
আব্দুল কাইউম আনোয়ার
আমরা বাংলাদেশি। পৃথিবী নামক গ্রহের ক্ষুদ্রাকার এক রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী তিন দিক ভারতবেষ্টিত এই দেশের জনগণের ভাষা বাংলা। অনেকেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি বলতে পারেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে দলে দলে আমরা মানচিত্রের বহু দেশে অভিবাসন শুরু করি। ইউরোপের পরই উত্তর আমেরিকায় আমাদের জনগণ বেশি আসতে শুরু করে। সরকারি কর্মচারী ও উচ্চশিক্ষার্থে যারা ১৯৮৫ সালের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, তারা ছাড়া অন্যান্য কর্মের সন্ধানে আসে হাজারে হাজার বাংলাদেশি, প্রেসিডেন্ট রেগানের ক্ষমা ঘোষণার পরে। আমি নিজেও সেই দলের অনুসারী।
১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রেগান ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা (Amnesty Act) আইনটি পাস হওয়ার পর প্রায় তিন মিলিয়ন বেআইনি জনসাধারণ এ দেশে স্থায়ী বসবাসের লক্ষ্যে গ্রিন কার্ডের আবেদন করে এবং তিন বছরের মাথায় নাগরিকত্ব পেয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, নাগরিকত্ব পাওয়ার আগেই আমরা অনেকেই পরিবারের অভিবাসনের আবেদন করি এবং অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বউ-বাচ্চাসহ স্বপ্নের এই দেশে তারা পাড়ি জমায়। তারপর জীবনের এক ক্রান্তিলগ্ন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। আমরা তখন এ দেশে স্থায়ী এক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ি।
মনে পড়ে সেই ১৯৮৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর মরুভূমির দেশ কুয়েত ছেড়ে কুয়েত এয়ারলাইন্সের বিমানে সোজা নিউইয়র্ক বিমানবন্দর জেএফকেতে অবতরণ করি। ডিসেম্বর মাস, বরফঝরা মৌসুমে হিমেল হাওয়া বইবে-এটাই স্বাভাবিক। তাইতো আমি রওনা দেওয়ার আগেই হাতে রেখেছিলাম ওভারকোটটি। বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার আগে ইনফরমেশন ডেস্ক থেকে তথ্য জেনে নিলাম, কীভাবে কত সস্তায় নিউইয়র্কের প্রাণকেন্দ্রে যেতে পারব। ডেস্কের সুন্দরী মহিলা যে এত সদয় হবে, ভাবতে পারিনি। সে ডেস্ক ছেড়ে উঠে এসে পাশের বিশাল কাচের দরজাটি খুলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, মাত্র ১০ হাত দূরের বাসস্ট্যান্ডটি। বুঝিয়ে বলে দিল, এখানেই সাঁটল বাস এসে থামবে, মাত্র পাঁচ ডলারে নিয়ে যাবে টাইম স্কয়ারে। আমি তাকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার কাছ হেকে বিদায় নিলাম। হিমেল হাওয়া বইছে, তাই কোটটি পরে নিলাম। এক হাতে টানা ছোট স্যুটকেস আর অন্য হাতে ব্রিফকেস। কয়েক মিনিট লাইনে দাঁড়ানোর পর এসে গেল বাস। সব যাত্রীর সঙ্গে আমিও চড়লাম বাসে। মাত্র আধঘণ্টায় বাস এসে পৌঁছাল ম্যানহাটনের টাইম স্কয়ারে।
টাইম স্কয়ারে যে হোটেলে ঢুকেছি, এটি একটি পান্থশালা। খুব সস্তায় থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে। সেই হোটেলটি অনেক আগেই ভেঙে ফেলে বিশাল বহুতলবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে সেখানে। হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি কী করব, ভর্তির খাতায় নাম লেখাব নাকি কুয়েত বিমানবন্দরে আমাকে তুলে দিতে যারা এসেছিল, তাদের একজনের দেওয়া চিরকুটটিতে যে ফোন নাম্বারটি আছে সেখানে ফোন করে দেখব তারা কী উপদেশ দেয়। ফোনের জন্যে দরকার যে কোয়ার্টার, তা বাক্সে ঢুকিয়ে চেষ্টা করলাম কিন্তু ডায়াল রিং আসছে না। তাই পাশেই যে ভদ্রলোক অন্য ফোনটি মেরামত করছিল, তার কাছে সাহায্য চাইলাম এবং পেয়ে গেলাম লাইন। ভাঙা গলায় যে বুড়ো ভদ্রলোক কথা বলছিলেন, তাকে যখন আমার পরিচয় দিলাম এই বলে যে ওনার আত্মীয় যে আমার বন্ধু এবং কুয়েতে থাকে, সে আমাকে ফোন নাম্বারটি দিয়ে বলেছে প্রয়োজনে সেটি কাজে লাগাতে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে বললেন, তুমি হোটেলে না উঠে বরং আমাদের ঘরে চলে আসো। হোটেলে একা থাকতে ভালো লাগবে না। ট্যাক্সি ডেকে তখন গিয়ে উঠলাম ওনাদের ওজোন পার্কের গ্র্যান্ট অ্যাভিনিউর ঘরে। প্রায় ছয় মাস ছিলাম ওনাদের সঙ্গে। তারা আটজন থাকতেন সেই একই ঘরে। সবাই একে অন্যের আত্মীয়। অচিন এক দূর প্রবাসে চিরকুটে লেখা সেই ফোন নাম্বারটি যে কত সহায়ক হয়েছিল, আজীবন আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করি।
যুক্তরাষ্ট্রে এলাম বটে কিন্তু পরদিন থেকে রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রে যেসব হেডলাইন আসতে থাকল, তাতে মনের উৎসাহ কমে গেল। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা তীব্রভাবে কামড় বসিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের হেডলাইন : ‘IBM LAID OFF 35,000 EMPLOYEES’, ‘LEHMAN BROTHERS LAID OFF 25,000 EMPLOYEES’ এ-জাতীয় সংবাদ আসছে প্রতিদিন। এ অবস্থায় এখানে থাকব না ফিরে যাব কুয়েতে রেখে আসা চাকরিতে, সেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি। উপদেশ দিলেন সেই বয়স্ক বড় ভাই, এ দেশে বর্তমানে যে সুযোগ হয়েছে গ্রিন কার্ড পাওয়ার, তা হয়তো আর ১০০ বছরেও আসবে না। সুতরাং গ্রিন কার্ডটা বানিয়ে চলে যাও। শেষ পর্যন্ত থেকেই গেলাম। চাকরির বাজারে দুর্দিন, তবু ইংরেজি জানি বলে ম্যানহাটনের অষ্টম অ্যাভিনিউ ও চুয়াল্লিশ স্ট্রিটের সবচেয়ে বড় স্যুভেনির দোকানে সেলসম্যানের চাকরি পেয়ে যাই।
প্রায় ছয় মাস ওজোন পার্ক থেকে ম্যানহাটনের স্যুভেনির স্টোরে কাজে আসা-যাওয়া করছি। কোরিয়ান মহিলা মালিকের পক্ষ থেকে অকস্মাৎ দৈব এক সুযোগ পেয়ে যাই। মালিক মহিলা একসময় তার মাকে সঙ্গে নিয়ে যে ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকত, সেই অ্যাপার্টমেন্টটি ছিল কাজের জায়গা থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে। মালিক মহিলা কী ভেবে আমাকে সেখানে বিনা ভাড়ায় থাকার অনুমতি দিল। সে ছিল আমার জন্য আলাদিনের প্রদীপ পাওয়ার মতো। তিন মাস কাজ করার পর মালিক আমাকে ম্যানেজার বানিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ল। রাশিয়া, চীন হয়ে উত্তর কোরিয়া, যেখানে তার সৎ ভাইবোনেরা বসবাস করে, সেখানে চলে গেল। এক মাস কাটিয়ে সে ফিরে আসে নিউইয়র্কে। এদিকে আমি গ্রিন কার্ড পাওয়ার প্রতীক্ষায় দিন গুনছি। দেড় বছরের মাথায় ইমিগ্রেশনের পরীক্ষা দিয়ে অস্থায়ী গ্রিন কার্ড পেয়ে যাই। পরদিনই বিমানের টিকিট কেটে উড়ে যাই বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে ফিরে আমি আর সেলসের কাজে যোগ দিইনি। শুরু করি সিকিউরিটির কাজ। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি উন্নততর কোনো অফিশিয়াল জবের। পেয়েও যাই জাপানের এক বিখ্যাত করপোরেশনের চাকরি। পুরো ১০ বছর একনাগাড়ে চাকরি করার পর ভাগ্যে নেমে এল দুর্যোগ। আল কায়েদা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিল টুইন টাওয়ার। ম্যানহাটনের সব বড় ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে আমি লে-অফে পড়ি। যদিও চাকরি হারানোর বেনিফিট পাচ্ছিলাম, তবু বসে থাকিনি। প্লাজা কলেজে ভর্তি হয়ে নলেজ ও স্কিলের ওপর সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করি। ইতিমধ্যে পাঁচটি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাও দিই। সব কটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই এবং প্রথম চাকরি হয় নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে। দেড় বছরের মাথায় ডাক আসে পাতাল রেলের স্টেশন এজেন্টের। একই সরকারের চাকরি, তাই কেবল ফাইল বদল হলো। তৃতীয় যে চাকরির ডাক এল, আরও ভালো বেতনে ভালো পোস্টের, তাতে যোগদান করা হয়নি। ২০১০ সালে রিটায়ার্ড করি। অবশ্য এর অনেক আগেই অর্থাৎ আমার স্থায়ী গ্রিন কার্ড পাওয়ার তিন বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে আমার স্ত্রী দুই আত্মজাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমান নিউইয়র্কে। ১৯৯৪ ও ১৯৯৬ সালে যথাক্রমে আমদের পরিবারে জন্মসূত্রে নাগরিক হয়ে জন্ম নেয় দুই ছেলে। এর আগে আমাদের প্রথম ছেলে সতেরো বছর বয়সে ১৯৯২ সালে ফুটবল খেলায় মাথায় আঘাত পেয়ে পনেরো দিনের মাথায় ঘুমের মধ্যে ব্রেন হেমারেজে মারা যায়। আমাদের পরিবার আজও সেই স্মৃতি ভুলতে পারেনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার পরিবার এ দেশে পৌঁছার ঠিক দুই দিন আগে আমার এক বন্ধু বুরহান আহমেদের উদ্যোগে ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টারে আসি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে। সত্যি বলতে কি, বন্ধু যে বিল্ডিংয়ে থাকেন, সেই বিল্ডিংয়ে প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টই বেশ বড়সড় অথচ ভাড়াও তুলনামূলক কম। তাই সুপারকে অগ্রিম ভাড়ার টাকা দিয়ে দিলাম। পরিবার এসে উঠল সেই অ্যাপার্টমেন্টে। কিছুদিনের মধ্যে পার্ক চেস্টারের এই বিল্ডিংয়ে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি লোকের বসবাস শুরু হয়। একসময় সেই বিল্ডিংয়ের নামকরণ হয় ‘কারি হাউস’। এই নামের কারণ হলো, বাংলাদেশি কারির গন্ধ অর্ধকিলোমিটারজুড়ে বাতাসকে ঘনীভূত করে তোলে। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই কারি হাউস ছেড়ে তারই পাশের ব্লকে নিজস্ব বাড়ি কিনে উঠে আসি এবং আজও একই বাড়িতে বসবাস করে আসছি।
এখন বলি স্বপ্নের দেশে উত্তরণে নিজের ও পরিচিত কয়েক পরিবারের স্বপ্ন-সার্থকতার কিছু কথা। এ দেশে আমাদের উত্তরণের পেছনে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত কারণ নিহিত ছিল। ভবিষ্যতের যাত্রাপথের দুটি ধারা নির্ধারিত করি আমরা। প্রথমত নিশ্চিত করি অন্নসংস্থান, দ্বিতীয়ত পরবর্তী প্রজন্মের সুশিক্ষার বন্দোবস্ত করা। এই দুটো লক্ষ্যে আমরা বেশির ভাগ বাংলাদেশি সার্থক হয়েছি। অভিবাসনের প্রথম পর্যায়ে সবাইকে কিছুটা কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট কেটে গেলে আমাদের ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষার বন্দোবস্ত করে সমাজে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আমার চার সন্তানের বড় দুই মেয়ে, একজন নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির ম্যানেজার, অন্যজন জেপি মরগান ফিন্যান্স করপোরেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। আর বড় ছেলে ফিন্যান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করে নিউইয়র্কের আরেকটি বড় করপোরেশনে চাকরি করছে। সব ছোট ছেলের বেলায় নিয়তি বৈরী, সাড়ে চৌদ্দ বছর বয়সে এক রাতে সে স্ট্রোকের শিকার হয়। ফলে স্মৃতিশক্তি অনেকটাই হ্রাস পায়। কোনোমতে হাইস্কুল ডিপ্লোমা নিয়ে বিশ্রামে আছে।
এখন বর্ণনা করি পাড়াপড়শিদের জীবনকাহিনি। যদিও উচ্চবিত্তের সমাজে বসবাসের সুযোগ করতে পারিনি আমরা কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজে বসবাস করেও আমাদের জীবনযাপনে যে অগ্রগতি, তা সত্যি গর্ব করার মতো। বর্তমান প্রজন্মের বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা মেধার ক্ষেত্রে যে বিকাশ দেখিয়েছে, তা প্রণিধানযোগ্য বৈকি। হাইস্কুল লেভেলে নিউইয়র্কের মতো বৃহৎ শিক্ষা বিভাগে যেখানে প্রায় দেড় মিলিয়ন ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে, সেখানে যে চার-পাঁচটি হাইস্কুলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নিয়ে শুধু মেধাবীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শত শত বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অগ্রগতির পেছনে শুধু যে গার্ডিয়ানদের ভূমিকাই কাজ করে তা নয়, দু-চারটি টিউটরিয়াল, যেমন খান’স টিউটোরিয়াল, মামুন’স টিউটোরিয়াল ও আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাকেও স্বীকার করে নিতে হয়। নিজেদের ছেলেমেয়েদের ঘরে-বাইরে গাইড করার দায়িত্ব মূলত বাবা-মায়ের। তারা যখন ঘরের বাইরে স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, সেখানে কোন পরিবেশে তারা সময় কাটাচ্ছে, সেই পরিবেশে তাদের উপযুক্ত নিরাপত্তা ছাড়াও সৎসঙ্গ পাচ্ছে কি না, সেসবের খবরাখবর নেওয়া। প্রতিদিনের হোমওয়ার্ক নিয়ে তারা ঘরের ভেতরে সময় কাটাবে ঠিকই কিন্তু সুস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে খেলাধুলাও চালিয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের সকল কর্মক্ষেত্রে যেন মা-বাবার তীক্ষè নজর থাকে।
আমার পরিবার নিয়ে যে পাঁচ বছর আমি কারি হাউসে কাটিয়েছিলাম, সেই বিল্ডিংয়ে বসবাসকারী অন্য কয়েকটি পরিবারের স্বপ্নের দেশে উত্তরণের সার্থকতার কথা না বললেই নয়। অবসরে যাওয়া আহবাব আহমেদের ছেলে ডাক্তারি পাস করে ক্লিনিক খুলে চিকিৎসা পেশায় রত। বন্ধুপ্রতীম আরিফ রাহমানের দুই মেয়ে দামি ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিয়ে নিউইয়র্কের সরকারি বিভাগে উচ্চপদে চাকরি করছে। আরেক বন্ধু সৈয়দ রফিকের একমাত্র ছেলে যে কিনা ফুল স্কলারশিপে হার্ভার্ডে ব্যাচেলর শেষ করে বিলাতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে এসে এস্ত্রজেনিকা গবেষণাগারে উচ্চপদে চাকরি করে যাচ্ছে। কারি হাউসের আরেক কীর্তিমান পরিবার হলো আমার ছোটবেলার বন্ধু বোরহান আহমেদের বড় মেয়ের পরিবার। বড় মেয়ে রুনা বেগম ও তার স্বামী খলিলুর রহমানের চার ছেলেমেয়ে। প্রতিটি সন্তানই মেধাবী।
তারা সিটির বিশেষায়িত স্কুল, যেমন স্তাইভিজেন্দ কিংবা ব্রঙ্কস সায়েন্সের ছাত্রছাত্রী। স্কুল শেষ করে তিনজন ফুল স্কলারশিপে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে ভালো ভালো চাকরি করছে। রুনাদের বড় মেয়ের দুঃসাহসের কথা অনেকটা অবিশ্বাস্য। যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান এফবিআইয়ের চাকরিতে যোগদান করে সুনাম কুড়াচ্ছে। সে যখন ডিউটিতে যায়, নিজে ডাবল ব্যারল রিভলবার বহন করে এবং দুজন প্রহরী বেষ্টিত থাকে। বাংলাদেশি মেয়ে হয়েও দেশ-বিদেশের অনেক পুরুষকেও হার মানিয়েছে নাবিলা রহমান। এ ছাড়া ডিগ্রি লাভের ক্ষেত্রে বিজনেসে, কম্পিউটারে, আইনের শাখায়, হিসাবরক্ষণ ও শিক্ষকতায় অসংখ্য বাংলাদেশি সততার সঙ্গে কাজ করে আমাদের সমাজকে গর্বিত করছে। গোলাপে যেমন কাঁটা থাকে, এত গৌরবের মাঝেও খুঁজলে দু-একটি কাঁটাও পাওয়া যাবে বৈকি। আমার এক দূরসম্পর্কের নাতি যে মিডল স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসে ফার্স্ট হতো এবং একবার জুনিয়র স্পেলিং বি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল, সেই নাতিই একসময় মা-বাবার ঝঞ্ঝাটময় জীবনের প্রতিফল হিসেবে বিপথগামী হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত এই দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। আমাদের এই এলাকায় আরও পরিবার আছে, যাদের ছেলেমেয়েরাও উন্নতির বিভিন্ন শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। সবার পরিচিত মুখ আইনবিদ এম এন মজুমদারের মেয়েও অ্যাটর্নি সনদ লাভ করে পেশা চালিয়ে যাচ্ছে। সিলেটের স্বনামধন্য পরিবার একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি দিলওয়ারের কন্যা সুমনা রহমান, যিনি নিজেও একজন স্কুলশিক্ষিকা, তার নিজের তিন ছেলের দুজনই হার্ভার্ডের ডিগ্রিধারী।
আমাদের এই পার্কচেস্টার একসময় ছিল সন্ত্রাসের রাজত্ব। দিনেদুপুরে রাস্তার কোনায় দাঁড়িয়ে ড্রাগবাহিনী তাদের ব্যবসা চালাত। অনেক সময় নিরীহ জনগণের ওপর আক্রমণ করে টাকাপয়সা লুটপাট করত। মেয়র জুলিয়ানির কড়া আইন প্রয়োগে সেসব উপদ্রবের অবসান ঘটে। তার পর থেকে এখানকার সমাজে ভালো লোকের সমাগম শুরু হয়। সমাজের সবার জীবনের নিরাপত্তাও বাড়ে। বাংলাদেশিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। যে স্টারলিং অ্যাভিউনিতে মাত্র দুজন বাংলাদেশির ব্যবসা ছিল, এখন সেখানে পুরো অ্যাভিনিউর দুই পাশজুড়ে সকল ব্যবসায়ের মালিক বাংলাদেশিরা। কিছুদিন আগে সরকারি অনুমোদন লাভে সেই স্টারলিং অ্যাভিনিউ নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশ বাজার। কোন জিনিস নেই এই বাজারেÑগ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট, পোশাকের দোকান, চুল কাটার দোকান, পত্রিকা অফিস, স্বাস্থ্যসেবার অফিস, ট্যাক্স জমা দেওয়ার অফিস ইত্যাদি সবই আছে। বাংলাদেশি মালিকানায় সকল ব্যবসা ভালো লাভবান হচ্ছে। আরও উল্লেখ করতে হয়, এখানে দু-তিনটি টিউটোরিয়াল আছে। সম্প্রতি কয়েকটি পার্টি হলও খোলা হয়েছে। ফার্মেসি মালিকানাও বেড়েছে, এমনকি বাংলাদেশি মালিকানায় বিরাট একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারও খোলা হয়েছে এই পার্কচেস্টারে। অন্তত এক ডজন বাংলাদেশি ডাক্তার এই এলাকায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশি মুসলমানদের সর্বশেষ প্রাপ্তির মূল্যবান অবদান হলো এই এলাকায় অর্ধডজন জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি জুমায় হাজার হাজার মুসল্লির সমাগম হয় এসব মসজিদে। সব মিলে ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার এখন বাংলাদেশিদের এক অপূর্ব মিলনকেন্দ্র।