সেলিম জাহান
বহু বছর বাদে এবার বইমেলার সময় ঢাকায় ছিলাম। বেশ কয়েক দিন মেলায় গিয়েছি, কখনো-সখনো বিরাট ভিড় উজিয়ে। নানা প্রকাশনায় থেমেছি, নেড়েচেড়ে দেখেছি বিভিন্ন বই, কিনেছিও অনেক বই। কেনা বইয়ের মধ্যে আমার তিন সতীর্থ বন্ধুর বইও আছে মহিউদ্দীন আহমেদের ‘এই দেশে এক দিন যুদ্ধ হয়েছিল’, নরেশ ভূঁইয়ার ‘আমার আমি’ আর শামীম আজাদের ‘বংশবীজ’। বইগুলো হাতে নিয়ে গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল। আহা, আমারই তো বান্ধবদের লেখা মায়াময় যতেœর সঙ্গে বইগুলো নিয়ে এসেছি ঘরে।
এবার পড়ার পালা। আমি একসঙ্গে একাধিক বই পড়ি খাটের পার্শ্বটেবিলে নবনীতা দেবসেনের ‘স্বজন-সকাশের’ উপরে চড়ল নরেশের ‘আমার আমি’, শঙ্খ ঘোষের ‘দেখার দৃষ্টির’ সঙ্গে ঠাঁই পেল শামীমের ‘বংশবীজ’ আর মহিউদ্দীনের ‘এই দেশে এক দিন যুদ্ধ হয়েছিল’র পাশাপাশি থাকল প্রফুল্ল রায়ের ‘যা যখন মনে পড়ে’।
ভাবলাম আমার বন্ধুদের বই দিয়েই পড়া শুরু করা যাক। সেই সঙ্গে ঠিক করলাম একেকজন বন্ধুর বই পড়ব আর প্রতিটির উপরেই কিছু লিখব। না, না, কোনো পুস্তক সমালোচনা নয়, এ বইটি পড়ে কেমন লাগল, কী মনে হলো এসব কথা। ভাবলাম, এটা তো বন্ধুকৃত্যেরও একটা পথ বটে।
বংশবীজই সবার উপরে ছিল। সুতরাং সেটাই তুলে নিলাম। বলতে দ্বিধা নেই, প্রচ্ছদটাও আকর্ষণ করল, এ বিষয়ে পরে বলছি। পড়ার শুরুতেই দুটো কথা মনে হলো।
প্রথমত শামীম এ বইকে আখ্যায়িত করেছে একটি ‘আত্মজৈবনিক উপন্যাস’ বলে। এ আখ্যায়ন যথার্থ। শুধু ‘আত্মজীবনী’-তে ব্যক্তিগত আলেখ্যের প্রাধান্য থাকে, গল্পের ভাগ খুব কম। আর শুদ্ধ ‘উপন্যাসে’ গল্পের প্রাধান্য বেশি, সত্য আলেখ্যের ভাগ কম। কিন্তু একটি সার্থক আত্মজৈবনিক উপন্যাসে এ দুয়ের সুষম সংমিশ্রণ ঘটে এবং বংশবীজে শামীম সে কাজটি অত্যন্ত সার্থকভাবে করেছে।
দ্বিতীয়ত বংশবীজ শব্দটিও আমাকে ভাবিয়েছে। এক অর্থে ওই শব্দটি একটি উৎস থেকে একটি বংশের জন্ম ও বিস্তার বোঝাতে পারে এবং সে অর্থে বংশবীজ একটি বংশলতিকার গল্প হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু শামীম সে পথে যায়নি। সে তার বংশের, পূর্বপুরুষের, পিতৃ ও মাতৃকুলের সদস্যরা কেমন করে বহুকাল ধরে একেকটি বীজের মতো ছড়িয়ে গেছে নানা দিকে, মিশে গেছে বৃহত্তর সমাজ স্রোতধারার সঙ্গে সংগ্রামে ও প্রতিষ্ঠায়, সে আখ্যানই শুনিয়েছে আমাদের। তার নিজের ভাষ্যে, ‘বংশবীজ তাই ছড়িয়েছে দুভাবেই বংলাদেশের ভেতরে সম্প্রসারিত পরিবারের দ্বারা এবং সাগর পেরিয়ে অভিবাসনের মাধ্যমে বিলেতের সঙ্গে একটি যোগসূত্রতা স্থাপনের মাধ্যমে। ওই বীজেরই তো একটি কণা আমি।’
এ বিষয় দুটো সামনে রেখে যে মৌলিক প্রশ্নটি আমার মনে চিলিক দিয়ে উঠেছে, তা হলো বংশবীজ যদি শামীমের আত্মজৈবনিক উপন্যাস হয়, তাহলে তা তো একটি ব্যক্তিগত আলেখ্য, তাতে আমাদের আগ্রহ ও উৎসাহ কেন থাকবে? বইটি পড়তে পড়তে এ প্রশ্নের জোরালো সদুত্তর আমি পেয়ে গেছি। আমার মনে হয়েছে যে, বংশবীজ শামীমের ‘আত্মজৈবনিক উপন্যাস’ হলেও বইটিতে আমাদের সবার আগ্রহ ও উৎসাহের কারণ তিনটি হতে পারে।
প্রথম যে কারণে বইটি সবার মনোযোগ কাড়বে, তা হলো এ বইটিতে একটি সমাজবিজ্ঞানের নৃতাত্ত্বিক চালচিত্র আছে। বিলেত বিশেষ করে লন্ডনকে সে চালচিত্রের মধ্যমণি করে বিভিন্ন সময়ে সে দেশে নানা দেশের নানা জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের একটি নির্মোহ চিত্র সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। খুব পরিষ্কার করে বিধৃত হয়েছে কেমন করে বিভিন্ন জাতি সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে এসেছে, কোন গতিময়তা সেখানে কাজ করেছে, কেমন ছিল নবাগত অভিবাসীদের সংগ্রামের ইতিহাস, কী করে এ মানুষগুলো সে চালচিত্রের প্রকৃতি, রূপ, রস পাল্টেছে। একটা চলমান ছবির মতো এসব বিষয় বর্ণিত হয়েছে বংশবীজে।
এ বিস্তৃত স্রোতধারার মধ্যেই শামীম প্রোথিত করেছে বিলেতে সিলেটবাসীদের আগমন। নিজের পারিবারিক সদস্যদের ইতিহাসকে আতশকাচ হিসেবে ব্যবহার করে সিলেটবাসীদের অভিবাসনকে একটা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে তুলে ধরা হয়েছে। ভাবা যায়, তার জ্যেষ্ঠ সদস্যরা বিলেতে এসেছিলেন ১৯২৮/২৯ সালের দিকে, ঠিক যে সময়ে সৈয়দ মুজতবা আলী জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার্থে গিয়েছিলেন? পরবর্তী সময়ে শামীমের পিতৃ-মাতৃকুলের বহু আত্মীয়স্বজন বিলেতে এসেছেন, যাদের অভিবাসনের কথা, সংগ্রামের আখ্যান, প্রতিষ্ঠার কথা বড় মায়াময় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে বংশবীজে। উল্লিখিত হয়েছে, ‘দুই কিসিমের মানুষ কালা পানি পেরিয়ে’ বিলেতে এসেছিলেন ‘একদল স্কলারশিপ নিয়ে বা বিত্তবান পিতা কিংবা হবু শ্বশুরের অর্থে পড়তে ও বেড়াতে এসেছিলেন। আরেকদল নিজে নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদে প্রবল চিত্তচাঞ্চল্যে দেশত্যাগ করে নিজ বুদ্ধি ও শ্রমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।’ শামীমের পূর্বপুরুষরা সম্ভবত দ্বিতীয় দলে পড়বেন।
শামীম বলেছে, ‘এ আমার পূর্বপুরুষের অভিযাত্রার একটি উপাখ্যানও বটে।’ কিন্তু বংশবীজের পাতার পর পাতা পেরিয়ে আমরা দেখতে পাই, এ অভিযাত্রা তো শামীমের নিজেরও, ‘ওই বীজেরই একটি কণা’ হিসেবে। ‘বংশবীজ’ বইটি তো ওর পথযাত্রারও আলেখ্য’, যে আলেখ্যের কথা পরে বলব। সুতরাং আত্মজৈবনিক উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও প্রথম যে কারণে বংশবীজ আমাদের সবার জন্য প্রাসঙ্গিক তা হলো, বিলেতে অভিবাসনের ঐতিহাসিক সমাজ চিত্রণ এবং সেই স্রোতধারায় পারিবারিক পথযাত্রার রেখা টেনে সিলেটবাসীর অভিযাত্রার চিত্র অংকন।
দ্বিতীয় যে কারণে আত্মজৈবনিক উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও বংশবীজ আমাদের হৃদয়-মনকে টানে তা হচ্ছে, শামীমের বৃহত্তর পরিবারের বর্ণাঢ্য গল্প; যে পরিবারের বেশির ভাগ মানুষই সুপুরুষ ও সুন্দরী ছিলেন। ওর মা-বাবার কথা পড়তে পড়তে আমরা বিস্মিত হই সেই যুগে তাদের মুক্ত চিন্তা, মুক্ত বুদ্ধি আর জীবন দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতা দেখে।
শামীমের চাচা ও মামাদেরও মনে হয় রূপকথা থেকে উঠে আসা মানুষ। সেই সঙ্গে রয়েছে কিছু অবিস্মরণীয় চরিত্র ওর ফুলুরি চাচা, চেরাগ চাচা, টংগি ভাই, মায়া মামা। শামীমের মাতুলদের অনেকেই বিলেতবাসী ছিলেন বিভিন্ন সময়ে এবং তাদের দেশে আসা-যাওয়ার আখ্যান পাওয়া যায় বইটিতে এক স্বাদু বর্ণনায়। আসলে শামীমের কথনের গুণে প্রতিটি চরিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে, যাদের মতো মানুষকে আমরা চিনি, দেখেছি আমাদের পারিবারিক ম-লেও।
বইটি পড়ে বুঝতে পারি, শামীমের ছোট খালামণি তার সময়ের থেকে অনেক এগিয়েছিলেন সর্ব অর্থেই। যেমন তিনি বাংলাদেশের প্রথম মরণোত্তর মহিলা চক্ষুদানকারী। খালু আলাউদ্দিন চৌধুরীও ছিলেন ব্যতিক্রমী এক মানুষ। বংশবীজের যেকোনো পাঠকই বুঝবেন এরা শামীমের শুধু অতি প্রিয়জনই নন, শামীমের চিন্তা-চেতনায় এদের বিরাট প্রভাব পড়ছে। উল্লেখ্য, বংশবীজ উৎসর্গও করা হয়েছে খালু আলাউদ্দীন চৌধুরিকে এবং বড় মমতাভরা উচ্চারণে।
পারিবারিক আখ্যান পর্বে সে সময়কার মফস্বল শহরগুলোর দৈনন্দিন জীবনধারা, সমাজ কাঠামো, মানুষে-মানুষে বন্ধন, নানা আনন্দ-উৎসব ও গ্রামে বেড়ানোর কথা ছবি আঁকার মতো বলা হয়েছে। অতি আন্তরিক কথনে পারিবারিক আখ্যান বলতে গিয়ে সে সময়টাকেও ধরেছে শামীম, যে চোখে সে ওই সময়টাকে দেখেছে, যা ওর মনে হয়েছে।
এ সবকিছুর সঙ্গেই আমরা একটা একাত্মতা অনুভব করি, একটা নৈকট্যের টান পাই। নানি ভাইকে তো আমাদের মাতামহী মনে হয়। ছোট মামা, মামুন মামার মতো মাতুল তো আমাদেরও আছে। সময়ের বর্ণনায় বুঝি, সে তো আমাদেরই সময়; যে নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, জামালপুরের জীবনের কথা শামীম বলেছে, আমাদের অনেকেরই খুলনা, কুমিল্লা কিংবা মাদারীপুরের জীবনের সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়? মনু গাঙ কি সিলোনিয়া গাঙের চেয়ে ভিন্ন? ‘মুরুজপুর’ শামীমের ‘মন মাতানো ইচ্ছে ঘুড়ি’। তেমনি ‘শিবপুর’, ‘চন্দনপুর’, ‘মোহিতপুর’ কি শামীমের বন্ধুদের অনেকেরই ‘হৃদয় কাঁপানো গঙ্গা ফড়িং’ ছিল না?
এ একাত্মতা বোধ, এ নৈকট্যের সুরভি এবং ‘এ তো আমাদেরই মা-বাবা, নানি-খালা, চাচা-মামা’ এ ভাবনার কারণে বংশবীজ শুধু শামীমের নয়, আমাদেরও আত্মজৈবনিক উপন্যাস হয়ে উঠেছে। অমিয় চক্রবর্তীর ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন, ঝোড়ো হাওয়া আর পড়ো বাড়িটাকে মেলাবেন তিনি মেলাবেন’-এর মতো বংশবীজ শামীমের জীবনের সঙ্গে আমাদের জীবনকেও তো মিলিয়েছে। এ বইয়ের অন্যতম সার্থকতা তো সেখানেই, যেখানে এটা একটা আরশির কাজ করে, যাতে আমরা আমাদের অতীতের পারিবারিক জীবন, তার মানুষগুলো এবং সে সময়ের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাই।
তৃতীয় যে কারণে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস হওয়া সত্তে¦ও আমরা এর প্রতি বিস্মিত চোখে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হই তা হচ্ছে, এটা ‘পূর্বপুরুষের দীর্ঘ পথ পরিক্রমা রেখার’ ক্রমধারায় একজন তরুণীর অভিযাত্রা। সে তরুণী শুধু সুদর্শনা, সুশিক্ষিত, পরিশীলিত, জীবনে প্রতিষ্ঠিতই নয়; আশির দশকে সে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সাংবাদিকতার জগতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, বহু বিষয়ে নতুন ধারার প্রবর্তক এবং বাংলাদেশের ঘরে ঘরে একটি ঘরোয়া নাম। ঘরের বাইরের জীবনের প্রতিষ্ঠা, যশ, খ্যাতি এবং পুত্র-কন্যা, সুপ্রতিষ্ঠিত স্বামী নিয়ে ঘরের ভেতরের সুনন্দ সংসারের কর্তৃত্ব নিয়ে পরিপূর্ণ সে। তবু হঠাৎ করে শামীম কেন সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে দেশ ছাড়ল, পাড়ি দিল সাত-সমুদ্দুর, চলে গেল বিলেতে? ‘মাথার ভেতরে কোনো বোধ’ কাজ করছিল তার? বংশবীজে একাধিক ব্যাখ্যা দিয়েছে সে। বলেছে চল্লিশ এক সর্বনাশা বয়স, তার আগেই জীবন বদলাতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুসুমের মতো, ‘রোদ থাকতেই আমার সব গুছাতে হবে।’ আাাবার অন্য জায়গায় বলেছে, ‘সিলেটি উত্তরাধিকারেই আমার রক্তে ছিল দেশে-বিদেশে বেরিয়ে পড়ার সাহস ও বোকার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার রোগ।’ কিংবা ‘এখন উপলব্ধি হয় যেকোনো অভিবাসীর মতো আমিও মরিয়া হয়ে আমার যা যা আছে, তা নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছি।’
কোনো বোধ ওকে তাড়না করেছিল, সেটি নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তাগ্রস্ত নই; আমার কাছে বেশি আগ্রহের বিষয় হচ্ছে, ঝাঁপিয়ে পড়ার পরে সে কী করল। বংশবীজে তিনটি ধারা খুঁজে পেয়েছি।
এক ওর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের গতিধারা। দুই সন্তান নিয়ে লন্ডনে নতুন জীবনের শুরু, পরে স্বামীর যোগদান। কিন্তু সে পরিপ্রেক্ষিতে অবাক মেনেছি দুটো কারণে। প্রথমত নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও শামীম প্রতিনিয়ত আনন্দ আর স্ফূর্তি খুঁজে বেড়িয়েছে এবং সেখানে ওর সঙ্গী হয়েছে ওর পরিবার। দ্বিতীয়ত পারিবারিক গ-িতে ওর বিভিন্ন ভূমিকায় কোনো খামতি সে রাখেনি, না স্বামী-সন্তানের কাছে, না সম্প্রসারিত পরিবারের কাছে। কেমন করে এ অসাধ্য সাধন করেছে দশভুজার মতো, সে এক কাহিনী বটে; যা বিধৃত হয়েছে বংশবীজের পাতায় পাতায়।
এ ব্যক্তিগত পারিবারিক পরিপ্রেক্ষিত ছাড়িয়ে আরো দুটো বিষয় আমাদের আকর্ষণ করে। একটি হলো, পেশাগত দিক থেকে শামীমের সংগ্রাম ও প্রতিষ্ঠা বিলেতে বাংলা ভাষার অন্যতম কবি হিসেবে এবং অন্যটি হলো, দেশের জন্য সংগ্রাম বিলেতে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং নবীন বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত প্রজন্মকে বাংলাদেশ চেনাতে।
পেশাগত দিক থেকে শিক্ষক হিসেবে বিলেতে কেমন করে এ দেশের নানা ব্যবস্থা আর কাঠামোর জিনিস শেখে এদেরকেই পরাস্ত করেছে, কেমন করে নিজ যোগ্যতায় সমতার ভূমিটি দখল করেছে শামীম তার বর্ণনা দিয়েছে বড় মন ভরানো কথনে। কিন্তু তার চেয়েও একটা ঘোর লাগা মন নিয়ে পড়েছি কেমন করে আমাদের এ সতীর্থ বন্ধুটি ইংরেজি ভাষায় নাটক লিখেছে ‘হপস্ স্কচ ঘোস্ট’ এবং তার শতাধিক অভিনয় হয়েছে লন্ডনে ও লন্ডনের বাইরেও। জানতাম না তো আগে যে, ১৯৯৭ সালে ওর কবিতার অনুবাদ বেরিয়েছে আমেরিকার সম্ভ্রান্ত সাহিত্য সাময়িকী ‘দ্য নিউইয়র্কের’।
ভাবা যায় যে, কবি হিসেবে শামীম আমন্ত্রিত হয়েছে ‘বাকিংহাম প্রাসাদে’, করমর্দন করেছে স্বয়ং ব্রিটেনের রানীর সঙ্গে, মিলিত হয়েছে রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে? মনে হয় এক রূপকথা, যা আমাদের টানে।
বংশবীজ পড়তে পড়তে আমরা একজন সংগ্রামী মানুষেরও তো দেখা পাই, যে বাংলাদেশকে বিলেতে প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। শামীম লিখেছে যে, যখনই যেটুকু সুযোগ পেয়েছে, তখনই ও দাঁড়িয়ে গেছে শুধু এটুকু বলতে যে, সে বাংলাদেশের। যাতে ওরা জানে যে, বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে। কেন ও এটি করেছে? শামীমের ভাষায়, ‘দীর্ঘ তিন দশক প্রবাসে থাকলেও এক টুকরো বাংলাদেশ আমি হৃদয়ে সর্বদা বহন করি।’ এ বোধ আর চেতনা থেকে সে গড়ে তুলেছে নানা প্রতিষ্ঠান, যেমন লন্ডনের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র; যুক্ত হয়েছে নানা সংগঠনের সঙ্গে, যেমন রিচ মিক্স। লিখেছে দেদার পত্রিকায়, আবির্ভূত হয়েছে নানা গণমাধ্যমে, আয়োজন করেছে বাঙালি আর বাংলাদেশি মেলার, আন্দোলন করেছে লন্ডনে স্থায়ী শহীদ মিনারের জন্য। নিজেকে নেপথ্যে রেখে এ সবকিছুর কথা, বিশেষত সিলেটবাসীর প্রেক্ষাপট থেকে শামীম বর্ণনা করেছে বংশবীজে।
‘বাংলাদেশ আমার শিকড়, আমার ঐতিহ্য, আমার অহংকার’ এ চেতনা থেকেই শামীম বংশবীজে বলেছে যে, ‘অনাবাসী ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের শিকড়, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কাছে নিয়ে যেতে আমি নিরন্তর সচেষ্ট।’
বংশবীজে বর্ণিত আশির দশকে একজন বাঙালি তরুণীর একক অভিযাত্রা আমাদের যেমন নাড়িয়ে দেয়, তেমনি সে বই থেকে আমরা বুঝতে পারি, এ যাত্রা একটি বৃহৎ চালচিত্রের অংশমাত্র; ‘পূর্বপুরুষদের দীর্ঘ পথপরিক্রমা রেখার একটি বিন্দু।’ দুটো মিলেই আমাদের অভিনিবেশ সেদিকে যায় এবং শামীমের বংশবীজ ‘যে তুমি হরণ করোর’ মতো আমাদের হৃদয় হরণ করে।
এসব বিস্তৃত বিবেচনা ভিন্নও তিনটি কারণে ‘বংশবীজ’ আমাদের মনে এক অনির্বচনীয় মুগ্ধতার সৃষ্টি করে। এক এর কাব্যিক ভাষা। জয় গোস্বামীর গদ্য পড়লে যেমন বোঝা যায়, তেমনি ‘বংশবীজ’ পড়লেই বোঝা যায় যে, এটি একজন কবির গদ্য।
দুই পুরো বইটিতে ‘সিলেটি সংলাপের’ নন্দিত সফল প্রয়োগ, যা সিলেটি ভাষাভাষী নয়, তাদেরও আনন্দ দেবে। যখন পড়ি, ‘ইতা কিতা ইংলিশে খায়নি? খায়নি মানে? বুতাইয়া খায়। বেউশ হইয়া খায়’, তখন হাসি রাখি কোথায়?
তিন বংশবীজের প্রচ্ছদ। শিল্পী নির্ঝর নৈশব্দের করা অর্থবহ প্রচ্ছদটি বইটির মতোই আকর্ষণীয়। প্রচ্ছদের উল্টে দেয়া লন্ডনের ছবিটি শামীমের লন্ডন অভিমুখী ও লন্ডনকেন্দ্রিক তিন দশকের জীবনকে একটি প্রতীকী প্রতিচ্ছায়া হিসেবে ধরেছে। ভারি হৃদয়জাগানিয়া প্রচ্ছদ।
বংশবীজের শেষ সীমায় এসে শামীম বলছে, ‘শুয়ে শুয়ে ভাবি ‘৯০ থেকেই আমি দেশান্তরী। বিলেতে আমার তিন দশক হবে। ভাবা যায় যায়। যা যায় না তা হলো, এই তিন দশক ধরেই আমার সত্তাখানি ঝুলে আছে বাংলাদেশের পলি আর নুনে।’
‘ইংরেজিতে একখানা উপন্যাস যদি লিখতে পারতাম আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগত। কবির জন্য পৃথিবী বড় কঠিন। বিচ্ছিন্নভাবে এই যে জায়গায় জায়গায় কবিতা উঠেছে তো কী হয়েছে? আমার আসলে একখানা ইংরাজি কবিতা গ্রন্থ চাই। অর্ধেক তার ভরব বাংলা কবিতার অনুবাদে বাকি অর্ধেক ইংরাজি মৌলিকে।’ এ অতৃপ্তি, এমন তীব্র আকাক্সক্ষাই তো সব সৃষ্টিশীল কাজের মূল চালিকাশক্তি। বংশবীজের পরে তেমনি একটা বই হয়তো আমরা শামীমের কাছ থেকে পাব।
বংশবীজ শেষ হয়েছে এভাবে, ‘কত কিছু দেখেছে এ বৃক্ষ। হে বৃক্ষ, আমিও তোমার গর্তে আমার কবিতার উইলখানি রেখে গেলাম। শীত শেষে তোমার গোড়ায় বসন্তের প্রথম ব্লুবেল ফুটলে, কাঠবেড়ালী তার পুচ্ছ নাচিয়ে প্রভাত আনলে তারাই হয়তো বলবে : এখানে এক দিন বাংলাদেশের এক কবি এসেছিল। বলবে কি’
কবি শামীম আজাদ, বলবে, নিশ্চয়ই বলবে। বৃক্ষ কখনো মিথ্যে কথা বলে না। কান পাতলে তুমি এও শুনবে যে, বৃক্ষ আরেক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় তোমাকে বলছে,
‘বন্ধু, সুখে থেকো আর মনে রেখো দেবদারুচ্ছায়ে,
কিছু কিছু লতাগুল্ম, ছোট গাছপালা তার কথা,
তোমার মন তো ভালো, মনে রেখো, পরিত্রাণ করো,
প্রকৃত সংকট থেকে, ভালবাসাহীনতার থেকে।’
লেখক : নিউইয়র্কে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক