ব্যাংক : লাভ চাই না সঞ্চয় সামলা?

মোস্তফা কামাল : কেবল সাইবার নয়, এমনিতেই ব্যাংকে জমা রাখা টাকা ঠিকঠাক আছে কিনা- এ নিয়ে সংশয় ভর করেছে গ্রাহকদের মধ্যে। গুজব-গুঞ্জনসহ এ নিয়ে প্রচুর উড়োকথা। হ্যাকারদের চেয়েও বেশি উদ্বেগ ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা, তথা মূলধন নিয়ে। কয়েকটি ব্যাংকে রাষ্ট্রীয় বীমা প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা কর্পোরেশনের রাখা টাকা ফেরৎ পেতে দুর্গতির খবরটি গ্রাহকদের এ উদ্বেগে বাড়তি টোকা দিয়েছে। এ টাকা জীবন বীমার গ্রাহকদের। সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা পেতেই এমন দশা হলে ব্যাংকের সাধারণ সাধারণ গ্রাহকদের অবস্থা কী হতে পারে?
এ নিয়ে অন্তহীন উদ্বেগ গ্রাহকদের মধ্যে। ব্যাংক বা সরকারের তরফে অভয়বাণী বা কোনো ধরনের ব্যাখ্যা মেলেনি। তার ওপর সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে কথার চেয়ে কুকথা বেশি হচ্ছে। পথে-ঘাটে মনিচ্ছা (মন+ইচ্ছা) মতো কথার ছড়াছড়ি। এর জেরে কেউ কেউ একটু একটু করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সিন্দুক-আলমারিতে, লেপ-তোষকে ঢোকাতে শুরু করেছেন! লক্ষণটা কী ভালো?
এমনিতেই সাধারণ মানুষের অর্থনীতি নিয়ে ভাবার ফুসরত কম। বড়জোর মাইক্রো ইকোনমিক্স নিয়ে টুকটাক ভাবে তারা। ম্যাক্রো ভাবার ফুসরত কম। জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়ের মতো বিষয় নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। খাবার, ওষুধসহ নিত্যপণ্যের দাম ওঠানামার আলোচনাও করে যার যার সামর্থ দৃষ্টে। এসবের দাম আকাশচুম্বি হয়ে গেলে চটে, ক্ষেপে। কিন্তু, বিক্ষুব্ধ হয় না। বিক্ষোভে ফেটে পড়ার দিন কি আর অবশিষ্ট আছে?
এরপরই নানা ব্যাংকের খবর জানা! তাদের কাছে জরুরি বিষয় আমানত খেয়ানত না হওয়ার গ্যারান্টি। এর বিপরীতে একটি শ্রেণি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট, স্বর্ণালংকারসহ বিলাসপণ্যের পাহাড় গড়ছে। ব্যবসায়ীদের একটি মহল দেদার ব্যাংকঋণ নিচ্ছেন। আমানতের চেয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ বেরিয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। এক হিসাব বলছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকখাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। এই এক বছরে ঋণ বাড়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা! কী বার্তা মিলছে এতে?
টাকাঅলাদের জন্য সুযোগটা সেরের ওপর সোয়া সেরের মতো। যা দেশে খেলাপি ঋণে নতুন আরেক রেকর্ড তৈরি করেছে। গত জুন শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। উপরোক্ত তথ্যে পরিস্কার, সময়টা এখন খেলাপিদের। যতো সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে তারাই। নানা সুবিধা নিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে রাখতে পারছেন, আবার বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের ঈমানদার ক’জন জন্মেছে এ দেশে?
ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়াও তাদের কারো কারো কাছে আভিজাত্য, হিম্মত, এমন কি স্মার্টনেসের ব্যাপার! ক্ষমতাবান বলেই এমন ব্যক্তিত্বদের ঋণ পেতে সমস্যা হয় না- এ প্রচারণা তাদের মর্যাদা সমাজে আরো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু কয়েক লাখ, বড় জোর কোটি টাকা পেয়ে ব্যবসা করবেন, সুদাসলও ফেরত দেবেন- এমন কেউ ঋণ চাইলে কী দশায় পড়েন? জানেন ভুক্তভোগীরাই। কতো নিয়ম-কানুন তাদের জন্য! পুরো ব্যাপারটাই একদম ওপেন সিক্রেট। এর জেরে বোনাস প্রাপ্তির মতো সাধারণ আমানতকারীরা ভুগছেন টেনশনে। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় কিনা, সঞ্চয়ের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কিনা- এ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসায় মাথা ঘুরছে তাদের। তাদের উদ্বেগমুক্ত করতে রাষ্ট্রের কি কোনো উদ্যোগ থাকতে নেই?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন, ঢাকা।