সংক্ষুব্ধতা ও প্রতিবাদ আছে; তেমনি রয়েছে প্রেম, ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে মানুষকে জাগিয়ে ও বাঁচিয়ে রাখার জন্য অব্যবহিত অনুপ্রেরণা।
যত দিন গণমানুষের মুক্তি না আসবে, তার কবিতা, শিল্প-সাহিত্য সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার অদম্য প্রেরণা ও প্রত্যয়বোধের আহ্বান জানাবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুল শব্দঝংকার ও শিল্পবোধ নানা আঙ্গিকে প্রকাশ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসহায় মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ, অধিকার আদায় ও মুক্তি নিশ্চিত করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তেমনি তার কালজয়ী সাহিত্য অমর ও অনির্বাণ হয়ে অধিকারহারা গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার প্রেরণা দান করবে।
তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন :
“মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যখন উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে
রণিবে না-।”
‘বিদ্রোহী’ কবিতা মূলত আত্মজাগরণের কবিতা। গণজাগরণের কবিতা। যেখানে মানুষ আছে, সেখানেই এই কবিতা মানুষের অনুসঙ্গী হয়ে পাশে দাঁড়ায়। নিজের সুদৃঢ় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে চরণে সুস্পষ্টভাবে মানবতাবোধকে অর্থময় ও সমুজ্জ্বল করে তুলেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন।
বিদ্রোহী কবিতায় ১৪১ বার ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে কবি জোরালোভাবে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, ‘মানুষই সৃষ্টির সেরা।’ মানুষ অসীম শক্তির অধিকারী। মানুষই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে। শক্তির সদ্ব্যবহার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেকোনো জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংগ্রামের ফলেই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারে। তাদের স্বাধীনতা ফিরে আসে। বিদ্রোহী কবিতার সুবিশাল পঙ্্ক্তিমালার মধ্য দিয়ে নজরুল সেই বিষয়কে উচ্চকিত করে তুলেছেন। মানুষের মধ্যে প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, সত্য, সাম্য, সুন্দর, অসাম্প্রদায়িকতা ও ন্যায়নীতির সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিদ্রোহী কবিতার অপরিসীম অবদান বিশ্ববিশ্রুত। এই কবিতা বিশ্বের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষকে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা দান করে। এই কবিতার মধ্য দিয়ে নজরুলের ভেতরকার বিদ্রোহী মনোভাব ও আগুনঝরা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, স্বৈরতন্ত্রী শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে। উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। বহুদাশৃঙ্খলিত দম্ভ ও অহংকারের বিরুদ্ধে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার শব্দের খড়গঝংকারে কবি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেন :
“আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ মান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ!”
আমাকে (কবি) দমন করা কঠিন, আমি কারও কাছে মাথা নত করি না (স্রষ্টা ব্যতীত), আমি শত্রুর জন্য প্রয়োজনে হিংস্র হতে পারি। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে তিনি দেবতা শিবের মতো ভয়ংকর হতে পারেন। তিনি আরও বলেন, তিনি কোনো নিয়ম মানেন না, কোনো আইন মানেন না এবং তিনি প্রয়োজনে সকল বন্ধন ভুলে সব ভেঙে চুরমার করতে পারেন। ব্রিটিশ-যুগে নজরুলের মতো অসমসাহসী কবি আর কেউ ছিলেন না। এখনো নেই।
বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে এ রকম আর কোনো প্রতিবাদমুখর কবিতা প্রকাশিত হয়নি। এই কবিতার মাধ্যমে কবি তৎকালীন শাসকের বিরুদ্ধে তার দুঃসাহসী অবস্থান তুলে ধরেন। ভারতবর্ষের মানুষদের ঔপনিবেশিক নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলেছেন। এই কবিতায় তিনি নিজেকে বিভিন্ন উপমা দ্বারা বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে নিজের বীরত্ব ও সাহসকে বেগবান করেছেন। পৃথিবীর মানবতাবিরোধী সকল বৈষম্য, অবক্ষয়, অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়েছেন।
এই কবিতা রচনার ফলে নজরুল বিদ্রোহী কবি হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। যদিও তার অনেক রচনা, কবিতা ও অসংখ্য গানে বিদ্রƒপ ও বিদ্রোহের আগুনঝরা প্রেরণা বিদ্যমান। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যেন আমাদের সমাজের প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তলোয়ার উঁচিয়ে রুখে দাঁড়ায়। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি স্থায়ী সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতা হচ্ছে গণমানুষের জাগরণের স্মারক উদ্বোধক। সাম্যের প্রতীক। বাংলা সাহিত্যে মানবকল্যাণধর্মী কবিতার ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সমতুল্য ও অর্থবহ কবিতা আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। শুধু কবিতাই একমাত্র সর্বব্যাপক পঠিত, আবৃত্তিযোগ্য, অপ্রতিরোধ্য কবিতা। বাংলা সাহিত্যের সর্বমহলে পঠনে, গায়নে, আবৃত্তিজগতে যার সমতুল্য কাব্যঝংকার আর কোনো কবিতায় নেই। নজরুলের ভেতরকার সর্বজনীন অপ্রতিরোধ্য চেতনার ফলেই সেটি সম্ভব হয়েছে। বিদ্রোহী কবিতার আবেদন ও ঔজ্জ্বল্য যুগ যুগ ধরে যুবসমাজসহ গণমানুষকে জাগ্রত করার শক্তির জোগান দেবে। ভাগ্যহারা, অধিকারহারা গণমানুষের মুক্তির দিকনির্দেশনা দান করবে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
(২৪ মে নজরুলের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বিদ্রোহী কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি)
