বিনা ভোটেই ক্ষমতার নতুন চিন্তায় সরকার

বিশেষ প্রতিনিধি : ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ভাবনা থেকে সরে এসেছে সরকার। নেমেছে বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে এমপি ঘোষণার চেয়ে বর্তমান সংসদের সবাইকে বহাল রেখে সরকার চালিয়ে নেওয়ার অ্যাসিড টেস্টে। সরকারি কৌশলটি সবার আগে ফাঁস করেছেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার এ জেরে নতুন করে সরকারের আক্রোশের শিকার তিনি। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে তার বিরুদ্ধে নোংরা ভাষায় মন্তব্য ছোড়া শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, তিনিই অনির্বাচিত সরকার আনার কলকাঠি নাড়ছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন সুজনের বদিউল আলম মজুমদার, ডা. জাফরউল্লাহ, দুটি দৈনিকের সম্পাদকসহ কিছু কুশীলব। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সরকারের এ-সংক্রান্ত কারসাজির কিছু আপডেট তথ্য রয়েছে বিএনপির কাছেও। তা বুঝে দলটি নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তরিক। কারণ, এর বদনাম নিতে চায় না দলটি। প্রমাণ করতে চায় নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের সর্বাত্মক আন্তরিকতা।
বিএনপি নির্বাচনের মাঠ ছাড়ছে না, এটি সরকারের জন্য দুর্ভাবনার। বিএনপি মাঠে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে গেলবারের মতো একতরফা নির্বাচনী তামাশা করা সহজ হবে না- এ বার্তা সরকার পেয়ে গেছে। তাই নির্বাচন সরকারের কাছে একটি মহা ঝামেলার বিষয়। এ ক্ষেত্রে খ-িত ভরসা হতে পারে নির্বাচন স্থগিত রাখা। জরুরি বা অনিবার্য প্রয়োজনে তা করার ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে। এর বাইরে আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে আদালতের মাধ্যমে সীমানাসহ নানা ছুতোয় রিট করা। সরকার আপাতত সেই চর্চাটি করে পরিবেশ দেখতে চায়। কারো কারো শঙ্কা, নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান কে হবেন, তা নিয়ে জটিলতার কারণে রিটবাজিতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে দফায় দফায় জাতীয় নির্বাচন স্থগিত করাতে পারবে সরকার। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন হবে সরকারের একান্ত সহায়ক শক্তি। আর আদালতেরও এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
সরকারের বিনা ভোটে নির্বাচনের পাঁয়তারা টের পেয়ে বিএনপি গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। কারাবন্দী চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও লন্ডনে দেশান্তর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনাও তা-ই। সরকারও ওয়াকিবহাল বিএনপির এ কৌশল সম্পর্কে। বিএনপি নির্বাচনের মাঠে থাকলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন সম্ভব নয়- সরকার এরই মধ্যে তা নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই ৫ জানুয়ারির বিকল্প হিসেবে বাছাই করা হয়েছে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নির্বাচন স্থগিত করা। ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনের পর সরকার সেই প্র্যাকটিসটি করেছে গাজীপুরে। এ সার্কাসে নির্বাচন কমিশন শুধু সাক্ষীগোপাল। সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন জানত, ঢাকা উত্তরের পর গাজীপুরের সিটি নির্বাচনও স্থগিত হবে। তা জেনেও হম্বিতম্বি করেছে।
‘কেন্দ্রেই ভোট গণনা হবে’-খুলনায় এমন হুংকারও দিয়েছেন সিইসি নুরুল হুদা। কিন্তু নীরবে আদালতে চলে গাজীপুরের নির্বাচন ভ-ুলের আইনি আয়োজন। সাংবিধানিক ধারামতে, ১২৫-সি অনুসারে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন-সংক্রান্ত যেকোনো মামলায় পর্যাপ্ত সময় দিয়ে ইসিকে নোটিশ দিয়ে জবাব চাইতে হবে। তারপর শুনানি হবে। ইসি কৌশলে চুপ মেরে থেকেছে। তা মোকাবিলায় কোনো আইনজীবী মোতায়েন রেখেছিল কি না, কেউ জানে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন কেসটা ধরে ফেলেছেন হাতেনাতে। আর বিএনপি মজা দেখেছে। সীমানা জটিলতা নিরসন না করে ইসির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কাঁচা খেলা এবং রহস্য এখন অনেকের কাছে পরিষ্কার। সরকার-ইসি- আদালতের ইকোয়েশনটা ধরা পড়ে গেছে তুলনামূলক কম বুঝের মানুষের কাছেও। গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে রিট কারবারি সাভারের আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম আজহারুল ইসলাম সুরুজও গোপন রাখতে পারেননি বিষয়টি। অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি। তালগোল পাকিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, শুধু এবার নয়, তিনি এর আগেও দুবার গাজীপুর সিটিতে শিমুলিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করে রিট করেছিলেন। তার ভাষ্য, ‘আমাকে এর আগে খালি খারিজ করেছে, খারিজ করেছে। এবার আল্লাহ পাক আমার প্রতি সদয়, আমিই পাইছি।’
ভোটের মাত্র ৯ দিন আগে আদালতকে দিয়ে গাজীপুরের সিটি নির্বাচন স্থগিত করার গুটি সুরুজের মতো নির্বাচন কমিশনের বালখিল্যতাও দিবালোকে স্পষ্ট। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ, লাজশরমহীন প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। সীমানা জটিলতার ফয়সালা না করেই তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। যেটা মাত্র দু-তিন মাস আগে তারা ঢাকায়ও করেছে। স্থগিতাদেশের শুনানির সময় হাইকোর্টে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো অ্যাডভোকেট ছিলেন কি না, সে তথ্যও তারা জানে না। অথচ এই ধরনের কাজের জন্য আইনজীবী রাখা আছে, যাদের ভাতা দেওয়া হয়।
মজার ব্যাপার হলো, আজহারুল ইসলাম সুরুজ এই জেলার বাসিন্দাই নন। তিনি ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সুরুজের আপত্তি তার ইউনিয়নের ছয়টি মৌজা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত হয়েছে। অথচ এই মৌজার ভোটাররা তার ইউনিয়নেরও ভোটার। গত সাড়ে চার বছর ধরেই এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি আইনি লড়াই করে আসছিলেন। গত ১০ এপ্রিলও বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে আইনজীবী নিয়োগ করে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। তবে সেদিন রিটটি উত্থাপন হয়নি মর্মে খারিজ হয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানকে নিয়োগ করে ৬ মে তিনি আবার আদালতে যান। এতে সুফল মেলে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে তিন মাসের স্থগিতাদেশ আসে। এ ইস্যুতে আলোচিত হয়ে ওঠায় সুরুজ কিছুটা খেইও হারিয়ে ফেলেন। জানিয়েছেন, তিনি গাজীপুরে ভোট স্থগিত চাননি। চেয়েছিলেন তার ছয় মৌজায় যেন ভোট না হয়।