নবুয়তন নেছা
সে অনেক বছর আগের ঘটনা। আমার ছোট বোনের বিয়ে। দিন-তারিখ কিছুই মনে নেই। শুধু এইটুকু মনে পড়ে সময়টা ছিল বর্ষা কাল। ঢাকা শহরের খুব কাছে আমাদের গ্রামের বাড়ি। বুড়িগঙ্গা নদীর শাখা প্রশাখার কোন একটি আমাদের গ্রামের তো বটেই পাড়ার একেবারে গা ঘেঁষে চলে গেছে। আমরা বলতাম ‘হালট’। গ্রীষ্মকালে এই হালটের কোথাও কোথাও বেশ পানি থাকত, আবার কোথাও পানি শূন্য। বর্ষা এলেই হালট পূর্ণ যৌবনবতীর রূপ ধারণ করতো। আশে পাশের গ্রামের ফসলি জমিগুলো নীচু ছিল বিধায় বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যেত। যে দিকেই চোখ যেত শুধু থৈ থৈ পানি, আর মাঝে মধ্যে গুচ্ছগ্রাম। নৌকাই তখন হতো একমাত্র বাহন। আমাদের এলাকার ছইওয়ালা নৌকা দিয়ে তখন গ্রামের মানুষগুলো শহরে-গঞ্জে, হাট-বাজারে যাতায়াত করতো। অনেকে আবার নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বেড়াতে যেতো নিজেদের ছোট খোলা নৌকায় চেপে। বৌ-বেটিরা ঘর থেকে ছোট পাটি সাথে নিত রোদ থেকে বাঁচার প্রয়োজনে ব্যবহার করতে।
ঢাকার কোর্টে নিজের ব্যবসা দেখাশুনা করার জন্য আমার একমাত্র বড় ভাই বেশির ভাগ সময় শহরে থাকতেন। তবে নিয়ম করে গ্রামে আসতেন। যোগাযোগ কখনো বিচ্ছিন্ন করেননি। শুধু আমাদের গ্রাম বা নিকট আত্মীয়ই নয়, আশে পাশের বহু গ্রামের মানুষজন তাঁকে এক নামে চিনতো, মান্য করতো। তিনি মানুষকে ভালবাসতে জানতেন। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ছিল না তার কাছে। তখনকার দিনে গ্রামের লোকজন যে কোন অনিয়ম, নিজেদের কিংবা পাড়া-পড়শীর সাংসারিক, পারিবারিক এমন কি জমি-জমা সংক্রান্ত বিবাদ মেটাতে গ্রাম্য সালিশ ডাকতেন এবং বিচারিক ফয়সালা যাই হত বাদী-বিবাদী তা মেনে নিতেন। আমার বড় ভাইকে ছাড়া সচারচর কোন বিচার সালিশ হত না। তিনি কখনো কারো কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোন টাকা পয়সা নিতেন না। সবসময় ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতেন। তাঁর গত হবার বহু বছর পরও যখনই গ্রামে গিয়েছি , অনেকের মুখে শুনেছি যে গ্রামের অনেক লোক তাঁর সাহায্য পেয়েছেন। বড় ভাইয়ের স্মৃতিচারণে মানুষকে ব্যাকুল হতে দেখেছি।
ছোট বোনের বিয়ে তাই বাড়িতে অনেক ধুমধাম, সাজ সাজ রব। নিকট আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে চলে এসেছেন আগেভাগে। আমাদের গ্রামের চার পাঁচ গ্রাম পরই বরের বাড়ি। বর তৎকালীন বিএ পাশ। দেখতে শুনতেও পছন্দসই; আবার বাড়ির অবস্থাও ভাল। সব মিলিয়ে তাই বর আমাদের সকলেরই পছন্দ। আমি আর আমার বোন ইচ্ছা থাকলেও পড়াশুনা বেশি করতে পারিনি। আমার তিন বছর বয়সে ছোট বোনের জন্ম হয়। তার সাত বছর বয়সে আমাদের বাবা মারা গেলেন। আমার বাবার কোন স্মৃতি আমি মনে করতে পারিনা। আমাদের মাও তারপর বেশিদিন বাঁচেন নি । তৎকালে মেয়েদের পড়াশুনার কথা শোনাই যেত না; আবার গ্রামের অনেকখানি হাঁটাপথ মাড়িয়ে স্কুলে যেতে হত। আমার ছোট বোন খুব মেধাবী ছিল। প্রাইমারীতে বৃত্তিও পেয়েছিল। সমাজের রীতিনীতি মেনে খুব অল্প বয়সে আমাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। হাই স্কুলের চৌকাঠ তাই মাড়ানো হয়নি। বিয়ে বাড়ীর হৈ চৈ বাবুর্চিদের পোলাও-কোরমা রান্নাবান্নার মহাব্যস্ততার অন্যরকম এক অনুভূতিতে যখন আচ্ছন্ন ছিলাম তখন হঠাৎ কানে এল গানের সুর। বেশ দূর থেকে সে সুর ভেসে আসছিল।
রেডিও, টেলিভিশন কি জিনিস তখনকার দিনে গ্রাম ত দূরের কথা সারা দেশের মানুষও তেমন জানত না। রক্ষণশীল, বিশেষ করে মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে গান-বাজনার চর্চা খুবই সীমিত ছিল। কলের গান মানে গ্রামোফোন দশ-বারো গ্রামে হয়ত বা দু-একজনের ছিল। গানের আওয়াজ অস্পষ্ট ছিল; ধীরে ধীরে যেন পরিষ্কার শুনতে পেলামঃ
প্রাণ সখীরে বাবলা বনের ধারে ধারে বাঁশি বাজায় কে
বাঁশি বাজায় কে রে সখী, বাঁশি বাজায় কে…
তুমিতো রাজার কন্যা, আমি রাখাল ছেলে
তোমার সনে আমার পীরিতি কেমন করে হবে…।
বিয়ে বাড়ির লোকজন সবাই অবাক। এই সুর কোথা থেকে আসছে এই নিয়ে বলাবলি। তার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম লোকজন সব কাজকর্ম ফেলে নদীর দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে। নদী হল গ্রামের মাথায়, আমাদের বাড়ি মধ্যপাড়ায়। সে কি দৌড়!, পাড়ার ছোট বড় সকলেই দল বেঁধে নদীর দিকে ছুটছে, আমি ও ছুটলাম।
দৌড়াচ্ছি। দেখলাম, আগে যারা নদীর দিকে ছুটছিল তারা উল্টো আবার গায়ের দিকে আসছে। গানের শব্দ আসছে এক নৌকা থেকে। তাই নৌকা যেদিকে মানুষজনও সে মুখে- পানি আর স্থলে সমান্তরাল। কানে তখন আসছেঃ
ডরাইওনা ওগো ধনী
আমি রাজা তুমি রাণী
প্রজা হবে গাঙ্গের পানি
বাইন্ধা শরীর এক আঞ্চলে
আপন দেশে যাব চলে, না করিও ভয়…
অবাক হয়ে দেখি, গান ভেসে আসা নৌকাটা আমাদের বাড়ির ঘাটে এসেই ভিড়ল। রাজ্যের মানুষও বিয়ে বাড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এতক্ষণে জানলাম আমার বড় ভাই বিয়ে উপলক্ষে ঢাকা থেকে গ্রামোফোন আনার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমার সবাই যখন মত্ত হয়ে কলের গান শুনছিলেম তখন আবার ছন্দ পতন ঘটল। হৃদয় বিদারক চিৎকার শুনতে পেলাম, ‘ওরে আল্লারে! আমি যাইতাম না-আমি যাইতাম না।‘ কান্নার রোল ক্রমশ আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। আবার লোকজনের দৌড়াদৌড়ি-ছুটোছুটি। কাছে গিয়ে দেখলাম এক লোক একটি চার পাঁচ বছরের মেয়েকে টেনে হ্যাচড়ে নিয়ে এসে আমাদের বাড়ি কাছে থামল। আমার ভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসল কি ব্যাপার, কি ব্যাপার করতে করতে।
ভাই জিজ্ঞেস করল,’এই দুইখ্যা, ওরে নিয়া যাস কই?’
লোকটা বাচ্চা মেয়েটার মামা। সে রাগে গমগম করতে করতে বলল, ‘ওরে ফালাইয়া দিমু ভাই, মিরপুর পুলের কাছে।‘
-‘ফালাই দিবি মানে? মানুষ কি ফালাইবার জিনিষ- বদমাইশ কাহিকা।‘
– ‘ভাই, বাপ-মা মরা গরীব মানুষের ম্যাইয়া। কে দেখব ওরে? রোজ রোজ হ্যাইগা মুইতা কাপড় চোপড় নষ্ট করে, গায়ে মাখায়। মানুষ ওরে দেখলে ঘিন্নায় মুখ ফিরায়। আমার তো বউও নাই, কে পরিষ্কার করবো?‘
বাড়িতে আনন্দের দিনে মন খারাপের ঘটনা। আমাদের প্রতিবেশী চাচাত ভাতিজা বউ নূরীর মাকে ডাকল বড় ভাই।
– ‘নূরীর মা, আমি এই মেয়েটার থাকা-খাওয়া, ভরণপোষণ যাবতীয় যা লাগে সব দিমু। তুমি কি মেয়েটারে তোমার কাছে রাখতে পারবা? প্রসাব পায়খনার সময় বাইরে নিয়া যাইবা।‘
নূরীর মা এমনিতেই নরম প্রকৃতির মানুষ ছিল। তার উপর চাচা শ্বশুরের আব্দার। তাই না করতে পারল না। এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল মেয়েটার দেখভালের দায়িত্ব নেয়ার। মেয়েটার নাকি কোমর ভাঙ্গা ছিল। সোজা হয়ে হাঁটতে পারছিল না। ঘোত মেরে মেরে ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর দু হাত ধরল। ভাই তার হাত দুটি ধরে মমতাজড়িত কন্ঠে বলল, – ‘তোর নাম কি রে?’
– ‘হাওয়া’
– ‘হাওয়া, কি খাবি?’
– ‘বিলাই মাছ খামু।‘
– ‘বিলাই মাছ?’ ভাই অবাক বিস্ময়ে আবার শুধায়। আমরাও উৎসাহের সাথে অপেক্ষা করি উত্তর শুনার জন্য। হাওয়া আবার মাথা নাড়ে। বিলাই মাছই সে চায়।
– ‘বিলাই মাছ আবার কি জিনিস রে?’ ভাই দুইখ্যার দিকে তাকালো।
হাওয়ার মামা বলল, ‘ভাই, হাওয়া বিরান (ভাজা) মাছ খাইতে চায়।‘
– ‘মাছ ভাজা তো এখন নাই। পোলাও মাংস খা।‘
না, পোলাও মাংসে তার লোভ নাই। হাওয়ার একই কথাঃ ‘বিলাই মাছ খামু।‘ সেই থেকে হাওয়া আমাদের বাসায় রয়ে গেল। বড় হলে ভাই তাকে বিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু স্বামী বেশিদিন বাঁচে নি ।
বিয়ে বাড়ির হাসি-আনন্দ আবার দ্বিগুণ মাত্রায় ফিরে এল ‘বর আগমনের সংবাদে। লঞ্চের সিটি বাজছে, ভোঁ ভোঁ আওয়াজ ক্রমেই চড়া হচ্ছে। ঐ অঞ্চলে লঞ্চ করে বরযাত্রা এর আগে দেখিনি কেউ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই আবার ছুটছে নদীর দিকে লঞ্চ দেখতে। আমি ও ছুটছি।
নিউইয়র্ক।