বিমান ঘিরে দুর্নীতির মচ্ছব

ঢাকা : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স থেকে শুরু করে উড়োজাহাজের টয়লেট পর্যন্ত পয়েন্টে পয়েন্টে দুর্নীতির কারণেই দেশের বিমানবন্দরগুলোর অবস্থা নাজুক বলে মনে করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতির কারণেও যাত্রীসেবা নিম্নগামী ও নিরাপত্তা ঝুঁকি ঊর্ধ্বগামী হয়েছে বলে মনে করে দুর্নীতিবিরোধী সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান ও বেবিচকের কার্যক্রম নিয়ে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক দলের প্রতিবেদন ও দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেবিচকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের ওপর অনুসন্ধান চালায় দুদক। অনুসন্ধানে বেবিচকের ১১ ও বিমানের ৮ খাতে দুর্নীতি পেয়েছে তারা। প্রতিবেদন তৈরির পাশাপাশি দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের তালিকাও করেছে দুদক। গত ৩ মার্চ সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান।

দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, বিমানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। মন্ত্রণালয়েরও অনেক ইন্ধন রয়েছে বিমানের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। বিশেষ করে পাইলট নিয়োগে বেবিচকের শীর্ষ পর্যায়ের অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছে দুদক। বেসরকারি বিমান সংস্থার বাণিজ্য বাড়াতে অসাধু কর্মকর্তারা বিমানকে লোকসানে দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দুদকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, শুধু দুর্নীতি নয়, যারা কাজে অবহেলা করবেন তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যত প্রভাবশালীই হোক ছাড় দেওয়া হবে না। এই মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিবাজদের স্থান নেই।
প্রতিবেদনে উড়োজাহাজ কেনা ও ভাড়া, রক্ষণাবেক্ষণ, টিকিট বিক্রি, কার্গো আমদানি-রপ্তানি, ক্যাটারিং খাতসহ বিমানের আটটি খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। আর বেবিচকের ক্রয় খাত, সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ, কনসালট্যান্ট নিয়োগ, বিমানবন্দরের স্পেস/স্টল ও বিলবোর্ড ভাড়া, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজসহ ১১টি খাতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে।

দুদক ২০১৭ সালে দুর্নীতির জনশ্রুতি রয়েছে এমন ২৫টি প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও অপচয়ের দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ করে প্রতিষ্ঠানগুলোর জনসেবার সফলতা ও সীমাবদ্ধতা, আইনি জটিলতা, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির কারণসমূহ চিহ্নিত করে তা বন্ধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক দলকে নির্দেশ দেয়। দুদকের উপপরিচালক শামসুল আলম বলেন, দুদক মহাপরিচালক মোহাম্মদ মুনির চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কুর্মিটোলায় বেবিচক কার্যালয়ে যায়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেবিচক নিয়ে গঠিত প্রাতিষ্ঠানিক দলটি সংস্থাটির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে বিভিন্ন শাখায় কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তথ্য সংগ্রহ করেছে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও টিআইবির প্রতিবেদনকেও আমলে নিয়েছে দুদক। বিভিন্ন সময়ে ঘটনাস্থল বেবিচকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি পরিদর্শন করে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেসব প্রতিবেদন দিয়েছেন তা-ও আমলে নেওয়া হয়। দুদক অনুসন্ধান মতে, বেবিচকের টাওয়ার, বোর্ডিং ব্রিজসহ বড় কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়। ঠিকাদাররা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কাজের খাতটি বেবিচকে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে বিবেচিত। কাজ যেনতেনভাবে করে প্রকৌশলীরা ঠিকাদারদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে টাকা নিয়ে নেন। প্রকৌশলীদের অনেকেরই বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে। দু-একজন ভালো ও সৎ প্রকৌশলী থাকলেও তারা কোণঠাসা। দুদকের অনুসন্ধান বলছে, স্থাবর সম্পত্তির মালিকানায় এটি অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান হলেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। প্রচুর সম্পত্তি অবৈধ দখলে। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দখলদারদের কাছ থেকে ঘুষ নেন।

ফলে বিমান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারছে না। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা একটি প্রতিবেদন সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। এ ছাড়া এনবিআর ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতা চেয়েছি। শিগগির মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে অভিযানে নামব।’