বিশ্ব কূটনীতির কূটচালে বাংলাদেশ

বিশেষ প্রতিনিধি : বিশ্ব কূটনীতির ভয়ংকর কূটচালে দিশেহারা বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন কূটনীতি, রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেনদরবার, সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের একরোখা আচরণ, বাংলাদেশের ওপর বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কালো ছায়াসহ নানা হস্তক্ষেপে সরকার ক্ষুব্ধ ও বিব্রত হলেও যেন কিছুই করার নেই। কোনো একটি বিষয়ের কূলকিনারা করতে না করতেই হাজির একাধিক সমস্যা। ভিন্ন দুটি দেশ নিজেরা বিবাদে জড়ালেও উভয়েই বাংলাদেশের সমর্থন প্রত্যাশা করেও দেশকে ফেলছে মহা ফাঁপরে। তখন বাংলাদেশের ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’র মতো অবস্থা দাঁড়ায়। করোনা মহামারির এই সংকটময় মুহূর্তেও বিশ্ব কূটনীতির মারপ্যাঁচ চলছে সমানতালে, ক্ষেত্রবিশেষে তা আরো বেড়েছে। এসব থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে চাইলেও বাংলাদেশ গা বাঁচাতে পারছে না। আবার নির্বুদ্ধিতা কিংবা লোভের কারণে অনেক সময় বাংলাদেশ নিজেই তাদের ভয়ংকর ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক ও বৈশ্বিক কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী সীমান্তের তালিকায়।

বিশ্বের প্রাণঘাতী সীমান্ত হিসেবে আগে পরিচিত ছিল ফিলিস্তিন-ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত। এখন সেটা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। চীন, নেপাল, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভুটান সীমান্তের সঙ্গে ভারতের তা হচ্ছে না, যা হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে। করোনা আক্রান্ত কেউ যাতায়াতও করতে পারে না। এর জেরে বাংলাদেশে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসসহ করোনার মৃত্যুগলিতে রূপ নিয়েছে ভারতের সীমান্তটি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অবস্থা ভয়াবহ।

এদিকে এমন অসময়ে বাংলাদেশে ভর করতে যাচ্ছে ইসরাইল ইস্যু। এর আগে কিছুটা ঝামেলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে। এখন আচমকা রহস্যজনকভাবে বাকিটা করে দিয়েছে সরকার। গোটা দেশবাসী যখন করোনার ভয়াবহতা, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেফতার, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, হেফাজতে ধরপাকড় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনায় মুখর; তখন নিঃশব্দে পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল ব্যতীত বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে বৈধ’-বাংলাদেশের পাসপোর্টে লেখা এই বাক্যটি থেকে ‘ইসরাইল ব্যতীত’ কথাটি কেটে ফেলা হয়েছে। এখন লেখা থাকছে-এই পাসপোর্ট বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে বৈধ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাসপোর্টের ‘আন্তর্জাতিক মান’ রাখতে গিয়ে এই পরিবর্তন। ইসরাইল প্রশ্নে বাংলাদেশের ভূমিকা বদল হয়নি। এমন মামুলি যুক্তি বা কলমের সামান্য খোঁচায় এত বড় কাজ সেরে ফেলা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। তা সম্ভবও নয়। এর পেছনে সময় লেগেছে, আয়োজন হয়েছে-সামান্য বোধজ্ঞানের যে কেউই তা বুঝতে পারছেন। পাসপোর্টে ইসরাইল প্রসঙ্গ বাদ পড়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। বাংলাদেশ যেন আগের পাসপোর্টে ফিরে যায়, সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্টে একসময় লেখা থাকত : ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সসেপ্ট ইসরাইল, তাইওয়ান অ্যান্ড দ্য রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা’ কথাটি। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা ও তাইওয়ানের নামটি ওই নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে বাদ গেলেও ইসরাইল থেকে যায়। দশককাল আগে হাতে লেখা পাসপোর্ট থেকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট-এমআরপি চালুর পরও আগের মতো প্রথম পৃষ্ঠায়ই লেখাটি ছিল। এখন ই-পাসপোর্টে লেখা ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। গাজায় সাম্প্রতিক ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের সময়ে এই পরিবর্তনটির মধ্যে শঙ্কা-দুশ্চিন্তার নানা খোরাক। তা কেবল কোনো দল, সরকার বা গোষ্ঠীর জন্য নয়; গোটা দেশের জন্যই খারাপ বার্তা। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আইয়ুব চৌধুরী বলেছেন, এটি তাদের বিষয় নয়। সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে এটা হয়েছে।

আট দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে জিইয়ে থাকা ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ। ফলে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও নেই। বিপরীতে ফিলিস্তিনকে দূতাবাস করতেও ঢাকায় জায়গা দেওয়া হয়েছে। সরকারের দিক থেকে বিষয়টিকে অস্বাভাবিক কিছু নয়-এমন ধারণা দিতে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, একসময় বাংলাদেশ থেকে তাইওয়ানে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ইসরাইলের মতো নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন বাংলাদেশের অনেকে সেখানে ব্যবসা করছেন। তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বীকৃতি আছে, কূটনৈতিক স্বীকৃতি নেই। তাইওয়ানের সাথে ইনফর্মালি ব্যবসা-বাণিজ্য হয়, যেটা চীনারাও করে। তাইওয়ানে যাওয়ার জন্য একটা কাগজ লাগে, সিঙ্গাপুরে তাদের কনস্যুলেট থেকে নিতে হয়, স্ট্যাম্প দেয় না। উল্লেখ্য, ঢাকায় তাইওয়ানের প্রতিনিধি অফিস খোলা হয়েছিল ২০০৪ সালে। তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ৩০ জুন তা বন্ধ করে দেয়। ঢাকায় তাইওয়ানের অফিস খোলার পরিণাম বাংলাদেশকে তেমন দিতে হয়নি। তা দিতে হয়েছে বিএনপিকে। আজও ভুগছে বিএনপি। আর ইসরাইলের কেস আরো ভয়ংকর।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক করার নানা অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন রয়েছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসরাইলের রাজধানী জেরুজালেম, সেটা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের নিপীড়ন, তাদেরকে উৎখাত, দুই রাষ্ট্র ধারণা থেকে বের হয়ে আসা মিলিয়ে একটা অসহনীয় পরিবেশ। এমন পরিস্থিতিতে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক যেনতেন বিষয় নয়।

এদিকে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি নতুন দু-একটি গোয়েন্দা সংস্থাও বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে তৎপর। বছরখানেক আগেও যা ছিল না। পুরোনা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সম্পর্কে মোটামুটি জানা থাকলেও নতুন গোয়েন্দা সংস্থার অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের অজানা। বাংলাদেশে বিশাল বিনিয়োগের পেছনে এই গোয়েন্দা সংস্থার নীরব কাজ অনেকেরই অজানা। আর এর কর্মিসংখ্যা পৃথিবীর সব গোয়েন্দা সংস্থার তুলনায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু প্রকাশ্যে আসে না। এরা নিজেরা সশস্ত্র কাজ করে না, করায়। নতুন প্রযুক্তি সংগ্রহ, বড় করপোরেট তথা করপোরেশনগুলোর নীতিনির্ধারণে নিজস্ব লোক ঢোকানোর নিজস্ব স্টাইল রয়েছে তাদের। আরেক দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা বৈদেশিক গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স পরিচালনা, গুপ্তহত্যা, বৈদেশিক নীতিনির্ধারণে সহায়তা, কাউন্টার টেররিজম, নিজস্ব লোক সংগ্রহ ও নেটওয়ার্ক তৈরি, বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর নজরদারি, শত্রু এজেন্ট খোঁজাসহ বিশ্বের সব জায়গায় যেকোনো পরিস্থিতিতে অপারেশন চালাতে পারঙ্গম। এই সংস্থারও বাংলাদেশে তৎপরতা থাকায় দেশের জন্য সেটা বিরাট শঙ্কা ও উদ্বেগের।