ব্যাক টু স্কুল

হুসনে আরা :

অবশেষে বড় বলে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত হলো। শিক্ষক বাবার সাইকেলের পেছনে বসে কাঁধে ছোট্ট ব্যাগ ঝুলিয়ে স্বগর্বে বীরদর্পে আমার জন্য নির্ধারিত পাবনা গার্লস স্কুলের প্রধান গেটের সামনে উপস্থিত। তারপর বাবার হাতটি ছেড়ে যাঁর হাত আকড়ে ধরেছিলাম, তিনি আমাদের স্কুলের কেরানি স্যার। সৌম্য, মমতা মাখা তাঁর সেই হাতটি ধরেই নির্দিষ্ট শ্রেণিকক্ষে ঢুকে প্রথমবারের মতো বিশ্বজয় করার অনুভূতি জন্মেছিল! আমার স্কুল কতোবড়! আমার শিক্ষক এতো জানে। আর আমি এই স্কুলের শিক্ষার্থী।
নাম জিজ্ঞেস করলেন শ্রেণি শিক্ষিকা সবিতা দিদিমণি। সেই মুহূর্তের অনুভূতি এখনও জীবন্ত। মনের কথা, আমাদের এই সবিতা দিদিমণিই পৃথিবীর সব শিক্ষার্থীর একমাত্র শিক্ষক। সময়টা স্মরণে বরণীয় হয়ে ওঠে মনের হিসেবের পাতায় অংক কষে আমার।
সবিতা দিদিমণি প্রথমদিনেই আমার খাতার একটা লাল পদ্মফুল এঁকে দিয়ে এই ছোট্ট মনে গভীর ভালোবাসার দাগ কেটে দিয়েছিলেন। যা আজও আমি মমতামাখা শ্রদ্ধার উষ্ণতায় লালন করে চলেছি। সেই সাথে জীবনের ব্রত শিক্ষকতা আর সবিতা দিদিমণিকে সেই স্বপ্নের সিঁড়ি তৈরির কারিগর বলে দীক্ষা গ্রহণ করেছি।

তারপর পরিচয় হলো আমার প্রথম শ্রেণির বই, সাত রাজার ধন ‘মুকুল মালা’র সাথে। বাসায় কলেজ পড়ুয়া ছোট চাচার টেবিলে তার বইয়ের স্তুপের পাশ্বে স্ব-অধিকার নিয়ে স্থান করে নিয়েছিল আমার গুরুত্বপূর্ণ মহামূল্যবান ‘মুকুল মালা’। ‘মুকুল মালা’র একমাত্র দাবিদার আমি। এই বোধের আঙিনায় সূর্যালোকের মত উজ্জ্বল হয়ে আছে সেদিনের অপ্রকাশিত হৃদয়ের কথামালা। যা আজও মনকে রাঙিয়ে তোলে, সংকল্পবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

৭০ বছর আগের সেই একান্ত আমার ‘মুকুল মালা’ মায়ের কল্যাণে এই প্রবাসজীবনে আমার হাতে আসে, যা আজও এই পড়ন্ত বিকেলে সব প্রেরণা ও প্রাপ্তির উৎসস্থল। সপ্তাহে অন্ততঃ একটি বার আমার স্বযত্নে রক্ষিত মুকুল মালাকে স্পর্শ করে, আলিঙ্গনাবদ্ধ করে উজ্জীবিত হয়ে উঠি পথ চলায়। আর আহরণ করি শিশুবেলার স্নিগ্ধতা।
‘খুকু দেয় হামাগুড়ি
পায়ে লাগে সুড়সুড়ি
খল খল হাসে হাসি
যেন মুকতার রাশি…।’

‘আমার বাড়ি যাইও পাখি
বসতে দিব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দিব,
শালি ধানের চিড়ে…।’

‘বক মামা, বক মামা,
ফুল দিয়ে যা,
নারকেল গাছে কড়ি আছে
গুণে নিয়ে যা।’
বক মামার সাথে দুরন্ত এ মনটিও আকাশে ভেসে বেড়াতো, আর মনটিকে ইচ্ছে পূরণের কথা যে ভাবতো। তারপরÑ
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকেÑ’
আমার চঞ্চল মনটা দাদাবাড়ির সেই ছোট শ্রীকোলার দহে ঝাঁপাঝাঁপি করতে মহাব্যস্ত হয়ে ওঠে আজও। আরÑ ‘রাজকন্যা ও রাজপুত্রের’ গল্প পড়িয়ে সবিতা দিদিমণি আমাদের মনে করুণ রসের ছবি এঁকে দিতেন, যা আজও সেইদিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
‘এক শালিক রাঁধে বাড়ে
দুই শালিক খায়,
আরেক শালিক না পেয়ে
বাপের বাড়ি যায়।’
আহা আরেক শালিকের অপ্রাপ্তির কষ্টে সেই মনটা দুমরে মুচরে যেতো যেনো!
৪৮ পৃষ্ঠার ছোট্ট আকারের ‘মুকুল মালা’র শেষ লেখাÑ
‘খোকা যাবে যুদধে,
খুকু যাবে যুদধে,
বনদুক তলোয়ার
দেরে তার হাতে দে।’
চঞ্চল মন খোকা-খুকুর সাথে যুদ্ধে যেতে মন প্রস্তুত হয়ে উঠতো। মনে পড়ে যেত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা। সেই সাথে কত ছড়া, কবিতা ও লেখা। যা মনকে রাঙিয়ে তুলতো, কখনোবা বিষাদময় আনন্দে বহু দূরে নিয়ে যেতো।

প্রবাহিত সময়ের পথ বেয়ে আমি আজ এক অস্তগামী সূর্য। শিশুবেলার ‘মুকুল মালা’ এখনও আমাকে পূর্ব দিগন্তে সূর্যরশ্মির আভা বিচ্ছুরণে প্রচণ্ড দীপ্যমান বলে প্রমাণ করে। আজও আমি যেনো তোজোদীপ্ত এক অগ্নিপিণ্ড, যা সতেজ জীবনের প্রতীক।
আমি আমার ‘মুকুল মালা’কে নিয়ে এতক্ষণ যা ভাবছিলাম, ভাবনার কথাগুলো মনের আঙ্গিনায় নেচে গেয়ে মনকে চঞ্চল করে নদীর প্রবাহিত স্রোতধারার মতো মহা কল্লোলে বয়ে যাচ্ছিলো যেনো।

গত ২ সেপ্টেম্বর ‘জ্যামাইকা-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি’ আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘ব্যাক টু স্কুল’ উপলক্ষে মনের খাতায় লেখা হচ্ছিল মহা প্রাণস্পর্শী মহাপ্লাবন। যে প্লাবনে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম ৭০ বছর আগে আমার জীবনের প্রথম ‘ব্যাক টু স্কুলে’। জ্যামাইকা-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি আয়োজিত ‘ব্যাক টু স্কুল’ অনুষ্ঠানটি হচ্ছিল জ্যামাইকা ক্যাপটেন টিলি পার্কে।

ঐদিন বিকেল ৫টায় শতাধিক শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে ‘সাত দশক’ আগে বাবার সাইকেলের পেছনে বসে প্রথম স্কুলে ঢোকার অনুপম মুহূর্তের কথা মনে ছবি হয়ে ভেসে উঠছিল। ক্যাপটেন টিলি পার্কে বসে ৭০ বছর আগের সেই আমি অনুভব করছিলাম এই সমাবেশে অলিখিত এক স্বপ্ন যেনো সবাইকে জানান দিচ্ছিলোÑ ‘শিক্ষাই মন্ত্র, আর একতাই বল।’ শৃঙ্খলাবদ্ধ শিক্ষার্থীরা সম্মুখে দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলো, পাশে অভিভাবকসহ তাদের ‘ব্যাক টু স্কুল’-এ যাবার উপহার গ্রহণ করতে। শুভেচ্ছা উপহার, বছরের নতুন ক্লাসে প্রবেশের শুরুতে উপহারÑ শুভ কামনার প্রতীক। যা মনকে নতুন শুভ মন্ত্রে দীক্ষিত করে।
ধন্যবাদ জ্যামাইকা-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং দক্ষ প্রেসিডেন্ট ফখরুল ইসলাম দেলোয়ারসহ সব কর্মকর্তা, উপদেষ্টা, সহযোগী সংগঠন, পৃষ্ঠাপোষক ও আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে। তাদের আন্তরিকতা দীর্ঘদিন মনে থাকার মত। আবারও কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। তাদের জন্য প্রবাসে বসে সেই ফেলে আসার জীবনের প্রথম সোনালি মুহূর্তটি রোমন্থনের উপদান আস্বাদনের স্মৃতি মুখরিত ক্ষণটির আয়োজনের জন্য। আমরা আসলে জীবনের প্রতিটি ক্ষণে সবাই শিক্ষা লাভের জন্য ‘ব্যাক টু স্কুলে’ যাই। শুভ কামনা সব শিক্ষার্থীর জন্যÑ ব্যাক টু স্কুল- আমাদের জীবনের মূল মন্ত্র।

সবশেষে স্মৃতিবিজড়িত ৭ দশক আগের এবং সদ্য শিক্ষার্থীর জন্যে পাওয়া আমার উপহার ‘মুকুল মালা’ এবং ‘বইয়ের ব্যাগ’-এর সংমিশ্রণের অনুভূতির জন্য। ‘ব্যাক টু স্কুলের’ সব শিক্ষার্থীর সাথে আজ আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে চাই ‘শিক্ষাই মন্ত্র’Ñ এ দীক্ষা গ্রহণ করে মানবিক হয়ে ওঠার জন্য উজ্জীবিত হতে। সম্মানিত অভিভাবকরাও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেনÑ সামনে শুদ্ধ জীবন ও মানবিক বিশ্ব গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকার অঙ্গীকারে একতাবদ্ধ হয়ে জীবনের পাঠশালামুখী হতে।

-লেখক : কলামিস্ট, সাহিত্যিক
৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২