বেখেয়ালের তান

ম. গ. আদ্দীন

অফিসে এসেই কটু গোয়েন্দা নিত্যদিনের মতই-মেইল ও টেক্সট মেসেজগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। একটি মেসেজ দেখে তার চোখ আটকে গেল। কে এক অচেনা লোক তাকে টেক্সট করেছেন, জনাব বটু লঙ্কর, আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন, দিন দশেক পূর্বে ড. শফি তালুকদার নামে এক ব্যক্তি রাজধানীতে খুন হয়েছিলেন। আমি তার ছেলে মাহি তালুকদার। আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই, কী এক রহস্যজনক অজ্ঞাত কারণে, আমার বাবার খুনের বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে! আপনি এসব তদন্তে অভিজ্ঞহেতু, আমি ও আমার মায়ের অনুরোধ এই কেইসটির তদন্তভার আপনি যেন হাতে নেন। আমাদের ঠিকানা ও ফোন নাম্বারটি দিলাম। আপনি দয়া করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন। আপনার ফী বাবদ সব খরচ আমরা বহন করব। সাক্ষাতে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
বটু গোয়েন্দা তৎক্ষণাৎ সায়িফকে ডেকে পাঠালেন। তার এজেন্সির অন্যরা বিভিন্ন তদন্ত নিয়ে তখন ব্যস্ত ছিল। সায়িফকে সবকিছু বর্ণনার পর ঠিক হলো, বিকেলেই তারা ড. শফি তালুকদারের বাড়িতে হাজির হবেন। তার ছেলেকেও কল দিয়ে জানিয়ে দেয়া হলো, ক’টা নাগাদ তারা পৌঁছাবেন। সন্ধ্যে হওয়ার কিছুক্ষণ আগে, বসুন্ধরায় অবস্থিত ড. তালুকদারের ছোট্ট ছিমছাম বাড়িতে পৌঁছলেন। তারপর কলিংবেল টিপতেই যিনি দরজা খোলে বেরিয়ে এলেন, তাকে দেখে মনে হলো, তিনিই ড. তালুকদারের ছেলে মাহি তালুকদার। সুদর্শন চেহারার বয়স ত্রিশের কোটায় হবে। বটু লস্কর তার ও সায়িফের পরিচয় দিতেই অত্যন্ত ভদ্রতা ও বিনয় সহকারে, তাদের ঘরের ভেতর নিয়ে বসতে দিলেন। ঘরের পরিবেশ রুচিশীল হাতের ছোঁয়ায় অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো তা দেখেই বুঝা যায়। আলাপ-আলোচনার এক ফাঁকে ড. শফি তালুকদারের স্ত্রীও এসে যোগ দিলেন। বটু গোয়েন্দা প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্ন করে সংক্ষেপে জানতে পারলেন, ড. শফি তালুকদার ইতিহাসের একজন অধ্যাপক ও গবেষক ছিলেন। তার লেখা দু-তিনটে বইও সুধী মহলে বেশ প্রশংসা ও সুনাম অর্জন করেছে। বটু গোয়েন্দা যে একেবারে তার নাম শুনেন নি তা নয়। তার মনে পড়ল, টিভি টকশোতে ড. তালুকদারকে একবার যেন দেখেছেন। কিন্তু তার লেখা গ্রন্থ ‘বেখেয়ালের তান’ সম্পর্কে কিছুই তার জানা ছিল না। তদন্ত সম্পর্কে যথাসাধ্য চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বটু গোয়েন্দা তাদের অনুমতি নিয়ে ‘বেখেয়ালের তান’ বইটির এক কপি হাতে করে সেদিনকার মতো বিদায় নিলেন।
সে রাতে বইটি হাতে নিয়ে অভিন্ন মনোযোগের সাথে পড়তে বসলেন বটু গোয়েন্দা। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় মনোনিবেশ করে মোটামুটি আন্দাজ পেলেন: পলাশির যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা যে দিন ইংরেজের হাতে চলে যায়, ঠিক তার পরদিন ভোরে এক ইংরেজ অফিসার ঘুম ভেঙে তাঁর তাবুর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার কানে তখন ভেসে এল অনতিদূরে গ্রামের মেটো পথ ধরে এক লোক লাঙ্গল কাঁধে, হাতে হুঁকো টেনে, মনের সুখে গান গেয়ে, ক্ষেতে কাজ করতে চলেছে! সে দৃশ্য দেখে ইংরেজ অফিসারটির বুঝতে মুহূর্ত দেরি হয়নি, যে জাতি মাত্র গতকাল স্বাধীনতা হারিয়েছে, সে জাতির লোকেরা কত অসচেতন হতে পারে! যে লোকটি গান গেয়ে মাঠে যাচ্ছে, সে জানে না, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পূর্বে তাদের স্বাধীনতা হাত ছাড়া হয়ে গেছে। স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারলে, মনের সুখে তার কণ্ঠে এমন গান উচ্চারিত হতো না। ইংরেজ অফিসারটি তার পায়ে হাঁটু অবধি বুট জোড়া শক্ত করে বেঁধে, সে দিন তার কলিগদের উদ্দেশে হেঁড়ে গলায় বলে উঠেছিল, Ñউহ্ উইল রুল দিস ব্লাডি বাগারস, ফর নেক্সট থাউজেন্ড অব ইয়ার্স! উই উইল ডমিনেট দেম আন্ডার আওয়ার বুটস্ ফর এভার! দে আর নাথিং বাট আনকনসাস সাবহিউম্যান!
বটু গোয়েন্দা বইয়ের বাকি কিছু অংশ ধৈর্য সহকারে পাঠ শেষ করে বুঝতে পারলেন, সিরাজুদৌল্লাকে নিয়ে অনেকেই অনেক বই-পুস্তক-নাটক লিখেছেন। নবাবের বংশধরদের অনুসন্ধান করেছেন। আজ তারা কে, কোথায়, জীবিত আছেন, বাস করছেন? সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন, লিখেছেন, ভিডিও করেছেন। সবই দেশবাসীর কাছে সমাদর পেয়েছে। কিন্তু ড. তালুকদার একমাত্র ব্যক্তি, যিনি অন্য একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তার গবেষণার বিষয়টি ছিল, সেই বিশেষ লোকটিকে নিয়ে, যে বাংলার স্বাধীনতার রক্তঝরা সূর্যাস্তের পরদিন, মনের সুখে গলা ছেড়ে রস রঙ্গে ভরা গান ধরেছিল। কে সেই লোকটি? কারা তার বংশধর? কোথায় তাদের বাস? ড. তালুকদার সেসব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলেনও বটে। সেই লোকটির নাম ছিল ভখাই! সেই ভখাইয়ের বংশধরদের ওপর তিনি অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়েছিলেন। সেসব তথ্য তার বেখেয়ালের তান বইটিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টাও করেছিলেন। ভখাইদের পরিচয় তুলে ধরার কারণেই কী তিনি প্রাণ হারান? তার কর্ম কাদের স্বার্থবিরোধী ছিল? বটু গোয়েন্দাকে ভাবিয়ে তোলল।
সব ধরনের রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্ট, ঘটনাস্থল ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের নিয়ে খুব জোরেশোরে তদন্তে নেমে পড়লেন বটু গোয়েন্দা। তারপর দেখতে পেলেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে। তিনি উপলব্ধি করলেন, বাংলাদেশের সচেতন জনগণের মধ্যে, এক বিশাল অসচেতন জনগোষ্ঠীও বাস করে। সেসব অসচেতন লোকেরাই ভখাইয়ের বংশধর। তারা শিক্ষা, জ্ঞান, মান-মর্যাদার প্রতি উদাসীন। একটি আদিম জীবনযাত্রার পরিম-লে বাস করতে তারা ভালোবাসে। তারা বংশবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত । অতঃপর সমস্যার বোঝা সৃষ্টি করে, পরের ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়। তারা সৎ উপদেশ অগ্রাহ্য করে, নিজেদের পঙ্গুত্বের অভিশাপে সমাজকেও পঙ্গু করে দিতে চায়। সব বঞ্চনার জন্য সরকারকে শুধু দায়ী করে। তারা গতি, প্রগতি ও উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টিকারী সমাজে এক দঙ্গল ট্রাফিক ছাড়া কিছু নয়। এসব ভখাই-লখাই-মখাইদের ব্যবহার করে সমাজের এক দল অশুভ চক্র। সে সব চক্র যেমন সংকীর্ণমনা তেমনি সংস্কারবিরোধী। তারা মনে করে ভখাই চরিত্রের লোকেরা শুধু দাসত্ব খাটার জন্যেই জন্ম নিয়েছে! তাই নানা ছল-চাতুরির আশ্রয়ে ওদের তারা ব্যবহার করে। দেশের যতই উন্নয়ন ঘটুক না কেন, সমান তালে পাল্লা দিয়ে বেশুমার ভখাই-লখাইদের সুনামির বন্যায়, সব তলিয়ে যাবে সন্দেহ নেই। এখনই রাস না টানলে একদিন খুব দেরি হয়ে যাবে। যারা সচেতন, গঠনমূলক, উন্নয়নশীল সমাজ গঠনের বিরোধী, তারাই ড. তালুকদারকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। তাই ভেবেই বটু গোয়েন্দা সন্দেহের ওপর ভর করে, খুনিকে ধরে ফেলতে সক্ষম হন। ভাড়াটে সেই খুনি তার মদদকারীদের নামও বলে দেয়।
লোকটি যে আসল খুনি তা শনাক্ত করলেন কিভাবে?
মনে পড়ে? বেশ কিছু জায়গায় আমাদের ঘুরতে হয়েছে। তুমি যদি পতিতালয়ের আশপাশে পান-বিড়ির দোকানের সামনে কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাক, তাহলে সেই বিশেষ এলাকার অনেক খবরাখবর তোমার কানে আসবে। তুমি যদি কোনো বস্তির ভেতর দিয়ে হাঁট, তাহলে খিস্তি খেউরের সাথে পরস্পর বিরোধী খবর জানতে পারবে। তুমি যদি ভখাটই-লখাইদের আড্ডায় কিছুটা সময় ব্যয় করো, তাহলে একসময় তাদের আলোচনা তোমাকে টার্গেটে নিয়ে পৌঁছাবে। অপরাধীকে ধরা মোটেই সমস্যা নয়। একজন অপরাধী কাউকে খুন করে যদি নিজেই আত্মহত্যা করে বসে, তাহলে তো ল্যাটা চুকে গেল। কিন্তু খুনি যদি বেঁচে থাকে, তবে তার বেঁচে থাকা শুধু ধরা পড়ার জন্য। আজকাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা ল্যাবে বসেই অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারেন। হাতের আঙুলের ছাপ, জুতোর নিচে মার্ক, গাড়ির চাকার দাগ, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, সিসি ক্যামেরায় ধরা গাড়ি বা মোটরসাইকেলের সাইজ, রঙ, ট্যাগ্ নাম্বার, কোনো রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার সময়, দূরত্ব, অবস্থান, নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে।
অসচেতন মানুষের মধ্যে অপকর্মের স্পৃহা জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অসচেতন বিশাল সেই জনগোষ্ঠীকে কিভাবে সচেতন করা যেতে পার- সায়িফ জানতে চাইল।
বিজ্ঞ লোকমাত্রই জানেন, শিক্ষা, আইন ও দ- এই তিন বিষয় যথাযোগ্য প্রয়োগ করলে সমস্যা হ্রাস পায়। দেশের শাসক যদি জাতির জন্য ডিভৌটেড, ডেডিকেইটেড, কনসিক্রেইটেড হন, তবে তারাই পারেন, তাদের দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ ইচ্ছে ও হাতের দ্বারা সে দায়িত্ব পালন করতে। হাসি মুখে দেশ শাসন চলে না। ভারসাম্যের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে রূঢ় হতে হয়। আজ দুনিয়ায় যেসব সুখী, সুন্দর, উন্নত দেশ দেখতে পাচ্ছ, শতাব্দী পূর্বে তারা এমন ছিল না। তাদের কিছু সংখ্যক শাসককেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে নির্মম ও নির্দয় হতে হয়েছিল। বাঁকা লৌহাকে সোজা করতে হলে, অগ্নিদগ্ধ করে হাতুড়ির ঘা বসাতে হয়, তা সবাই জানে। এবার একটি ইচ্ছাকৃত বেখেয়ালিপনার বিষয় তোমাকে বলি শুন। ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের সীমান্তে, বিশেষত ওয়াগাহ্ বর্ডারে, দুই দেশের আর্মি গার্ড বা রেঞ্জাররা প্রতিদিন ফ্ল্যাগ সিরিমনি পালন করে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখবে সৈনিকরা মার্চ করে এসে, পরস্পরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ও কাঁধ বরাবর পা উত্তোলন করে সেলিউট করে। তাদের পা উত্তোলনের ধরন দেখতে বেশ হাস্যকর বলে মনে হয়। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবে, যখন দু’জন সৈনিক দু’পা পরস্পরের দিকে উত্তোলন করে, তখন একটি ক্রস চিহ্ন প্রদর্শিত হয়। আর তা হলো, ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক্ বা ফ্ল্যাগের ক্রস চিহ্নের প্রতীক। ক্রস হলো সূর্যের পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ আলো বিকিরণের প্রতীক। প্যাগান ব্রিটিশরা তাদের কলোনির সেনাদের, সেই ক্রসকে সেলিউট করে, অভিবাদন করার প্রথা সৃষ্টি করেছিল। সেনাদের মাথায় পাগড়ির উপরিভাগ সূর্যালোক বিকিরণের প্রতীক হিসেবে এখনও শোভা পায়। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান প্যাগান সৈনিকদের মাথার শিরস্ত্রাণে সূর্যালোক বিকিরণের একই ধরনের প্রতীক শোভা পেত। অজ্ঞতাবশত বা যেকোনো কারণে হোক, পাক-ভারত বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও উভয় দেশই এখনও সেই প্রথা মেনে চলে। কিন্তু বাংলাদেশ সে সব সম্রাজ্যবাদী প্রথা থেকে মুক্ত। আজ আমাদের শাসকেরা শুধু দলীয় রাজনীতির সচেতনতা শিক্ষা দিয়ে, যদি সামগ্রিক কিছু ঐতিহাসিক সচেতনতার শিক্ষাও দেন, তবেই হয়তো জাতির জন্য কল্যাণকর হতো।
দিন কয়েক পর, বটু গোয়েন্দা মাহি তালুকদারের কাছ থেকে একটি টেক্সট মেসেজ পেলেন। জনাব বটু লস্কর, তদন্ত ও সবকিছুর জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। চেতনা, জ্ঞান ও বুদ্ধি পেয়েছি, বলেই আমরা মানুষ। আমাদের জাতি ও সমাজ উত্তরোত্তর সচেতন হয়ে উঠুকÑ এটাই সবার কাম্য। শতাব্দী পূর্বে স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টায় ও শতাব্দী পর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে, যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, তারা মানুষকে কিভাবে সচেতন রাখা যায়, সে চিন্তাই সর্বদা মাথায় রেখেছিলেন। তাদের মতো আপনারা গোয়েন্দারাও সচেতন মানুষের প্রহরী হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকুন, এই কামনাই করি।
ম্যারিল্যান্ড।