বৃত্তের বাইরের জীবন

অরল্যান্ডোর চিঠি

বি এম আতিকুজ্জামান :

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। সারা দিন বৃষ্টি হবে। এই কিছুদিন আগে ছুটি কাটিয়ে ফিরেছি। ছুটির আমেজ এখনো যায়নি। এ রকম বৃষ্টিমুখর দিনে ঘরে থাকতে ইচ্ছে হয়। পানির ধারে বসে জলপতনের ছন্দ শুনতে ইচ্ছে হয়।অথচ আজ সব রোগী এসে হাজির। আমার প্রথম রোগী রুমে ঢুকেই প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। খারাপ আবহাওয়ার মাঝে অফিসে আসার জন্য সে আমাকে ধন্যবাদ জানাল। আমার মেঘলা দিন সাথে সাথে রোদেলা হয়ে গেল।

রোগীর নাম উইলিয়াম। সবাই তাকে ‘বিল’ নামে ডাকে। বিল লিভারের কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে এসেছে। বিল গল্পের মতো করে তার রোগের ইতিহাস বলে যাচ্ছে। বছরখানেক আগে বিল ছিল নিউইয়র্কের একটি নামকরা সংস্থার বড়কর্তা। দিনরাত পাগলের মতো কাজ করেছে। ক্ষমতা আর অর্থের বলয়ে খানিকটা বন্দী অবস্থায় ঘুরছিল তার জীবন। তার মা মারা যান যখন সে হাইস্কুলে পড়ছে। বাবাই তাকে বুকে আগলে ধরে বড় করেছেন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেষ করে ওয়াল স্ট্রিটের বড় চাকরিতে ঢোকার পরপরই তার বাবা অরল্যান্ডোতে চলে আসেন অবসর যাপনের জন্য। বছরে দুবার বিল তার বাবাকে দেখতে আসত। এপ্রিলে তার বাবার জন্মদিনে আর নভেম্বরে থ্যাংকস গিভিংয়ের ছুটিতে।
বছরখানেক আগে বিল খবর পেল বাবা প্রায় মরণাপন্ন। বাবাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে এল সে। হাসপাতালে বাবার বিছানার পাশেই তার তীব্র খিঁচুনি শুরু হলো। তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। তার ব্রেনে টিউমার ধরা পড়ল। বিলের সঙ্গে সঙ্গে একই হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। বড় ধরনের একটি অস্ত্রোপচারের পর তার জীবন বদলে গেল। বাবা মারা গেলেন সে হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থাতেই। অপারেশনের পর সে তার শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। কথা বলতে এখনো খানিকটা কষ্ট হয়। স্মৃতির চিলেকোঠা প্রায়ই গোলমেলে হয়ে যায় তার।

চাকরিতে ইস্তফা দিতে হয়েছে তার। বন্ধুরা যে যার মতো ব্যস্ত। জীবনসঙ্গী করার মতো সময় খুঁজে পায়নি। এখন দীর্ঘমেয়াদি একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে থাকতে হয় তাকে। সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ভালো বন্দোবস্ত আছে। বিশাল অঙ্কের টাকা আছে ব্যাংকে। সেসব খরচ হচ্ছে তার চিকিৎসাসেবার জন্য।

বিল খুব দুঃখ করে বলল, একটি বড় ছুটি নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। আমাজনের জলপ্রপাতের ওপর পাখির মতো গ্লাইডিং করার শখ ছিল তার। প্যাটাগোনিয়াতে হারিয়ে যাওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছিল বছরের পর বছর।

বিলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদের ভঙ্গুর জীবনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। বিলের সঙ্গে আরো খানিকটা সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল। আরেক দিন হবে সেটি।

আমি জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকালাম। খুব বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হলো। আজ কাজ শেষে ঘরে ফিরে বৃষ্টিতে নেমে পড়ব। আমার এসব পাগলামি আমার স্ত্রী সিলভির সয়ে গেছে। এই তো সেদিন আইসল্যান্ডের গঅফস জলপ্রপাতের একটি নড়বড়ে পাথরের ওপর দাঁড়িয়েছিলাম বলে সিলভি কী বকাই না দিয়েছিল সেদিন।

অথচ আজ এ ছবিটির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে জীবনটা এসব পাগলামিতে ভরা থাকলে মন্দ হয় না। বিল যাওয়ার আগে সে কথাটি বলে গিয়েছিল আমাকে।

লেখক : অধ্যাপক এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড লিভার সেন্টার অব ফ্লোরিডা, অরল্যান্ড, ফ্লোরিডা।