মোবায়েদুর রহমান
আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে কারামুক্ত করার সম্ভাবনা দিনের পর দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন সেই সম্ভাবনা শূন্যে নেমে এসেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক মহল মনে করে। তাই এখন বিএনপির আইনজীবী মহল বিশেষ করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে নিয়মিত বলতে শোনা যাচ্ছে যে, আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেগম জিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই তাকে মুক্ত করতে হবে। তিনি আরও বলছেন, রাজপথের আন্দোলন চলবে বলে আইনি লড়াই থেমে থাকবে না। রাজপথের আন্দোলনের পাশাপাশি আইনি লড়াইও চলবে। সাংবাদিকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, রাজপথের আন্দোলন কবে থেকে শুরু হবে? উত্তরে বলেন, কবে থেকে আন্দোলন শুরু করা হবে সেটি আপনাদেরকে সময় মতো জানানো হবে।
লন্ডন থেকে ফেরার পরপরই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ঈদের পরেই বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলন শুরু হবে। বেগম জিয়াকে মুক্ত করতে হলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নাই, এমন কথা বিএনপি সিনিয়র নেতারা সাম্প্রতিককালে আরো বলেছেন। তাদের এসব কথার ওপর ভিত্তি করেই সম্ভবত পত্রপত্রিকাগুলোও ওই লাইনে নিউজ করছে। বিএনপির প্রস্তাবিত রাজপথের আন্দোলন সম্পর্কে একটি ইংরেজি পত্রিকা গত ২০ জুন একটি বিস্তারিত রিপোর্ট করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বেগম খালেদা জিয়াকে জেল থেকে মুক্ত করে আনার জন্য বিএনপি এক দিকে যেমন আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে অন্যদিকে তেমনি শিগগিরই রাজপথে আন্দোলন শুরু করবে। এর পাশাপাশি দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতিও গ্রহণ করছে। এ জন্য আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন, কাদের জয়লাভের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, এ সম্পর্কে তৃণমূল থেকে পার্টি হাইকমান্ড তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। অন্য দিকে দলের থিংক ট্যাংক বা বুদ্ধিজীবীরা বিএনপির নির্বাচনী মেনিফেস্টো প্রণয়ন করা শুরু করেছে। নির্বাচন এবং আন্দোলন উভয়কে সামনে রেখে বিএনপি ২০ দলীয় জোটকে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে যে, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কয়েকদিন আগে যখন লন্ডনে যান তখন তাকে দলের অস্থায়ী প্রধান তারেক রহমান বিশেষ কয়েকটি নির্দেশ প্রদান করেন। ওই সূত্রটি বলছে যে, তারেক রহমান সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন ২০ দলীয় জোটকে সম্প্রসারিত করার ওপর। তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন গত ডিসেম্বর মাসে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ওপর। তারেক রহমান চান যে যুক্তফ্রন্ট বিএনপির আন্দোলনে শরিক হোক। সেটি এক প্ল্যাটফর্মে হোক অথবা আলাদা আলাদা প্ল্যাটফর্মেই হোক। তিনি চান সেটিই যেন হয় এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো তিন জোটের আন্দোলন। তবে তিন জোট আলাদা আলাদা প্ল্যাটফর্ম করলেও আন্দোলন যেন যুগপৎ হয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ডিসেম্বর মাসে তিনটি বিরোধী দলকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠিত হয়েছে। জোটের চেয়ারম্যান হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি নেতা অধ্যাপক ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরী। জোটের অন্য দুই সদস্য হলেন আসম আব্দুর রবের জাসদ এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য। জানা গেছে, তাদের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করার ব্যাপারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতোমধ্যেই যুক্তফ্রন্টের তিন নেতার সাথে কথা বলা শুরু করেছেন। নির্ভরযোগ্য একটি মহলের খবরে প্রকাশ, যুক্তফ্রন্ট ছাড়াও আরও দুইজন নেতাকে বৃহত্তর ঐক্যে শরিক করার জন্য বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়া উভয়েই মতামত দিয়েছেন। এই দুইজন নেতা হলেন- গণফোরাম প্রধান ড. কামাল হোসেন এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রধান কাদের সিদ্দিকী। যুক্তফ্রন্টের সাথে ঐক্যের আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তবে ড. কামাল হোসেন ঘন ঘন বিদেশ যান বলে তার সাথে তথা গণফোরামের সাথে আলোচনা বেশি দূর এগোতে পারেনি। তবে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, যুক্তফ্রন্ট এবং ড. কামাল ও কাদের সিদ্দিকীর সাথে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে উঠবে।
দুই. বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে, নাকি যাবে না, এই নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, সুধী সমাজের মাঝেও রয়েছে ধোঁয়াশা এবং বিভ্রান্তি। যেসব দাবির ভিত্তিতে বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে এবং যে আন্দোলন আগামীতে বেগবান করতে চায় সেগুলো হলো, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, দলীয় আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং নির্বাচনের অন্তত সাত দিন আগে সারা দেশে সেনা মোতায়েন। যদিও নির্বাচনে লেভেল প্লেইংফিল্ড বা সকলের জন্য সমতল ভূমি সৃষ্টি করা তাদের অন্যতম প্রধান দাবি, তবে তারা মনে করেন যে ওপরে উল্লিখিত চারটি দাবি পূরণ করা হলে লেভেল প্লেইংফিল্ড আপনা আপনিই সৃষ্টি হবে। এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেন যে, বিএনপি সব সময়ই নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। তবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেটি প্রয়োজন সেটি হলো অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। ওপরে উল্লিখিত ইংরেজি দৈনিকটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, পার্লামেন্টের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫০টি আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী রয়েছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই ১৫০ জন প্রার্থী জয়লাভ করবেন। এই ১৫০ জন প্রার্থী ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত করা হয়েছে।
রাজপথ আন্দোলন শুরু করার আগে বিএনপি কিছু ওয়ার্ম আপ কাজ করতে চায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অনশন ধর্মঘট, অবস্থান ধর্মঘট, বিক্ষোভ ইত্যাদি। তবে দেশব্যাপী বড় আকারের বিক্ষোভ ও আন্দোলনের সময় এখনো নির্ধারণ করা যায়নি কয়েকটি বিশেষ কারণে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঈদুল ফিতর এবং ঈদ-পরবর্তী আমেজ। এ ছাড়া এই মুহূর্তে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার পথে একটি বড় অন্তরায় হলো চলমান বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচ। আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে এই বিশ্বকাপ জ্বর চলবে। ঈদের পর আমি ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। দেখলাম মফস্বলেও ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকা এবং আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে সবার মুখেই খেলার গল্প। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর যখন খেলা হয় তখন রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। সুতরাং ১৫ জুলাইয়ের পূর্বে কোনো আন্দোলন শুরু করলে সেটি মানুষকে টানতে পারবে না। তার এক মাস পর পবিত্র ঈদুল আজহা। আবার অন্তত এক কোটি লোক ঢাকা ছাড়বেন এবং ঈদ আনন্দে মেতে থাকবেন। ওই ঈদের রেশ থাকবে আগস্ট মাস পর্যন্ত। এই অবস্থা দেখে বলা যায় যে, সেপ্টেম্বর মাসের পূর্বে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করাটা কৌশলগতভাবে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না। এখানে আর একটি বিষয় আছে। দুর্বার গণ-আন্দোলন বা সর্বাত্মক আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ২০১৫ সালের সর্বাত্মক আন্দোলনের ব্যর্থতা তার জ্বলন্ত সাক্ষী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বলতে হয় যে, অক্টোবরে অলআউট মুভমেন্ট শুরু করলে সেটি কৌশলগতভাবে সঠিক হবে। তখন দুটি সুবিধা পাওয়া যাবে। একটি হলো নির্বাচন সন্নিকট বলে মানুষ জয়েন করবে। দ্বিতীয়ত নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে সরকারের অব্যাহত মারমুখী আচরণ শিথিল হবে। গ্রেফতার, ধরপাকড়, বন্দুকযুদ্ধসহ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি কিছুটা রিল্যাক্সড হবে। তৃতীয়ত স্বল্পস্থায়ী আন্দোলনে কম শ্রম ব্যয় হবে এবং ক্ষয়ক্ষতি কম হবে; কিন্তু সাফল্যের সম্ভাবনা থাকবে উজ্জ্বল।
তিন. তার পরেও একটি কথা থেকে যায়। যারা রাজনীতির সদরে এবং অন্দরে দৃষ্টিপাত করতে পারেন তারা জানেন সরকার ইলেকশনের আগেই বেগম জিয়ার অর্ফানেজ মামলা ফাইনাল করতে চায়। অভিযোগ রয়েছে যে, সরকার বিচার বিভাগের বিভিন্ন স্তরে হস্তক্ষেপ করছে। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টকে নির্দেশ দিয়েছে। হাইকোর্ট যদি সুপ্রিম কোর্টের নিকট থেকে সময় বৃদ্ধি করার আবেদন না জানায় তাহলে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই ওই মামলা অন্তত হাইকোর্ট পর্যায়ে চূড়ান্ত হবে। তারপর যাবে সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টে সেটি যাবেই। কারণ যদি হাইকোর্টের রায়টি বেগম জিয়ার পক্ষে আসে তাহলে সরকারপক্ষ ও দুদক সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবে। আর যদি বেগম জিয়ার বিপক্ষে যায় তাহলে বেগম জিয়া তথা বিএনপি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবে।
ঢাকার অবস্থা আমি দেখে গিয়েছি। আমি সড়ক পথে উত্তরবঙ্গ গিয়েছিলাম। ঢাকা-বগুড়ার সড়কপথের মাঝে মধ্যে আমরা থেমেছিলাম। লোকজনের সাথে কথা বলেছি। বগুড়ায় যে সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেখানে রংপুর, পাবনা এবং রাজশাহী থেকেও অতিথিরা এসেছিলেন। সড়কপথে এবং ওই অনুষ্ঠানের বিভিন্ন জেলার অতিথিদের সাথে আলোচনা হলো। সবাই বলছেন যে, আপিলে কী হবে সেটি তো আগে থেকেই নির্ধারণ করা আছে। তবে কেউ বলেননি যে বেগম জিয়া বেকসুর খালাস পাবেন। বেগম জিয়ার পক্ষে কোনো রায় হলে সেটি এতটুকু হবে যে তার সাজার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হবে। এটিও যদি হয় তাহলেও বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে যাবেন। সেই সাজাটি যদি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কনফার্ম করে তাহলে সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই রকমই কিছু হবে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। যদি তাই ঘটে তাহলে বেগম জিয়া শুধু নির্বাচনেরই অযোগ্য হবেন না, তাকে তিন বা পাঁচ বছর জেল খাটতে হবে।
এখন এই আশঙ্কা মাথায় রেখে বিএনপি কী চিন্তাভাবনা করছে সেটি মানুষের কাছে, অন্তত দেশের কয়েক কোটি বিএনপি সমর্থকদের কাছে পরিষ্কার নয়। দেশের কয়েক কোটি মানুষ বেগম জিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সরকার একটি সুনির্দিষ্ট ব্লু প্রিন্ট নিয়ে এগোচ্ছে। এ কথা একজন পাগলও বোঝে যে, মুক্তি দেওয়ার জন্য বেগম জিয়াকে জেলে ঢুকানো হয়নি। তিনি দলবল নিয়ে ইলেকশন করবেন, সেজন্য একটি মামলায় নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও জোর করে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। সবকিছুর পেছনেই একটি মতলব রয়েছে। আর সেটি হলো রাজনৈতিক মতলব। সরকারের এই ষড়যন্ত্রের জাল বিএনপি কিভাবে ছিন্ন করবে সেটিই এখন প্রধান ভাবনার বিষয়।
বেগম জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি নির্বাচন করবে আর সেই নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় যাবে, এমন চিন্তা যদি বিএনপির কারো কারো মাথায় থেকে থাকে তাহলে তিনি বা তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। কাজটি কঠিন। তারপরেও বিএনপি নেতাদের বলছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষ পরিণতি চিন্তা করুন। কীভাবে শেখ মুজিব আটক অবস্থা থেকে মুক্ত হলেন সেটি নিয়ে ভাবুন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আনুপূর্বিক ঘটনাবলি এখনো আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসছে। একটি কথা স্বীকার করতেই হবে যে, সেসময়ও জনগণই ছিল প্রধান শক্তি এবং শেষ ভরসা। এখন বিএনপি তথা বিরোধী দল যে লৌহশৃঙ্খলে বন্দী সেই জিঞ্জির ছিন্ন করতে পারে একমাত্র জনগণ। ইন্ডিয়া সফর করছেন, ভালো কথা। কিন্তু তারা আপনাদের ত্রাণকর্তা নয়। ত্রাণকর্তা হলো জনগণ। সেই জনগণ যখন রাজপথে নেমে আসে তখন যে প্রচ- কম্পন সৃষ্টি হয় সেই কম্পনে ক্ষমতাসীনদের তখতে তাউস উল্টে যায়।