বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে আসছেন ২৩ সেপ্টেম্বর। তাঁর এই আগমন উপলক্ষে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সব বাংলাদেশির হয়ে তাঁকে ঠিকানা জানাচ্ছে সুস্বাগতম। বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে যিনিই দায়িত্ব পালন করেন, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মূলত তিনিই বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এই যোগদান অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা, বাধ্যতামূলক নয়। অনেক দেশেরই প্রতিনিধি দলে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দেন না। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কখনও ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায়নি।
এখানে আরও একটি ঘটনা ব্যতিক্রমহীনভাবে ঘটে। তাহলো, যিনিই সরকার প্রধান হিসেবে আসুন, তাঁকে সর্বজনীনতার নামে আসলে দলীয় সংবর্ধনা দান। অন্যদিকে, বিরোধী পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসছেন ২৩ সেপ্টেম্বর। ঐদিনই তাঁকে বিকেল ৫টায় ম্যানহাটনের হিলটন হোটেলের বলরুমে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। যদি তাঁর কর্মসূচির কোন পরিবর্তন না ঘটে, তবে তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। মনে করা হচ্ছে তাঁর ভাষণে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে রোহিঙ্গা ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয় রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ আশা করে অবিলম্বে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে আহ্বান জানাবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ দলের নেত্রী হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের ক্ষেত্রে অনন্য এক রেকর্ডের অধিকারী। তিনি এ দফায় টানা দশমবার এবং আগের টার্মে ৫ বার, মোট ১৫ বার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এবারও অধিবেশন চলাকালীন তিনি বিভিন্ন দেশের নেতার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদি এবং আন্তর্জাতিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনায় মিলিত হবেন। স্থানীয় বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলবেন। ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাঁর জন্মদিন উদযাপনের কথা রয়েছে। ২৮ তারিখে তিনি নিউইয়র্ক ছাড়বেন এবং লন্ডন হয়ে দেশে ফিরবেন। এরপর স্বাভাবিকভাবেই আশা করা যায়, তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়বেন।
প্রবাসী আমরা যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনাকে আমাদের মাঝে পাই, তখন স্বদেশের সরকার প্রধান হিসেবে আপনাকে স্বাগত জানিয়ে পরিতৃপ্ত হই, আনন্দিত এবং উল্লসিত হই। বিশ্বরাজধানী খ্যাত বহুজাতিক এই শহর নিউইয়র্কে আপনাকে পেয়ে আমরা প্রবাসী কম্যুনিটি গর্বিত হই। উজ্জীবিত হই। সেই সঙ্গে আমরা আমাদের প্রবাসী জীবনের আবেগ-উচ্ছ্বাস, হাহাকার ও আকুতি প্রকাশের সাহসও অর্জন করি।
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা কায়মনোবাক্যে কামনা করি আপনার সফর আনন্দময় হোক। এমন কোন দাবি বা আকুতি জানাতে চাই না, যা আপনার সফরকে নিরানন্দময় করে তোলে। আপনার সফর সফল হোক আন্তরিকভাবে এ প্রত্যাশা জানিয়ে প্রবাস কম্যুনিটির পক্ষ থেকে আপনাকে অভিভাবক জ্ঞান করে, আপনার সামনে দু-চারটি কথা বলা। এতে আমাদের ভারি হয়ে থাকা প্রবাসীমন হালকা হয়। আবার এমন কোন দাবি জানাতে চাই না, যা আপনার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
আপনার সফর উপলক্ষ করে কিছু কথা বলার চেষ্টা করা এ কারণে যে, আমাদের বিশ্বাস, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি যেমন প্রবাসীদের বেদনা অনুভব করতে পারবেন, তেমনি আমাদের প্রত্যাশা পূরণে আপনিই একমাত্র ক্ষমতার অধিকারী। প্রবাসের মানুষদের মনে নিত্যদিনের দুঃখ-কষ্ট, তা সত্ত্বেও তাদের সাধ্যমত দেশের সব সঙ্কটে, বিপদে-আপদে স্বদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। প্রবাসের শত প্রতিকূলতা দু’হাতে সরিয়ে দেশের শেকড়কে সতেজ রাখা, নতুন প্রজন্ম যেন তাদের আদি-পুরুষদের পরিচয় জানতে পারে সে লক্ষ্যে দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত থাকে। তাদের কষ্টার্জিত শ্রমে অর্জিত বিদেশি মুদ্রার যতটা সম্ভব পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে শক্তি যোগানোর চেষ্টা করে।
এসব কাজের প্রশংসাও যে প্রবাসীরা দেশের মানুষের কাছে পায় না, তা নয়। নানা কার্যোদ্দেশ্যে যারা সফরে আসেন তারা যেমন, তেমনি দেশে থেকেও আপনাদের মত সরকারের সদস্য, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবীদের প্রশংসাও জোটে। সবাই বলে থাকেন- প্রবাসীদের দেশপ্রেম অনেক গভীর, দেশের মানচিত্র প্রবাসীরা অষ্টপ্রহর বুকের মধ্যে বয়ে বেড়ান। প্রশংসা অবশ্যই ভাল লাগে। কিন্তু মৌখিক প্রশংসা, এমনকি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ স্বীকৃতিতে সব সময় মন ভরে না। বাস্তব প্রাপ্তি যখন মেলে না, তখন অন্য সব প্রশংসা ও স্বীকৃতি অসাড় বলে মনে হয়।
প্রবাসীরা মনে করে- মৌখিক প্রশংসা এবং পিঠ চাপড়ানো এবং বাস্তব প্রাপ্তির মধ্যে সামান্য কিছুটা মিলও যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে সবকিছুই কৃত্রিম বলে মনে হয়।
জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে হোক, কিংবা অন্য যে কোন উপলক্ষে আপনি যুক্তরাষ্ট্রে আসুন, আমরা আশান্বিত হই- এবার বুঝি প্রবাসীদের ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়বে। প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের জন্য এমন কিছু ঘোষণা দিয়ে যাবেন, যাতে তাদের মন ভরে উঠবে। আমরা বার বার হতাশ হয়েছি, কিন্তু আশা ছাড়িনি।
তাই এবারো আপনার নিউইয়র্ক আগমনে আমাদের প্রায় সব পুরনো দাবি নিয়েই হাজির হচ্ছি। সেই নিউইয়র্ক-ঢাকা রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ফের চালু করা। বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় যে প্রবাসীদের দেশে যাওয়া বন্ধ হয়েছে, এমন নয়। তবে দেশের পতাকাবাহী বিমান এবং মাতৃভাষার সেবকদের সেবা বঞ্চনার হাহাকার নিয়ে যেতে হয়। তা থেকে মুক্তি পেতেই বার বার বাংলাদেশ বিমান চালুর আকুতি জানানো। বিমান নিয়ে আমাদের আকুলতা কোন ফালতু বা অযৌক্তিক আবেগ নয়। এর মধ্যে দেশপ্রেমও রয়েছে। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যে লোকসানের যুক্তি দেখিয়ে এই ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে, অভিজ্ঞজনেরা সেটাও সত্য এবং যুক্তিসংগত বলে মনে করেন না। বাংলাদেশের যাত্রীনির্ভর হয়ে পরিচালিত বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্স কিন্তু ঠিকই মুনাফা করে যাচ্ছে।
এর বাইরে জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণের দাবিকেও অস্বীকার করে আসা হচ্ছে কিন্তু অযৌক্তিক প্রমাণ করা যাচ্ছে না। আমরা অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে চাকরি ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের আন্দোলন দেখলাম। এমনকি জাতীয় সংসদেও কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। তাই দেশের নানামুখী অর্জনে যদি প্রবাসীরা ইতিবাচক ভূমিকা রেখে থাকেন, তবে তাদের জন্য কয়েকটি আসন (কমপক্ষে ১০টি আসন) সংরক্ষিত রাখার দাবিকে অযৌক্তিক বলে অস্বীকার করা যাবে না। এই সঙ্গে প্রবাসীদের ভোটের অধিকার আর দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুততর করার দাবিও প্রবাসীদের অনেক পুরনো। পুরনো দাবি নিউইয়র্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাও। এ সব দাবি, প্রবাসীরা মনে করে, সরকার একটু আন্তরিক হলেই বাস্তবায়ন সম্ভব। দেশে যত ব্যাংক কেলেঙ্কারীর কথা শোনা যায়, তার প্রেক্ষিতে নিউইয়র্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকের যৌক্তিকতাও প্রতিষ্ঠিত করে।
আজকের যে বাংলাদেশ তাতে প্রবাসীদের প্রধানতম আকাক্সক্ষা দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং একটি অবাধ নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজন গ্রাহ্য নির্বাচন-যেখানে সব দল আস্থার সঙ্গে অংশ নিতে পারে। এর বাইরে প্রবাসীরা একটি ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট, খুন-ধর্ষণ, রাহাজানি মুক্ত বাংলাদেশও প্রার্থনা করে। যাতে দেশের মানুষও এসব অন্ধকার পরিবেশ থেকে মুক্তি পায়। আবার প্রবাসীরা দেশে গিয়ে শান্তি ও স্বস্তিতে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কাটিয়ে আসতে পারে। বিমান বন্দরের হয়রানি থেকে শুরু করে দেশের কোথাও কোন দুর্ভোগের সম্মুখীন না হয়। স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর পর প্রাবসীরা প্রচ-ভাবে একটি গণতান্ত্রিক, একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন বাংলাদেশ আশা করে। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, শিল্পপতি- এদের আচরণ থেকে বোঝা খুব মশকিল, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই সামনে অগ্রসর হচ্ছে কি না। মনে হয় নেশন বিল্ডিং-এর চেয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ বিল্ডিংয়েই তারা অধিক মগ্ন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি প্রবাসী মনের এই ভাবনাগুলো কতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন, সে একান্তই আপনার বিষয়। তবে জনমনের ভাবনা অকপটে তুলে ধরা একটি সংবাদপত্রের যে দায়িত্ব, সে দায়িত্বটুকু পালনেরই এই প্রচেষ্টা, আপনাকে বিব্রত করা নয়। আপনি জনগণের নেত্রী, মানুষের দাবি শুনবেন এবং তাকে যতটুকু সম্ভব মেনেও নেবেন, এটুকুই সবার আন্তরিক প্রত্যাশা।
পরিশেষে, কামনা করি নিউইয়র্কে আপনার সফর সর্বাত্মক সফল হোক।
আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং দীর্ঘজীবী হোন। শুভ জন্মদিন।