ঠিকানা রিপোর্ট : কাস্টমস এন্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্টদের হাতে বৈধ ওয়ার্ক পারমিটধারীরাও আজ আর নিরাপদ নয়। বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট কিংবা ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) বৈধদেরও গ্রেফতার করে ডিটেনশনে দিচ্ছে। তাদের
সাথে আচরণ করা হচ্ছে ভয়ানক অমানবিক। আমেরিকান সিটিজেনকে বিয়ের মাধ্যমে বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে এদেশে বসবাস করছেন আদনান আসিফ নামের এক মুসলিম ইমিগ্র্যান্ট। কাজের জন্য তিনি টেক্সাসের সাউথ সীমান্তে গেলে সেখানে তাকে আটক করে বর্ডার পেট্রোল এজেন্ট। ডিটেনশনে নিয়ে তাকে খেতে দেয় শুকরের মাংস। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও মেঝেতে এলুমিনিয়াম শিটে গা ঢেকে রাত কাটাতে হয় তাকে। সীমান্তে গ্রেফতারকৃত অন্যান্য মাইগ্রেন্টদের সাথে রাখা হয় তাকে। তার স্ত্রী জানতো না তার স্বামীকে কোথায় রাখা হয়েছে। আটকাবস্থায় তাকে ঠিকমতো খাবারও দেয়া হতো না।
আদনান আসিফের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাকে উদ্ধৃত করে হাফপোস্টে প্রকাশিত অনলাইন রিপোর্টে বলা হয়, গত জানুয়ারিতে তিনি ছয়দিন বর্ডার পেট্রোলের কাস্টডিতে ছিলেন। সেখানে তাকে প্রতি ৮ ঘণ্টা অন্তর খাবারের জন্য দেয়া হতো শুকরের মাংসের স্যান্ডউইচ।
তিনি অভিযোগে বলেন, একজন মুসলমান হিসেবে তিনি শুকরের মাংস খেতে অস্বীকার করলে প্রহরী তাকে অন্য কিছু খেতে দেয়নি। তাই ক্ষুধার যন্ত্রণায় তিনি স্যান্ডউইচ থেকে মাংস ফেলে দিয়ে শুধু রুটি খেতে বাধ্য হয়েছেন।
‘গোপনীয় ও ব্যক্তিগত’ বিষয় বলে উল্লেখ করে কাস্টমস ও বর্ডার প্রটেকশন এ মামলা সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে অস্বীকার করেছে। এক মহিলা মুখপাত্র এজেন্সির ডিটেনশন স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে হাফপোস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বন্দীদের ধর্মীয় ও অন্যান্য খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কর্মকর্তাদের চুপ থাকতে হয়।
আদনান আসিফকে গ্রেফতারের পর আইসের দুজন কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা সম্ভাব্য কোন সন্ত্রাসীর সাথে তার যোগাযোগ আছে কিনা, তা জানতে চায়। তারা তার ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট চেক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম নিয়েও জানতে চায়।
আসিফ হাফপোস্টকে জানায়, তারা তার কাছে জানতে চায়, তিনি মসজিদে গিয়ে আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলেন কিনা? তাদের আমি বলি, মসজিদ হচ্ছে ইবাদতের জায়গা, আমি সেখানে কেবল ইবাদত করতেই যাই।
আসিফের জাতীয়তা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন কেনো, তা পরিষ্কার নয়। আইস এ ধরনের কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে আলোচনা বা আদৌ তা জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কিনা, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
যুক্তরাষ্ট্রে আসিফের কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই বলে দাবি করেছেন তার আইনজীবী ক্যাথি পট্টার। ২০১৪ সাল থেকে আসিফ আমেরিকায় বসবাস করছেন। তিনি বলেন, স্পেনে আসিফ বড় হয়েছেন। সেখানে বা পাকিস্তানের যেখানে তিনি জন্ম নিয়েছেন, সেখানেও তার বিরুদ্ধে অপরাধের কোন রেকর্ড নেই।
কাস্টডিতে থাকার ৬ দিনে আসিফকে স্পেনে ডিপোর্ট করার জন্য প্রস্তুতকৃত কাগজে বেশ কয়েকবার স্বাক্ষর দিতে চাপ দেয়া হয়। এতে তিনি মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েন।
কেনো স্বাক্ষর করবেন না, অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তার স্ত্রী ওহাইওতে স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় আছেন। তখন এজেন্ট তাকে পাঁচ মিনিট ফোনালাপ করার সুযোগ দেন। যখন তার স্ত্রীর সাথে কথা হয়, তখন আসিফ জানতে পারেন তার স্ত্রী তাকে খোঁজার জন্য কয়েকদিন আগে টেক্সাসে এসেছেন। ফোন ছেড়ে দেয়ার পর তিনি ডিপোর্টেশনের কাগজে স্বাক্ষর করতে সরাসরি অস্বীকার করেন।
আসিফ বলেন, আমি আমার স্ত্রীর সাথে থাকতে চাই। আমি ডিপোর্টেশনে স্বাক্ষর করবো না।
বর্তমানে দক্ষিণ টেক্সাসের পোর্ট ইসাবেলের আইস ডিটেনশন সেন্টারে আছেন আসিফ। তার ওয়ার্ক পারমিট এ মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ হবে। কিন্তু তাকে যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে, আর তার মাথার উপর ডিপোর্টেশনের যে চাপ, তাতে দেখা যায় ইমিগ্রেশন আইন প্রয়োগের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কতো ভয়াবহ। যেভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা মুসলিমদের যাছাই-বাছাই করার জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা ইমিগ্র্যান্টদের স্ট্যাটাসকে সমস্যাসঙ্কুল করে তুলছে। এমনকি যদি কেউ ডকুমেন্টও বহন করে থাকে, ওয়ার্ক পারমিট দেখিয়ে থাকে, তার অবস্থাও ভয়াবহ হতে পারে।
হাফপোস্টকে আসিফের আইনজীবী পট্টার বলেন, এ বিষয়টি আমার ধারণাতীত। আমার ক্লায়েন্ট তার কমিউনিটিতে ভয়ানক কেউ নন। তার স্ত্রী আছে এবং তিনি স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত। তারপরও তিনি আটকে আছেন। আইস তাকে কোনভাবেই ছেড়ে দিতে চাচ্ছে না।
পট্টার সন্দেহ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সাথে তার ক্লায়েন্টের সমস্যা শুরু হয় দক্ষিণ টেক্সাসে গাড়ি চালিয়ে আসার আগে থেকে। ২০১৪ সালে আসিফ যখন তার চাচাকে দেখতে আমেরিকায় আসেন, তখন তার এখানে থাকার কোন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তিনি কথার কথায় জেনিফার নামে ওহাইওর এক মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যান। স্ত্রী হিসেবে তাকে একসময় গ্রহণ করেন। সেসময় আসিফ ইংরেজি তেমন ভাল জানতো না। জেনিফার তারপরও তার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করেন। তিনি যেহেতু বৈধভাবে এদেশে এসেছেন, তাই ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করেন। এক সময় আসিফ ইউরোপ চলে যেতেও চেয়েছিল। কিন্তু জেনিফার তাকে যেতে দেয়নি। ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে তিনি উবার ও লিফটে কাজ করতেন। গতবছর তার চাচাতো ভাইয়ের ব্যবসার সাথে যোগ দেয়ায় তার আয় বাড়ে। সেমি ট্র্যাক ড্রাইভার হিসেবে সে সারাদেশে ঘোরে। তার সর্বশেষ ড্রাইভিং ছিল দক্ষিণে টেক্সাসে। যদি তিনি বুঝতেম, তার এই দশা হবে, তাহলে হয়তো এখানে তিনি আসতেনই না।
গত ১১ জানুয়ারি ফুলকারিয়াস নামক স্থানে চেক করার সময় তাকে আটক করা হয়। তখন তার ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ ছিল। তারপরও তার আবেদন পেন্ডিং আছে। ইতিপূর্বে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ ৬ মাস বাড়ানো হয়। তারপরও আইস তা গ্রাহ্য করেনি।
তার আইনজীবী বলেন, আসিফ আসলে বৈষম্যের শিকার। যখন তিনি গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করেন, তখন তার প্রতি বৈষম্য করে তা ইস্যু করা হয়নি। কেনো করা হয়নি, তা ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ বলে কাস্টমস এজেন্টরা পাশ কাটিয়ে যায়। তারা এ মামলা নিয়ে কোন মন্তব্য করতেও নারাজ। কিন্তু এজেন্সির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা সত্তে¡ও গোপনীয়তার অজুহাত তুলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলিমদের মধ্যে যারা গ্রিন কার্ড, ভিসা এবং সিটিজেনশিপের জন্য আবেদন করেছেন, তাদের আবেদন মঞ্জুরে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিচ্ছে। এ ছাড়াও কোনো কারণ না দেখিয়ে অনেকের আবেদন নাকচ করে দেয়া হচ্ছে।
২০১২ সালে এক মামলার মাধ্যমে ‘কন্ট্রোল এপলিকেশন রিভিউ এন্ড রেজুলিউশান প্রোগ্রাম’ বা ‘সিএআরআরপি’ নামে এক কর্মসূচির সন্ধান পাওয়া যায়। অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন, মুসলিম প্রধান দেশ থেকে লোকজনদের টার্গেট করে এ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। আর তা প্রয়োগ করে অনেককে গ্রিনকার্ড, ভিসা ও অন্যান্য ইমিগ্রেশন সুবিধা থেকে অবৈধভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যেখানে সেখানে যাওয়ায় সমস্যা রয়েছে। বাফেলোতে ওয়ার্ক পারমিটধারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ওয়ার্ক পারমিট কাগজ দিয়েও চলাচল নিরাপদ নয়, নবায়নের রিসিপ্ট অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করে না।