বিশেষ দিনটি যে কারণে বেছে নিলেন ট্রাম্প

এম শাফিউল্লাহ

নিজের নির্বাচনী প্রচারণার প্রতিশ্রুতিতে অটুট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছরের ডিসেম্বরে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
একই সঙ্গে ইসরাইলে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস চলতি বছরের ১৪ মে তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে জেরুজালেমে নেয়ার কাজের উদ্বোধনও হয়ে গেছে। ট্রাম্প নিজে দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিদলে তার মেয়ে ইভাঙ্কা ও তার ইহুদি স্বামী এবং হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের জ্যেষ্ঠ সহকারী জারেড কুশনার উপস্থিত ছিলেন। কুশনারকে বিয়ে করার জন্য ইভাঙ্কা নিজেই ইহুদি ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।
প্রশ্ন হল জেরুজালেমে দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার জন্য ১৪ মে’কে কেন বেছে নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ইহুদিদের রঙ্গমঞ্চের দিকে তাকালে তাদের কাছে এই দিনের জানা-অজানা কিছু গুরুত্ব উন্মোচিত হয়। ৭০ বছর আগে ১৯৪৮ সালের এই দিনে ইসরাইলিরা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করে, যা কয়েক শতাব্দী ধরে তাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। রেকর্ড থাকা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার ইহুদি সেনা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করেছে এই স্বপ্নে যে, ব্রিটিশরা ইহুদিদের একটি স্বাধীন ভূখ- দেয়ার লক্ষ্যে করা বেলফোর ঘোষণার বাস্তবায়ন করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অধৈর্য ইহুদি গ্রুপগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসী সেল গঠন করে। ক্রমবর্ধমান ইহুদি সন্ত্রাসবাদের মুখে ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনের ওপর নিজেদের ম্যান্ডেট ছেড়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন এবং অঞ্চলটি জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করে।
ওই সময় ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ- যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আরব ও এক-তৃতীয়াংশ ছিল ইহুদি। জাতিসংঘের বিশেষ একটি কমিশন পৃথক দুটি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কয়েকটি সুপারিশ করেছিল। যার মধ্যে ছিল- এক. ফিলিস্তিনি ভূমির ৫২ শতাংশ নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করা হবে। যার মধ্যে ৪ লাখ ৯৭ হাজার আরব ও ৪ লাখ ৯৮ হাজার ইহুদি জনসংখ্যা থাকবে। দুই. ৪৮ ভাগ ভূমি নিয়ে একটি আরব দেশ গঠন করা হবে। যেখানে ৭ লাখ ২৫ হাজার আরব ও ১০ হাজার ইহুদি থাকবে। তিন. জেরুজালেম ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা হবে আন্তর্জাতিক জোন।
পরিকল্পনাটি ছিল এত দুরভিসন্ধিমূলক যে, এর মধ্য দিয়ে ইহুদিদের বিস্তৃত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা হয় বেলফোর ঘোষণার আলোকে। এর আগে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তার সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় মাতৃভূমি গঠন করবে এবং এ লক্ষ্য অর্জনে তাদের পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ চেষ্টা নেয়া হবে।
ইহুদি অনুগ্রহভাজনদের পক্ষে কূটকৌশল চালানোর জন্য অতিমাত্রায় এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেপথ্য চাল চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বলেছিলেন, ইহুদিবাদী গ্রুপগুলো ১৯৪৭ সালে তার ওপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করেছিল বেলফোর ঘোষণায় মার্কিন সমর্থন দেয়ার, এমনকি এর পক্ষে ভোট দিতে স্বাধীন দেশগুলোকে চাপ দেয়ার জন্যও। তিনি স্বীকার করেছিলেন, ‘হাজার মানুষের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল, যারা ছিল ইহুদিবাদের সাফল্যের পক্ষে খুবই উত্তেজিত, বিপরীতে আমার নির্বাচকম-লীর মধ্যে হাজার হাজার উত্তেজিত আরব ছিলেন না।’
ইউরোপে হলোকাস্ট বা ইহুদি গণহত্যার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে ইহুদি শরণার্থীদের লাইন প্রতিহত করার জন্য ফিলিস্তিনকে ভাগ করে ইহুদিদের জন্য পৃথক একটি ভূখ- তৈরি করতে প্রাথমিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয় লন্ডন ও ওয়াশিংটন। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যদ্বাণী করে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে যে, মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি দেশ সুয়েজ খাল দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের নৌচলাচলের জন্য নিরাপদ হবে, এমনকি এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নেয়ার ক্ষেত্রে ইহুদি দেশটি নিরাপত্তাদাতা হিসেবে কাজ করবে।
পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ১৪ মে ১৯৪৮, ব্রিটেন ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট ত্যাগ করে। তার কিছুক্ষণ পরই ইহুদিবাদী নেতা ড. ওয়েইজম্যান ইসরাইলি পতাকা উত্তোলন করেন এবং ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। আরবরা দেশকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে এবং যুদ্ধে যোগ দেয়।
সুসংঘবদ্ধ এবং যুদ্ধজ্ঞানে সমৃদ্ধ ইহুদিরা পশ্চিমাদের সমর্থনে আরব দেশগুলোকে পরাজিত করে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারির যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল পশ্চিম জেরুজালেমসহ বিভক্ত নগরীর ৭৭ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়। তখন জর্ডান পবিত্র ভবনগুলোসহ পশ্চিম তীরকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ব-জেরুজালেম গঠন করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল আবার পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, সিনাই ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। বাকিটা তো ইতিহাস।
বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম ইসরাইলের কার্যকর দখলের আওতায় আছে, যারা এরই মধ্যে একে ইহুদি জনগণের কেন্দ্রীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশই ইসরাইলি ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বর্তমানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র ১৪ মে জেরুজালেমে নিজেদের দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইসরাইলের ঘোষণায় বৈধতার সিল মেরেছে। এর মধ্য দিয়ে ১৪ মে ইহুদি দেশটির ৭০তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কীর সঙ্গে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে মিলিয়ে দিলেন তিনি। ১৪ মে হল কয়েক শতাব্দীর ইহুদিবাদেরই প্রতীকী তারিখ।
লেখক : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক মহাপরিচালক ও ফিলিস্তিনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।