ঢাকা : সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার দাবিতে আগেই সম্মতি জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমার হার (সিআরআর) কমিয়ে আনার আবদারও এবার পূরণ হলো বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের। তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ব্যাংক নিয়ে সংবাদ প্রকাশে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। এ জন্য ফিন্যান্সিয়াল ইনফরমেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের বিষয়টি নিয়েও বাজেটের সময় আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
গত ৩০ মার্চ বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সঙ্গে বৈঠকের এক দিন পর গত ১ এপ্রিল আবারো বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সিআরআর কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। আগে আমানতের সাড়ে ৬ শতাংশ বিনা সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হতো ব্যাংকগুলোকে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাড়ে ৫ শতাংশ রাখলেই চলবে।
এ ব্যাপারে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, গত ১ এপ্রিল বৈঠকে গভর্নর তার পুরো টিম নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। বিএবির অনেক দাবি-দাওয়া ছিল। ব্যাংকগুলোকে আমানতের সাড়ে ৬ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হয়। বিএবি এটি ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানোর দাবি জানিয়েছিল। এ নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা হয়েছে। সবার বক্তব্য ও পরামর্শ শুনে আমরা ডিসেম্বর পর্যন্ত সিআরআর ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটিকে আমরা পর্যালোচনা করব আগামী জুনে। এতটুকু সময়ের মধ্যে কী প্রভাব পড়ে, সেটি দেখব। তবে জুন মাসের আইডিয়াটা আমরা নয়। এটি সালমান এফ রহমান দিয়ে গেছেন। যদি দেখি এটি কার্যকর পদক্ষেপ হয়েছে, তাহলে ঠিক আছে। আরো কিছু করার দরকার পড়লে তাও করা হবে।
গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে ঋণ বিতরণ করাই ব্যাংকের প্রধান কাজ। তবে আমানতের সব টাকাই ঋণ দিতে পারে না ব্যাংক। আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ ব্যাংকগুলোকে বিনা সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়, এটিই সিআরআর।
সিআরআর ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানোর ফলে বাজারে অতিরিক্ত প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা আসবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, সিআরআর কমানোর ফলে মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে এমন তথ্য জানালে অর্থমন্ত্রী তা উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, দেশে এমন কিছু হয়নি, যার জন্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। মূল্যস্ফীতি এ বছর বাড়বেই না।
এত দিন ধরে চলে আসা নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যেত। বাধ্যতামূলকভাবে ৭৫ শতাংশ রাখতে হতো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এর ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত গত ৩০ মার্চ রাতে জব্বার টাওয়ারের বৈঠকেই দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। গত ২ এপ্রিলের বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা জানিয়ে দেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা কোথায় রাখা হবে, সে ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত দিতে পারে। আমরা এটি করে দিয়েছি। আমার অফিস থেকে এরই মধ্যে এটি ইস্যু হয়ে গেছে।
এসব পদক্ষেপে ঋণের সুদহার এক অংকে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। আগামী এক মাসের মধ্যেই এটি হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে সুদহার বাজারই নির্ধারণ করবে বলে জানান বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যেই সুদের হার এক অংকে নেমে আসবে, এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সিআরআর কমলে ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক আমানত বেসরকারি ব্যাংকে এলে তারল্য সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঋণের সুদহার এক অংকে নেমে আসবে।
ব্যাংক নিয়ে যাতে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা না হয়, সে জন্য ফিন্যান্সিয়াল ইনফরমেশন অ্যাক্ট প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন ব্যাংক উদ্যোক্তারা। গত ৩০ মার্চ বিএবি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও দাবিটি তোলেন তারা। গত ১ এপ্রিলের বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি এখন হবে না। এটি হবে বাজেট আলোচনার সময়।
সোনারগাঁও হোটেলে গত ১ এপ্রিল বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ছাড়াও ডেপুটি গভর্নর এস এম মুনিরুজ্জামান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরীও অংশ নেন। বিএবির পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. এইচ বি এম ইকবাল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান ছাড়াও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও বৈঠকে অংশ নেন।
প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার কথা বলেন। কোনো কথা না বলেই সবার আগে বেরিয়ে যান আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। বৈঠকে ব্যাংকিং খাতের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ এ নিয়ে কথা বলেননি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকগুলোর যেসব দাবি, তা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখে থাকে। এটির কর্মকর্তা বা নিয়ন্ত্রক হলেন গভর্নর। আমি সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। হ্যাঁ, আমি হয়তো প্রভাবিত করতে পারি।
উল্লেখ্য, এর আগে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে পরিচালকের মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি এক পরিবার থেকে দুজনের পরিবর্তে চারজনের পরিচালক হওয়ার সুযোগ রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী পাস হয়েছে। নতুন ব্যাংক অনুমোদনও প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে।