সজল আশফাক :
এক মাস ধরে দেখা নেই দুজনের। রফিক আর রানু প্রেম করছে এক বছর ধরে। প্রতিদিনই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজ নেয় দুজনে দুজনের।
দুপুরে কী খেয়েছ? কখন খেয়েছ? আজ কী করলে? কাল কী করবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওরা যেন জোড়া পাইনআপেল বিস্কুট। দুই দিকে দুই বিস্কুট ওরা দুজন আর মাঝখানে সাদা ক্রিম মানে প্রেম। মিষ্টি প্রেমে একে অন্যের সঙ্গে জোড়া লেগে আছে।
এক মাস পর আজ ওদের আবার দেখা হচ্ছে। একটা পার্কে ওদের আজকের এই দেখা। পার্কটা যে কোথাকার, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, আমি শুধু পার্কটাই দেখছি। তবে ভুল না হয়ে থাকলে এটা ফিলাডেলফিয়ার লাভ পার্ক হওয়ার কথা।
পার্কে রানুকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দীর্ঘ আলিঙ্গনে পিষ্ট করে রফিক। রানুও মোমের মতো গলে একেবারে সেঁধিয়ে যায় বুক ভেদ করে রফিকের হৃৎপিণ্ডের গভীরে।
রফিকের সর্বাঙ্গে আগুন জ্বলে, দাউদাউ আগুন। যেন মাটিতে গর্ত করে বানানো একমুখী সনাতন চুলায় শুকনো কড়কড়ে লাকড়ি জ্বলছে। রফিকের শরীর থেকে জিহ্বার মতো আগুনের শিখা অক্টোপাসের মতো রানুকে জড়িয়ে ধরে। একসময় মোমের মতো গলতে গলতে রানুর পুরোটাই গলে যায়। মোমের সলতে ছোট হতে হতে ফুরিয়ে যায়। পার্কে যেন এই মাত্র সুনামি হয়ে গেল।
দুই.
সুনামি শেষে বিধ্বস্ত জনপদে আবার যেমন সভ্যতা জেগে ওঠে, ঠিক তেমনি ইতস্তত জেগে ওঠে রফিক।
রানু তলপেটে হঠাৎ ভারী কিছু একটা অনুভব করে, তারপর তীব্র ব্যথা।
পার্কে রফিক আর রানুর মাঝখানে একপশলা জলের ধারা গড়িয়ে গেলে রানু কিছুটা স্বস্তি পায়। হঠাৎ একটা শিশুর চিৎকারে রানুর ব্যথা কমে। শিশুর এই চিৎকারের জন্যই যেন রানু অপেক্ষায় ছিল।
রানু ও রফিক শিশুটিকে খোঁজে। শিশুটি রানুর দুই ঊরুর মাঝেই ছিল। শিশুটিকে পেয়ে মনে হচ্ছে ওরা দুজনই খুব সুখী এবং খুশি।
তিন.
রফিক আর রানু এখন আর চুম্বনরত অবস্থায় নেই। আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থাতেও নেই। অনেক আগেই তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এখন শুধু হাত ধরাধরি করে মুখোমুখি দাঁড়ানো। আস্তে আস্তে সেই হাতের বন্ধনও দূরে সরতে থাকে।
রফিকের ডান হাত আর রানুর বাম হাত পৃথক হয়ে যায়। রফিকের বাম হাত এবং রানুর ডান হাত এখনো পরস্পর পরস্পরকে ধরে রেখেছে। মুখোমুখি থেকে এখন ওরা একদিকে মুখ করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
রফিকের বাম পাশে দাঁড়ানো রানু, রানুর ডান পাশে রফিক। তবে পাশাপাশি নয়, মাঝখানে দুই বছরের একটা ছেলে, যেন পাশাপাশি দুই বৃক্ষের মাঝে গজিয়ে ওঠা এক চারাগাছ।
চার.
কী আশ্চর্য, অকস্মাৎ রফিক আর রানু চরকিতে ঘুরছে, মাঝে দাঁড়িয়ে সেই শিশু। ওর বয়স একটু বেড়ে তিন বছর হয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে রফিক আর রানু চক্রাকারে বিচ্ছুরিত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পুরো পার্কটাও ঘুরছে। মাঝখানে স্থির রানু-রফিক দূরে যেতে যেতে তাদের হাতের বাঁধন ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। অবাক ব্যাপার হলো, রফিক ও রানুর সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই।
ঠিক তখনই তাদের প্রায় বিচ্ছিন্ন দুই হাতকে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাতে ধরল সেই শিশুটি। শিশুটির চোখেমুখে যেন সন্তানসুলভ আকুতি, যেন সে চায় না তার মা-বাবা পৃথক হয়ে যাক। কিন্তু শিশুটির দুর্মর চেষ্টাও থামাতে পারছে না ওদের এই ক্রমবর্ধমান দূরত্ব। শিশুটির বিষণ্ন দৃষ্টিতে পার্কের স্নিগ্ধ বিকেল ম্লান হয়ে যায়। আকাশে কালো মেঘ সমাবেশ করে বিলাপ করতে করতে কাঁদতে থাকে।
একপর্যায়ে রানু আর রফিক আলাদাই হয়ে যায়। ওদের মাঝখানে রাগ আর অভিমানের নদী এসে দুজনকে দুই তীরে পাঠিয়ে দেয়। তারপর শিশুটিকে আর দেখা যায় না। হয়তো মেঘের সঙ্গে নীল আকাশে খেলা করছে।
পাঁচ.
নিথর নিশ্চুপ ভাবলেশহীন রফিক আর রানু নদীর দুই তীরে উল্টো দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ওদের কারণে তরতাজা মনোরম এই পার্কের মধ্যে অচেনা এক নদী উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এ কোন নদী! এটা স্কুকিল রিভার? সে আবার কখন লাভ পার্কের মধ্যে ফাটল ধরাল!
ভালোবাসার পার্ক খ্যাত লাভ পার্ককে এই নদী দ্বিখণ্ডিত করেছে দুই ভাগেÑএকদিকে নারী, অন্যদিকে পুরুষ। অথচ এই পার্কের সৃষ্টি নারী-পুরুষকে এক করে মিলিয়ে অভিন্ন প্রেমে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেওয়ার জন্য। ফিলাডেলফিয়ার লাভ পার্কে ঢুকতে গিয়ে আমি কী সব দেখছি। ফিলাডেলফিয়ার ‘ফিলা’ শব্দের অর্থ আকর্ষণ, আর ‘ডেলফিয়া’ মানে জরায়ু বা গর্ভ, তার মানে নারী সম্পর্কিত বিষয়। ডেলফিয়া নিয়ে আরও অনেক কথা আছে গ্রিক পুরাণে। তবে ফিলাডেলফিয়ার সোজাসাপ্টা অর্থ ভ্রাতৃপ্রেম। চিরচেনা সেই পার্কের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর এক পাশে রানুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রেমিক, স্বামী, বয়ফ্রেন্ড, সংসারের মায়া ছেড়ে আসা হাজারো নারীর মুক্তাঞ্চল। অন্যদিকে রফিকের পেছনে দল বেঁধে আছে সেই নারীদেরই ক্ষুব্ধ স্বামী, বয়ফ্রেন্ড/প্রেমিক। নগর কর্তৃপক্ষের লোক এসে আমারই চোখের সামনে ‘লাভ পার্ক’ এর সাইনবোর্ড নামিয়ে নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। সেখানে সোনালি অক্ষরে লেখা আছে-ব্রেকআপ পার্ক। আমি কোন দিকে যাব? আমিও এক রফিক, আমার ঠিক গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আরেক রানু।
লেখক : ছড়াকার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।