বিশ্বপল্লির অভিঘাত : কার পাপের বোঝা কার ঘাড়ে!

প্রবাদে বলা হয়, ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।’ তেমনি বিশ্বজুড়ে যখন সংকট শুরু হয়, তখন সেই বৈশ্বিক সংকট থেকে কোনো বিশেষ দেশ নিরাপদে, শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে পারে না। এক দেশের তাপ আরেক দেশের গায়ে গিয়ে লাগে। বর্তমানে আমাদের বসবাস গ্লোবাল ভিলেজে। গ্লোবাল ভিলেজ মানে বিশ্বপল্লি। ভিন্ন ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভিন্ন পতাকা, ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্র, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, বর্ণ, ধর্ম। একেক দেশের একেক আবহাওয়া, পরিবেশ। শক্তি, ক্ষমতা, অর্থনীতি, রাজনীতি সবই ভিন্ন ভিন্ন। সবকিছু ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু আমরা একটা পল্লির বাসিন্দা, তাই একটা অভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে সে কারণে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ সবকিছুই সবাইকে কিছু না কিছু অনুভব করতে হয়, ভোগ করতে হয়।

আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। যোগাযোগব্যবস্থা যত উন্নত হয়েছে, সমাজ তত আধুনিক হয়েছে। সমাজ যত আধুনিক হয়েছে, মানুষ তত আঞ্চলিক, স্বদেশিকতার খোলস ছেড়ে বৈশ্বিক হয়েছে। বৈশ্বিক হতে হতে মহাবিশ্ব আজ একটি গুচ্ছগ্রামে পরিণত হয়েছে। গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। আমরা বাংলা ভাষায় মিষ্টি করে বলি ‘বিশ্বপল্লি’। বাস্তবতা সব আছে। কাঁটাতারের বেড়া আছে। সশস্ত্র পাহারা আছে। লাশ ঝুলছে কাঁটাতারের বেড়ায়। সলিলসমাধি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে। বৈধভাবে জন্ম নিয়েও সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে বৈধ-অবৈধ সিল মেরে দেওয়া হচ্ছে। সীমান্ত নামের অদৃশ্য দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে মাথা ফাটাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই ঘর ছেড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ভাবনায় অন্য রকম দৃশ্য। সীমান্তহীন এক বিশ্ব। কাঁটাতারের বেড়া নেই। লাশ নেই। জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে কোনো সীমানা নেই। নেই পাহারা। নেই অস্ত্রের মহড়া। এক জমিন, এক আকাশ। সাগর-মহাসাগরের জলে কোনো দেশের সিল-ছাপ্পড় নেই। দেয়াল নেই। ভাবনায় কিছুই নেই। কিন্তু সবই আছে। সীমান্ত আছে। বাধা আছে। আমার দেশ, তোমার দেশ বলে বিভাজন আছে। ছোট দেশ, বড় দেশ, দুর্বল দেশ, পরাশক্তির ভাগ আছে। ছোট দেশকে দখল করে নেওয়ার ইতিহাস আছে। পরাশক্তির মোড়লিপনা আছে। যুদ্ধ আছে। মৃত্যু আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন আছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন আছে। বিলাসিতার উৎসব আছে। দুর্ভিক্ষের হাহাকার আছে।

বিশ্বপল্লির সুফল বৈশ্বিক হতে পেরেছে কতটাÑতা নিয়ে দ্বন্দ্ব, বিতর্ক, সমালোচনা আছে। কুফলটা ভোগ করতে হচ্ছে এশিয়া-আফ্রিকার অধিকাংশ দেশকেই। দৃষ্টি প্রসারিত করলে বৈষম্য ধরা দেবে। যদিও বৈষম্যের অবসান ঘটানোই বিশ্বপল্লির মূল ‘স্পিরিট’, বাস্তবে সেই স্পিরিট দেখতে পাওয়া যায় না। বড় দেশের সুখে-সম্পদে ভাগ নেই দরিদ্র, দুর্বল দেশগুলোর। তবে তাদের আকাক্সক্ষা মেটাতে হয় ছোট ছোট দেশকেই। ছোট ছোট দেশের বাজার বড় বড় দেশের জন্য অবাধ, মুক্ত। বড় দেশের বাজারে ছোট দেশকে ঢুকতে নানা শর্তের বেড়া ডিঙাতে হয়। পদে পদে বাধা পেরোতে হয়। অনেকেই মনে করেন, গ্লোবাল ভিলেজের নামে অন্য দেশের বাজার দখলই উন্নত দেশগুলোর লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা সফলও।

বর্তমান উন্নত ও আধুনিক বিশ্বে ঘটনা দেশীয় বা আঞ্চলিক হলেও তার অভিঘাত বৈশ্বিক। উহানে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ বিশ্বপল্লির কল্যাণে আজ এশিয়া-আফ্রিকার যেকোনো প্রত্যন্ত এলাকায়ও মানুষ মরছে। এখনো হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে। যারা কোনো দিন সত্যতার ছোঁয়াও পায়নি, বিজ্ঞানের কোনো আশীর্বাদ লাভ করেনি, তারাও প্রাণ দিচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারিতে। কোভিডকে কোনো সীমান্ত বা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে, বন্দুক-কামান বা ড্রোন দিয়ে আটকানো যাচ্ছে না। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করতে কোভিডের পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে সাক্ষাৎকার দিতে হয় না। কোনো পরাশক্তির পরাক্রমে ভয় পায় না কোভিড। ধনী-দরিদ্র, দুর্বল-পরাক্রমশালী সব দেশই কোভিডের কাছে অসহায়।

বিশ্বসভ্যতার আরেক শত্রু যুদ্ধ। সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধÑসবই সভ্যতাকে ধ্বংস করে। যুদ্ধে রক্তক্ষয়, প্রাণক্ষয়। সম্পদহানি, সম্ভ্রমহানি। মৃত্যু আর মানব দুর্ভোগ যুদ্ধের নিট ফল। বিশ শতকে দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, নাগাসাকি ও হিরোশিমার আণবিক বোঝার ক্ষত এখনো দগদগে। বর্তমানেও সভ্যতা নতুন করে আক্রান্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। এই যুদ্ধে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের গরিষ্ঠের কোনো স্বার্থ নেই। বহু দেশের বহু মানুষ ইউক্রেন নামে কোনো দেশ আছে, হয়তো জানেই না। কিন্তু সেই যুদ্ধের কুফলে বিপর্যস্ত সবাই। চারদিকে হাহাকার। অশনিসংকেত। পণ্যমূল্য আকাশচুম্বী। দুর্ভিক্ষের আভাস। রণাঙ্গনের উত্তাপ বিশ্বজুড়ে।

ঠিকানার একটি সংবাদ ‘বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা বাড়ছেই’-১৯৮ দেশের মধ্যে ১০১টিই সংকটে’ প্রকাশিত হয়েছে গত ১৯ অক্টোবর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায়। সংকটের কথা কেবল রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র বা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে না। জাতিসংঘেও উচ্চারিত হচ্ছে। সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলছেÑসাবধান। আকাশে অন্ধকার ঘন মেঘ। বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের আলামত। দেশে দেশে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী সবার সতর্কবাণী সাশ্রয়ী হওয়ার। কী দুর্ভাগ্য একজন কৃষকের, যে খাদ্য ফলায় তাকে অনাহারে মরতে হবে। যারা উৎপাদন করে, তারা পড়বে দুর্যোগে। সংকট সৃষ্টির পেছনে যাদের কোনো দায় নেই, তাদেরকেই বইতে হবে অন্যের দায়ের বোঝা।

ঠিকানায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে : ‘সারা বিশ্বেই’ এখন অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। আগামী ছয় মাসে সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে বলে ব্রিটেনভিত্তিক ইন্টেলিজেন্স ফার্ম জানিয়েছে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি দেশের নাগরিকেরা এখন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে। এই পরিস্থিতির জন্য দেশে দেশে অস্থিরতা এবং যুদ্ধবিগ্রহকে দায়ী করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে বলা হচ্ছে, ৪৫টি দেশের দরজায় দুর্ভিক্ষ কড়া নাড়ছে। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেও তেল রাজনীতি ও অস্ত্র রাজনীতি চলছে, যা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে তাই জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী। জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), বিশ্বব্যাংক, আইএমএফÑসব প্রতিষ্ঠানই সতর্কসংকেত দিয়ে বলছে, ২০২৩ হবে মানবসভ্যতার জন্য কঠিন সংকটকাল। খাদ্যসংকটে পড়বে কয়েকশ কোটি মানুষ। এই সংকটের জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে। যুদ্ধের ফলে জ্বালানি ও সার সরবরাহ-ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাই বিশ্বজুড়ে সংকট।

তবে এই সংকটের কথা যত জোরেশোরে বলা হচ্ছে, সংকটের সমাধান দেখা যাচ্ছে না সেভাবে। মানবসভ্যতা রক্ষায় এখন সবচেয়ে জরুরি সমাধানের পথ বের করা। মানুষকে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে যুদ্ধ ছেড়ে সবাইকে শান্তির পথে আসতে হবে। শুধু মুখের কথায় চিড়ে ভিজবে না।